Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

স্মৃতিচারণ ::লু বইছে ঝাড়গ্রামে / অমৃত মাইতি

স্মৃতিচারণ ::লু বইছে ঝাড়গ্রামে /(১)অমৃত মাইতি
আমার বাড়ি শিবরামপুর (নন্দীগ্রাম) থেকে মেদিনীপুর শহর দিয়ে ঝাড়গ্রাম ১৭০ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে বাসে সময় লাগতো আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। আমার বাড়ি …

 


স্মৃতিচারণ ::লু বইছে ঝাড়গ্রামে /(১)অমৃত মাইতি


আমার বাড়ি শিবরামপুর (নন্দীগ্রাম) থেকে মেদিনীপুর শহর দিয়ে ঝাড়গ্রাম ১৭০ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে বাসে সময় লাগতো আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। আমার বাড়ি থেকে বাস রাস্তা ছ' কিলোমিটার । শীত বর্ষা গ্রীষ্ম খাল পাড় ধরে কখনো পিচ্ছিল পথ মাথায় ছাতা রোদ বৃষ্টিতে নিত্যদিনের হেঁটে যাওয়া। কোন বিকল্প উপায় ছিল না। এভাবেই একটা অভ্যস্ত জীবন কেটে গেছে, সুদীর্ঘকাল। বাড়ি থেকে তমলুক শহরে যেতে নদী পেরিয়ে সময় লাগত সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে টানা ২২ টা বছর এভাবেই তমলুক এস ডি জে এম কোর্ট এ হাজিরা দিয়েছি।

    নন্দীগ্রাম খেজুরি সুতাহাটা থেকে হাঁটা পথে বারবার বাস চেