Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গল্প

#সঞ্চালক#অমিতাভ_রায়     "নমস্কার। "বিচিত্র কাহিনি"-র পক্ষ থেকে আমি কৌশিক আপনাদের স্বাগত জানাই। এই জীবনে কতো বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে। সে সব খবর আমরা পাই না। মানুষ যে কতো বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হয়, তা নিজের চোখে না…

#গল্প



#সঞ্চালক

#অমিতাভ_রায়

     "নমস্কার। "বিচিত্র কাহিনি"-র পক্ষ থেকে আমি কৌশিক আপনাদের স্বাগত জানাই। এই জীবনে কতো বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে। সে সব খবর আমরা পাই না। মানুষ যে কতো বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হয়, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা এই রকম বিচিত্র কাহিনিই প্রতি সপ্তাহে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করি। আজও আপনারা সেইরকম বিচিত্র ঘটনা জানতে পারবেন। আজ আমাদের যাঁরা অতিথি, তাঁদের সবার একটা মিল রয়েছে। কী বলুন তো? আর হেঁয়ালি না করে বলেই ফেলি। এঁরা সবাই যমজ। আর, যমজ হওয়ার জন্যই এইসব মানুষ জীবনে বিচিত্র কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। আজ সেইসব ঘটনাই আমরা শুনবো তাঁদের মুখে। অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করাবার আগে এই অনুষ্ঠান যাঁদের সাহায্য ছাড়া সম্ভবপর হতো না- অর্থাৎ আমাদের সেইসব বিজ্ঞাপনদাতাদের কথা বলি।" এইখানে এসে প্রতিবারই একটু হোঁচট খায় কৌশিক। এতগুলো বিজ্ঞাপনদাতার নাম বলতে হয়। তাই, যথাসম্ভব সাবধানে বলতে চায়। এরাই তো চ্যানেলের প্রাণ। 


   বিজ্ঞাপনদাতাদের নাম বলার পরে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায়। সেই অবসরে স্ক্রিপ্ট দেখে নেয় কৌশিক। খুব যত্ন করে ও স্ক্রিপ্ট লেখে। সেই স্ক্রিপ্ট অতিথিদের আগেই দেখিয়ে নেয়। যাতে সমস্যা না হয়। দর্শক মনে করে এক্ষুনি ওরা প্রশ্ন শুনে উত্তর দিচ্ছে। লাইভের এফেক্ট বেশ ভালো হয়। তাই, কৌশিকের সঞ্চালনার ভক্ত অনেক। এই প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিথিদের জীবনের ঘটনাগুলো কিন্তু বানানো নয়। কৌশিক নিজে সাজিয়ে নেয়। আর প্রয়োজনে কিছু বানানো ঘটনার কথাও বলে। যেগুলো অতিথিদের নয়, নিজের বা অনুপস্থিত কারোর জীবনের ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। বিজ্ঞাপনের পরে অনুষ্ঠান শুরু হল। কৌশিক অতিথিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে প্রথম অতিথির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।, "আচ্ছা, নিখিলবাবু, আপনি আপনার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলুন।" নিখিলবাবু বলতে শুরু করেন, "আসলে আমাকে আর আর আমার যমজ ভাই নৃপেনকে দেখতে হুবহু এক। মা ছাড়া প্রায় সবাই আমাদের চিনতে ভুল করতো। এমনকি আমার বাবাও। একবার নৃপেন পরীক্ষায় ফেল করে খুব ভয় পেয়ে আমায় ধরলো। আমি নৃপেনের মার্কশিট নিয়ে দেখাতেই বাবা বকাবকি শুরু করল। এবার মারধোর শুরু হবে। ঠিক তার আগে মা এসে হাসতে হাসতে বলেছিল, "নিজের ছেলেদেরও চেনো না!" ব্যাস, বাবা চুপ।" কৌশিক দর্শকদের কথা ভাবে। ড্রয়িংরুমে টিভির সামনে বসে সবাই হাসছে। দর্শকদের অনুভূতি নিয়ে একটু না খেললে চলে না। জমবে না। কৌশিক হাসতে হাসতে বলে,"খুবই মজার ঘটনা। সেই ভাই- মানে নৃপেনবাবু এখন কোথায়?" যেন ও কিছুই জানে না। প্রৌঢ় মানুষটি চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, "গতমাসে সিকিমে বেড়াতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় ও চলে গেল।" কৌশিক মুখে বিস্মিতভাব ফুটিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,"আমি খুব দুঃখিত নিখিলবাবু। ভাবতেই পারছি না। আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই।" 


