Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
ছোট গল্প - একটি বৃষ্টি ভেজা রাতের গল্প…………কলমে – সোমা সাহা (স্ফেরুমিনা)
পথ চলতি সারমেয়টা ডেকেই চলেছে একঘেয়ে কান্নার সুরে। কোন বাড়ির বড় দেওয়াল ঘড়ি জোরে জোরে ঢং ঢং করে বেজে উঠে জানালো এখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। হাল্কা …



সৃষ্টি সাহিত্য যাপন


ছোট গল্প - একটি বৃষ্টি ভেজা রাতের গল্প…………

কলমে – সোমা সাহা (স্ফেরুমিনা)


পথ চলতি সারমেয়টা ডেকেই চলেছে একঘেয়ে কান্নার সুরে। কোন বাড়ির বড় দেওয়াল ঘড়ি জোরে জোরে ঢং ঢং করে বেজে উঠে জানালো এখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। হাল্কা বৃষ্টি হয়েছে সন্ধ্যে থেকে, তাই ভিজে হাওয়ার ঝাপটা লাগছে গায়ে। একলা একটি ছায়া মানুষ হেঁটে যাচ্ছে নিজের খেয়ালে, তার কোন তাড়াহুড়ো নেই, ধীরে ধীরে একটি একটি পা ফেলে সে হাঁটছে। তার হাঁটার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে এই নিশুতি বর্ষার রাতের প্রতিটি শব্দহীন মুহূর্তকে অনুভব করছে নিজের মধ্যে। আসলে এই রকম নিশুতি বৃষ্টি ভেজা রাত তার বড় প্রিয়, নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায় সে। ছায়ামানুষটির খুব ইচ্ছে করছে এখন শুকনো পাতা ওড়া কুণ্ডলীর পেছনে ছুটে বেড়াতে, এভাবে হয়ত নিজের হারিয়ে যাওয়া শৈশবে ফিরে যেতে চায় সে।

এই ভাবে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সে শহরের শেষ প্রান্তে, এখন আর রাস্তা নেই, একটি নদী কল কল করে বয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। চুপ করে বসে পড়ে কতগুলো ভাঙা চোরা ইটের স্তুপের ওপর।

একটা ঘেয়ো কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল মাটিতে, তাকে দেখেই কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে ওঠে কুকুরটা, পরম স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে, তারপর চুপ করে বসে তাকিয়ে থাকে সামনে বয়ে যাওয়া ঘোর কৃষ্ণবর্ণ জলরাশির দিকে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মিষ্টি মধুর শৈশবের দিনগুলো, ফেলে আসা কৈশোর, দুরন্ত যৌবন……………… মনে পড়ে একটি অপূর্ব সুন্দরী কন্যার মুখ……… সেই কন্যার রূপ লাবন্যে পূর্ণ অবয়ব যেন পদ্মপাতায় টলটলে এক ফোঁটা শিশির। কত ঘণ্টা মিনিট কেটে গেছে সেই রূপ লাবণ্যের দিকে চেয়ে চেয়ে। প্রথম যেদিন এই কন্যার দেখা মিলল তার মনে হয়েছিল স্বর্গের অপ্সরী বুঝি নেমে এসেছে তার এই গতে বাঁধা মধ্যবিত্ত জীবনে। অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেই মুহূর্তকে যখন এই অসামান্যা রূপসী তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইল। বারংবার না করা স্বত্তেও তাকেই ভালোবেসে এল তার জীবন ধন্য করে দিয়ে।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছায়াশরীরটি, তারপর আবার ডুবে গেল তার ভাবনার জগতে।

বিবাহের প্রথম কিছুদিন ছিল অতীব মধুর, যাকে বলে নৌকার পালে যায় ভেসে জীবন, অবিচ্ছিন্ন ভাবে। কিন্তু সুখের মুহূর্তগুলো সব সময় খুব অল্প থাকে। জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই ঘিরে থাকে দায়ীত্ব, কর্তব্য, দুঃখ, অবসাদ, হতাশা, দিনগুলো হয় সমস্যা পরিবৃত্ত।

মাস-বছর ফুরতে না ফুরতেই ভালোবাসার নৌকার পালে হল ফুটো, নিত্যনৈমিত্তিক জীবন যাপন হয়ে উঠল দুর্বিষহ, কারণ অর্থাভাব। “টাকা নেই” এই শব্দ দুটো এমন বিশ্রী ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, যে ভালোবাসার কাঁধে ভর করে দুটো মানুষ এক সাথে ভেসেছিল জীবন দরিয়ায়, সেই ভালোবাসাই কীট রূপে কুড়ে কুড়ে খেতে ওদেরকে। আসলে সবটাই ছিল এক তরফা, আরেক তরফের ছিল ক্ষণিকের দুর্বলতা। কন্যার যে রূপ লাবণ্যে ডুবে ছিল তার মন, সেই রূপ লাগতে লাগল অসহ্য। অন্যদিকে যে ভোলাভালা মানুষটি মন কেড়ে নিয়েছিল রূপসীর, মনে হয়েছিল, শুধু এই মানুষটার প্রেমালিঙ্গনেই একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়, সেই মানুষ কাছে আসলেই তার গায়ের জ্বালা ধরত।

