#বসন্ত_আসে_না
ঘরময় ঘুরে বেড়ায় একটা অসহ্য যন্ত্রণার ছায়া-ভীষণ অস্থির,চোখ বুজে আসলেও ঘুমোতে পারি না কিছুতেই;ঘামে ভিজে ওঠা প্রতিটি স্নায়ুর আবেশে জড়িয়ে থাকে অ্যালকোহলের পুরোনো আসক্তি,বোকা মুহূর্তের হাততালি,ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক,সিলিং ফ…
#বসন্ত_আসে_না
ঘরময় ঘুরে বেড়ায় একটা অসহ্য যন্ত্রণার ছায়া-
ভীষণ অস্থির,
চোখ বুজে আসলেও ঘুমোতে পারি না কিছুতেই;
ঘামে ভিজে ওঠা প্রতিটি স্নায়ুর আবেশে জড়িয়ে থাকে অ্যালকোহলের পুরোনো আসক্তি,
বোকা মুহূর্তের হাততালি,
ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক,
সিলিং ফ্যানের সুইচটা অন করতেই টুকরো টুকরো হয়ে কেটে ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে;
পা পিছলে যেতে থাকে!
এখন বুঝি-
সমান্তরালে চলা দুটো লাইনের না-মেলানোর অঙ্ক..
জীবনের অঙ্ক কি সত্যিই মেলে! জানি না, আমার ধারণায় জীবনের অঙ্ক কারোরই কখনো মেলে না। আমি অন্তত শুনি নি, জীবনের অঙ্ক কারো জীবনে মিলেছে কিনা। আর আমার জীবন কোনোদিনই অংকের নিয়মেই চলে নি, তাই মেলার কোনো প্রশ্নই আসে না। জীবনের অংক যে শুধু মেলে না তাই নয়, জীবনের অঙ্ক বড্ড জটিল। অত জটিল অংক মিলবে কেমন করে! তবে এখন আর জীবনের অঙ্ক নিয়ে ভাবি না, ভাবলে নিজেকে ভীষণ খুব দিশাহীন লাগে, অসহায় লাগে। বরং জীবনের অঙ্ক মিলবে না এটা ধরে নিলে তখন আর জীবনের অঙ্ক না মেলার কষ্টটা সেভাবে থাকে না।
আমার সেভাবে যে খুব একটা কষ্ট আছে এমনটা নয়, তবু আমার মাঝে মাঝে নিজেকে বড় একা লাগে। মনে হয়, আমার তো সবই আছে, তবু কি যেনো একটা কিছু নেই। আর এটা ভাবলেই তখন বুকের ভিতরে এক শূন্যতার ঢেউ ছুঁয়ে ছূঁয়ে চলে যায়। আমি আমার এই অনুভূতিকে ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারবো না, কাউকে বোঝাতে পারবো না যে আমার এই কষ্টটা আসলে কিসের কষ্ট।
কখনো কখনো আমি নির্জন দুপুরে, অথবা ক্লান্ত সন্ধ্যায় একা একা পথ হাঁটি। হাটতে হাঁটতে কতো যে এলোমেলো কথা, মস্তিষ্কের কার্নিশে ভিড় করে… এলোমেলো করে দেয় সব ভাবনাগুলোকে। আজকাল তো আমি বর্তমানে থাকি না বললেই চলে, বরং মনের মধ্যে ভিড় করে সব পুরনো দিনের স্মৃতি… আর ভাবতে ভাবতে অদ্ভুতভাবেই মনের সবটুকু জুড়ে দখল নিয়ে নেয় আমার নিঃসঙ্গতা। আর এই নীরব জন্ম দেয় বিষণ্নতার। জীবনে যদি বসন্তই না এলো, তাহলে প্রেমের কবিতা লিখে কী হবে? তবু ভাবনারা ধূসর বসন্তকুঞ্জের মুগ্ধতা খুঁজে ফেরে।
আমাদের এই কলকাতা শহরে কেউ হয়তো একা থাকে না। একা থাকবে কি ভাবে! কারণ আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে এতো যে ব্যস্ততা, এত কাজের চাপ, প্রতি মুহূর্তের এতো লাঞ্ছনা, ক্লান্তি, হতাশা, ভালোবাসা, স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কাজেই একেবারে একা থাকা আর হয়ে ওঠে না। একা থাকার জন্য যে নির্জনতা দরকার, সেই নির্জনতা আমাদের জীবনে কোথায়?