  এবার একটু আবহাওয়া বদলানো দরকার। নইলে দর্শক পছন্দ করবে না। কৌশিক সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনি ম্যাডাম এবার বলুন।" সুস্মিতা বলতে শুরু করে, "খুব মজার ঘটনা। আমার বোন সুতপার প্রেমে পড়েছিল এক যুবক। সে আমায় দেখে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি পড়ে হাসতে হাসতে তাকে বলেছিলাম- আমার বোনের প্রেমপত্র আমায় দিয়েছ কেন? সে বেচারা তোতলাতে থাকে। তারপর দ্রুত আমার সামনে থেকে পালিয়ে যায়। এর সপ্তাহ খানেক পরে সে আবার হাজির। আমি কিছু বলার আগেই বলে ওঠে," সেদিনের পর থেকে আমি আর ঘুমোতে পারছি না। কেবলই আপনার মুখ আর আপনার কথা মনে পড়ছে। আপনার বোনকে না চিনেই প্রেমপত্র দিতে এসেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি সেটা ভুল। আমি যে আপনাকেই ভালবেসে ফেলেছি।" "বলেন কী? তারপর? নিশ্চয়ই আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?" "তা, আর পারলাম কই?" এই বয়সেও সুস্মিতার গাল লাল হয়ে যায়? "তার মানে আপনি...!" কৌশিক কথা শেষ করে না। "সেদিন ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু, কিছুদিন পরে আর পারি নি। আসলে আমিও ওকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম।" কৌশিক যেন আরো বিস্মিত। "আর, আপনার বোন?" সুস্মিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ওর তো তখন প্রেম চলছিল। সেই ছেলেটি জানতো না। সুতপা পরে সব শুনে হেসে অস্থির।" "আচ্ছা, তিনিই কী আপনার বর্তমান স্বামী?" মুখ আরো লাল হয়ে যায় সুস্মিতার। "হ্যাঁ, সেই মনসিজই আমার স্বামী।" 


  কমার্শিয়াল ব্রেকের পরে আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়। "দীপকবাবু, এবার আমরা আপনার জীবনের গল্প শুনবো।" "আমার গল্প একেবারে অন্যরকমের। আমি আর আমার দাদা দেবেশ দুটো স্কুলে পড়তাম। দাদা ভালো ফুটবল খেলতো। একবার একটা টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওর ক্লাব উঠেছিল। কিন্তু, ওর স্কুলের পরীক্ষা সেদিন। আমি গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলাম। আর, দেবেশ সেদিন গোল করে দলকে জিতিয়েছিল।" "বা! অদ্ভুত ঘটনা। দেবেশ নিশ্চয়ই আপনাকে ভালো কিছু খাইয়েছিল সেদিন?" "না- না, এটা তো স্বাভাবিক। ভাইয়ের জন্য ভাই করবে না?" "তা তো বটেই। এরপর আর কিছু ঘটেছে?" "এর বেশ কিছুদিন পরে দেবেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা খুন করে বসে। তখন ও বিয়ে করেছে। ওর বউ গর্ভবতী। মা আর দেবেশের বউয়ের কাতর অনুনয় শুনে আমি দেবেশ সেজে জেলে থাকলাম।" কৌশিক প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে,"তারপর? তারপর?" "আর কী? স্কুলে আর জেলে আমি দীপক -দেবেশ সেজেই কাটিয়ে দিলাম।" "আপনি বিয়ে করেন নি?" "না। বিয়ে আর করবো কী করে? জেলেই যৌবনের দিনগুলো কেটে গেল।" "এখন কী আপনি আর দেবেশবাবু একসঙ্গে থাকেন?" "আমি জেল থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে মার মুখে শুনি ওরা মাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেছে! মাও আর বেশীদিন বাঁচে নি।" কৌশিক ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাবতে পারছেন আপনারা? ভাবতে পারছেন?" দীপকবাবু দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকেন।