এরপর একদিন সেই ভোলাভালা মানুষটি আবিষ্কার করল যে সে তার অর্ধাঙ্গিনীর জীবনে ব্রাত্য হয়ে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে এক রহিসজাদা। তার রূপসী স্ত্রী তারই সামনে দিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে যাচ্ছে, রহিসজাদার সাথে চকচকে গাড়িতে। তাও সে শেষ চেষ্টা করেছিল এই সম্পর্কটাকে বেঁধে রাখবার মায়ার টানে। রূপসীর কোল আলো করে আসতে চলেছিল একটি নতুন প্রাণ। কিন্তু যেখানে ভিত্তি প্রস্থই নড়বড় করছে, সেখানে নতুন প্রাণও আনতে পারেনা কোন ভালোবাসার জোয়ার, এই নির্মম সত্যটি সেই মানুষটি বুঝতে পারেনি।

একদিন এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে মানুষটি দেখল তার রূপসী বক্ষল্গনা তার প্রেমিকের, তারই বিছানায় শুয়ে সুখনিদ্রায় মগ্ন। সেদিন মানুষটির রাগ ছাড়াল তার মস্তিষ্ককে, চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল সে তার রূপসীকে এবং হয়ত প্রথম তার গায়ে হাত তুলল। তার গলার আওয়াজ ছাড়িয়ে গেল তার ছোট এক তালা বাড়ির দেওয়াল, ছাদ।

“শয়তানী, তুই আমার বাচ্চার মা হতে চলেছিস, কি করে ভুলে যাস তুই? বিয়ের পর, তোকে খুশি করার জন্যে আমার মা, বাবা, বোন, ভাই সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি আমি। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে, শুধু মাত্র তোর জন্যে। আর আজ তুই এই লোকটার সাথে নষ্টামো করছিস আমারই বিছানায় শুয়ে, আমারই বাচ্চা পেটে নিয়ে। আমার সন্তান হলে তাকে কোন মুখ দেখাবি তুই? বল, বল, চুপ করে আছিস কেন?”

ঘরে কিছুক্ষণ পিন পতনের নিস্তব্ধতা, তারপর একটা পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ল রূপসী।

“তোর, বাচ্চা !!......সে কই ? তাকে আজকে সকালে চিরঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছি, আমি আর আমার এই বন্ধু। বাচ্চার বাপ সেজে ও বলেছে, এই বাচ্চা আমরা চাইনা, ভুল করে এসে গেছে,…………হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা………………একটা পূর্ণ বয়স্ক দম্পতি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কি পারে না? কে দেখতে যাচ্ছে কে আমার বর ?...... এবার চাই তোর থেকে মুক্তি, আমি আজকেই চলে যাব এখান থেকে…………এখুনি যাব। কি আছে তোর এই ছাই পাঁশের সংসারে? খালি অভাব আর অভাব, উফফ এইখানে আর এক মুহূর্তও নয়।”

পৃথিবীটা কি দুলে উঠল? শক্ত করে ধরা চুলের মুঠি আলগা হয়ে এলো, পা দুটোর আর জোর রইল না, টলমল করতে লাগল, কোন রকমে দেওয়াল ধরে নিজেকে দাঁড় করাল মানুষটি। তারপর তার গলা দিয়ে বেরুলো একটা আর্তনাদের মতন আওয়াজ, “তুই আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেললি, তুই এত এত …………………উফফ…………আমি আর ভাবতে পারছিনা”।

“হ্যাঁ ফেলেছি, কি করতাম ওকে এখানে এনে আমি? আমি নিজেই তো এইখানে হাঁপিয়ে উঠেছি, তোকেই আর আমি সহ্য করতে পারছিনা, তোর বাচ্চাকে কি করে সহ্য করব? ……………এবার আমি মুক্ত, পালাবো এখান থেকে। মর তুই এখানে।”

লোকটি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ঘরের এক কোণ থেকে তুলে আনল একটা ধারালো দাঁ, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক কোপে নামিয়ে দিল তার রূপসীর গলা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল, রূপসীর ধড়টা দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে আর তার মাথাটা খাটের ওপরে, রূপসীর মুখে তখনো লেগে আছে সেই পৈশাচিক হাসিটা। পরিস্থিতি খারাপ দেখে প্রেমিক বাবাজীবন ফাঁক তালে সরে পড়তে গিয়ে ধরা পরে গেল সেই ক্ষিপ্ত মানুষটির হাতে। তাকেও টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে দিল ঘরের মধ্যে, বাইরে তখন আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি নয়, অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। তাদের বাড়িটা ছিল পাড়ার এক টেরে এক কোণে, আর বাইরে তখন চলছে ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডব, মেঘের গর্জন, ঝোড়ো হাওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ, তাই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকা প্রতিবেশীরা কোন আওয়াজ পেলনা সেই সন্ধ্যায়।