কিন্তু এই শহরে কেউ কারো খোঁজ রাখে না, না সুখে না দুঃখে। দূরের মানুষ তো বটেই, একই ছাদের ওপরতলা-নিচতলার খোঁজ কেউ রাখে না। খবরহীন খবর নিয়ে কেটে চলে যায় আমাদের মাসের পর মাস-বছরের পর বছর… জীবন কিন্তু তবুও বয়ে চলে আপন খেয়ালে। একাকীত্ব তবু কাটে না, গতকাল-আজ; এভাবেই চলে দিনের পর দিন…....।
অন্য অফিসের কথা বলতে পারবো না, তবে আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করা মানে, জীবনকে পুরোপুরি স্থবির করে তোলা। এমন অফিসে আমি চাকরি করি, যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না ঘরের ভিতরে, কোনোদিনই। আমাদের অফিসে জানালা আছে অনেকগুলো, কিন্তু তার অর্ধেক ঢেকে গেছে ফাইল ভরা আলমারী দিয়ে, বাকি জানালাগুলোও খোলা হয় না কখনো। হৃদয় বড়ই অবুঝ, তাই সে প্রতীক্ষায় থাকে কোনো এক শুভদিনের। ঝকঝকে রোদে ভিজিয়ে দেবে মনের সব গ্লানি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় যে, বসন্তও আসে না, আর কোকিলও ডাকে না- কুহু কুহু করে! কেবলই শহরজুড়ে কাকের কর্কশ কা-কা ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। আমার চারপাশে গুনগুনিয়ে চলতে থাকে অনাকাঙ্ক্ষিত কোলাহল, তাতে কি আর আমার মন ভেজে! তাই আমার নিঃসঙ্গতা কাটে না। কতোদিন ধরে প্রতীক্ষায় থেকেছি, আমার যদি কোনো এক সুন্দর মনের একটা বন্ধু থাকতো! সে দেখতে যেমনই হোক না কেন, কিন্তু তার মধ্যে যেন স্নিগ্ধ ও আন্তরিক মন থাকে, যাকে ছোঁয়া যায় আপনজনের মত করে। সেরকম কাউকে পেলে আমি আমার মনের সব সুপ্ত কথামালার অর্গল খুলে দিতাম তাকে।
আবার মাঝে মাঝে ভাবি, বিশেষ কারো দরকার নেই, সবার মাঝেই আমার হৃদয়ের সব গোপন কথাগুলো বলে দিই অবলীলায়। রাশি রাশি গোপন কথার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই। জেনে যাক সবাই, আমার অথবা আমাদের না বলা কথা। আসলে গুছিয়ে না বলতে পারার কষ্ট আমায় ঘিরে রাখে। আমার গল্পগুলো মনেহয় খানিকটা কবিতার মতোই কঠিন। কবিতা যেমন হাহাকার করে সঠিক ভাষা পাওয়ার অপেক্ষায়। আমারও যেন মনেহয় সঠিক শব্দগুলো খুঁজে পাই না যা দিয়ে আমি আমার অনুভূতিকে প্রকাশ করবো।
আমি বরাবরই অগোছালো। তোমাকে অনেক সাধনা করেও যেমন পাই না; আমার না বলা গল্পগুলোও তেমনই ভাষাহীন রয়ে যায়। হৃদয়ের মধ্যে রয়ে গেছে অসংখ্য সাদা পাতা, ভাসতে থাকে এপ্রান্তে থেকে ওপ্রান্ত। সম্মোহিত আমি, সাঁতরাবার আনন্দ অথবা কষ্ট পাই। অতল গহীনে ডুবুরির মত ডুবে বেড়াই। নিশ্চুপ-নির্জনতা খুঁজে বেড়াই আমার চারপাশে। নির্বাসিত হতে পারি; কিন্তু ভেতরের আমিত্ব থেকে যে নির্বাসন দেবার সূত্রটা জানা নেই! সমস্ত উত্তাল ঝড় যদি ভেতরেই থাকে, নির্বাসন সেখানে অর্থহীন হয়ে দাঁয়ায়। অনন্তকাল পালিয়ে বেড়াতে চাই আমার আমি থেকে। আক্ষেপ, সে কখনো ছাড়ে না আমায়।
আমার গল্প বলা আর হয় না। ভেতরের অন্ধকারে কোণায় কোণায় লুকিয়ে পড়ে ওরা হাজারো ভাষাহীন কবিতার মতো। আবারো জমাট বাঁধে দেহহীন সব শব্দের ভ্রুণ আমার আত্মার মাঝে। আমি মিলিয়ে যাই অজস্র আত্মার মাঝে। বিলিন হয়ে যাই। ভেসে যাই। ডুবে যাই। হারিয়ে যাই। এই হারানোতে বিন্দুমাত্র আনন্দের লেশ নেই। কিছু তিতিক্ষা আছে। আর আছে প্রকাশ করার ক্ষমতাহীন বিভৎস কিছু অনুভূতি। নিরন্তর মরতে থাকি আমি ভেতরে ভেতরে। আর ভাষাহীন কবিতার মতো গল্পেরাও। তবে ওরা ভূত হতে জানে। বিভৎসও হতে জানে। আর আমি আফিমের সাথে মুখ গুঁজে বসে থাকার জায়গা খুঁজি, নেশায়।
মাঝে মাঝে কেউ আমার মাঝে উঁকি দিলে আবার প্রত্যাশার পাহাড় জাগে, কিন্তু সেই উঁকি দেওয়াই সার, তেমন কারো দেখা মেলে না। তেমন কেউ কথা দিয়েছে সেটাও বলবো না; আর কথা দিলেও কেউ কি তা রাখে? এই কর্পোরেট যুগে কথা দেয়ই বা কজন? কেনো জানি, আজকাল আমার কেবলই মনে হয়- বহুদিন ধরেই আমি ভালোবাসাহীন। বহুদিন ধরেই জীবনে আসে নি কোনো উথাল-পাথাল মেঘ। বহুদিন পরে নি কোনো হাত আমার কপালে, ভালোবাসার স্বপ্ন দেখার মত কোন লোকই মেলে নি। বহুদিন ধরে একা একা ছন্দহীন জীবনের দীর্ঘ পথে হাঁটতে হাঁটতে, ক্লান্ত হয়ে পরেছি। তবু জীবনে বসন্ত আসে না, কোকিল ডাকে না সরবে বা নীরবে। তবু দিন কেটে যায় রাত কেটে যায়। স্বপ্ন ও সম্ভাবনা পাশাপাশি চলে, নিশিদিন। বহুদিন ভালোবাসাহীন… ।
-----অমিত রায়