   "আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠানের শেষ অতিথি মানববাবু। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ওনারা আজ আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন। আপনারা কী এটা জানেন যে, আপনাদের প্রত্যেকের মতো দেখতে কেউ না কেউ এই পৃথিবীতেই রয়েছেন। অথচ তিনি যমজ নন আপনাদের। আমি একবার ব্রাজিলে গিয়ে হুবহু আমার মতো একজনকে দেখেছিলাম। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলাম। বেরোবার সময় ভীড়ের মধ্যে তাকে দেখেছিলাম। যেন, আয়নায় নিজেকেই দেখছি। কিন্তু, কিছু বলার আগেই লোকটা ভীড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।" এটা ডাহা মিথ্যে। মাঝে মাঝে এরকম বানায় কৌশিক অনুষ্ঠানে একটু বৈচিত্র্য আনার জন্য। 

"বলুন মানববাবু।" "আমার ভাই মানস। আমি ভালবাসতাম রীতাকে। ওর বাড়ির সামনে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতাম একবার ওকে দেখার জন্য। ও এটা লক্ষ্য করেছিল। আমায় পছন্দ করে ফেলেছিল। কিন্তু, মানসকে আমি ভেবে ওর সঙ্গে একদিন কথা বলে ফেলে। ব্যাস, দুজনে দুজনকে ভালবেসে ফেলে। আমি আর আমার গোপন কথা প্রকাশ করি নি।" "ব্যাস! গল্প শেষ!" কৌশিক বিস্মিত হয়ে বলে। "আর, আপনি এরপর কিছু করেন নি। আপনি বিয়ে করেছেন?" "না- আর বিয়ে করা যায়?" "সে কী! এভাবেই আপনার কাহিনি শেষ হয়ে গেল?" "প্রায় শেষ হয়ে গেল। শুধু, একটা ঘটনা ছাড়া।" "কী?" "এর বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। রীতা ফোনে জানালো, ভাই অসুস্থ। ওরা বাইরে মানে বিদেশে থাকে। গেলাম। সত্যিই মানস খুবই অসুস্থ। ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা দুজনে মিলে যথাসাধ্য করলাম। রীতা একদিন নিভৃতে বলল,ও ভুল করেছে। মানসের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পরে বুঝতে পেরেছিল ওর বাড়ির সামনে মানস নয়, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু, তখন আর কিছু করার নেই।" "তারপর?" "তারপর রীতা আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করল। আমি রুগ্ন ভাই আর রীতাকে ছেড়ে চলে এলাম। তবে, অর্থসাহায্য এখনও আমি করি। কিন্তু, রীতাকে আজও ভুলতে পারিনি।" "এরপর আর কিছু বলার আছে? আপনারাই বলুন?" কৌশিকের চোখ চিকচিক করে ওঠে। এর প্রস্তুতি ও কিছুক্ষণ আগে থেকেই নিচ্ছিল। "আজ আমরা এখানেই শেষ করছি।" কৌশিক যেন কথাই বলতে পারে না। রাতে, বিছানায় শুয়ে মলি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার কোন কথাটা সত্যি, আর কোন কথাটা বানানো নিজেই আমি আজকাল তোমার অনুষ্ঠান দেখে বুঝতে পারি না। কৌশিক মলিকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিল। কিন্তু, ওর কথা শুনে থমকে যায়। বলতে পারে না, আজকের অনুষ্ঠানের শেষ ঘটনাটা লোকটার বানানো কিনা ও নিজেই বুঝতে পারে নি। কিন্তু, তাতে কীই বা এসে যায়? পাবলিক খেলেই হল। মলি কী যেন ভাবছে? "কী ভাবছ?" "আমিও কী তোমায় আমার জীবনের সব কথা বলেছি?" "মানে?" "সে জেনে কী করবে?" মলির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। কৌশিকের চোখে কিন্তু ঘুম নেই।