সে টের পায়নি সে কাঁদছে, কাঁদছে এইজন্যে নয় যে সে দুটো মানুষকে হত্যা করেছে, কাঁদছে এই কথা ভেবে সে তার জীবনটা নষ্ট করেছে নিজের হাতে একটা ভুল ভাল সম্পর্কের জন্যে। একটা ভুল সম্পর্কের আবর্তের মধ্যে পরে সে হারিয়েছে তার সব প্রিয়জনকে, শুভাকাঙ্খিকে, তার বাবা, মা, ভাই, বোন, ইজের-বেলার বন্ধু, ছোট থেকে যাদের সাথে সে বেড়ে উঠেছে, তাদের সবাইকে। সবাই এখন তাকে ঘৃণা করে, কারুর কোন সহানুভূতি নেই তার জন্যে। কেউ আর ভাবেনা তার জন্যে। তার নিজের কৃতকর্মের জেরে সে তার প্রিয়জনদের জীবন থেকে মুছে গেছে চিরতরে।

সে একবার ভাবল পালিয়ে যাবে অন্য কোন দেশে, আবার নতুন করে শুরু করবে তার জীবনটা। তারপরে সিদ্ধান্ত বদলাল, নাহ পালাবেনা সে, পালিয়ে গেলে এই দুজনের মৃত্যুর জন্যে পুলিশ এসে তার পরিবারকে, তার বন্ধুদেরকে, নিয়েও টানা হ্যাচরা করবে, হয়রান করবে। আর তার প্রিয়জনরা তাকে আরও বেশী করে ঘেন্না করবে, শাপ শাপান্ত করবে জীবনভর। কেউ কাঁদবেনা তার জন্যে, কেউ দুঃখ পাবে না তার নষ্ট জীবনের জন্যে। আর সে নিজেও বেঁচে থাকবে এই দুটো মৃত্যুর দায় ভার বুকে লুকিয়ে, সে জীবন আরও বেশী দুর্বিষহ, অহরহ ভয় তাড়া করে ফিরবে তাকে, একটা কেন্নোর মত বাঁচতে হবে তাকে মুখ লুকিয়ে মাটির নীচে। নাহ…… এভাবে বাঁচা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই ভাবে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুও অনেক বেশী কাম্য। অন্তত তাকে যারা ভালোবাসত তারা দু-ফোঁটা হলেও চোখের জল ফেলবে তার মৃত্যুর খবরে।

আর দেরী করল না সে, একটা কাগজে তার জীবনের ইতি বৃত্ত অল্প কথায় লিখে, দাঁ চালিয়ে দিল নিজের গলায়, তার শেষ পত্রটি চুপ চুপে হয়ে ভিজে গেল রক্তে। পুলিশ যখন পরের দিন সকালে এলো শেষমেশ প্রতিবেশীদের চীৎকারে পাড়ার গলি দিয়ে রক্ত গঙ্গা বয়ে যেতে দেখে, প্রথমেই যে কটি কথা আত্মহত্যা পত্র থেকে উদ্ধার করল তা হোল, “আবার নতুন করে জন্ম নেব, আবার ফিরে আসব এই রোদ-বৃষ্টির পৃথিবীতে, তখন আমায় যেন তোমরা আর ঘেন্না কোরো না, থাকতে দিও তোমাদেরই মাঝে, তোমাদেরকেই ভালোবেসে, এই জীবনে দাও ছুটি,”।

সেই ছায়া শরীর চুপচাপ ভাবছিল তার ফেলে আসা জীবনটার কথা, ফেলে আসা সম্পর্কগুলোর কথা, ভাবছিল সেই প্রতারিনীর কথা, ভাবছিল তার না হওয়া সন্তানের কথা। এই সব ভাবনা চিন্তাগুলো একটার পর একটা তরঙ্গের মত তাকে আঘাত করছিল। একবার তার মনে হল, সে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে, তারপরেই তার মনে হল, সে নিজেই তো এখন একটা ছায়া, তার কান্না কেউ শুনবে না, কেউ বুঝবে না, তার আত্মা শুধু নিজেই গুমরে গুমরে মরবে যন্ত্রণায়। কিছুক্ষণ পর সে দেখল পূর্ব দিগন্তে ছড়াচ্ছে লালচে আভা, আর কয়েক মুহূর্তেই হবে সূর্যোদয়, আর দেরী করল না সে, ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনের বয়ে যাওয়া কালো জলরাশির মধ্যে, কয়েকটা হাওয়ার বুদ বুদ শুধু উঠল বয়ে যাওয়া জল রাশির মধ্যে থেকে আর একটা চাপা অব্যক্ত কান্না হাওয়ায় মিশে গেল।


সমাপ্ত…………………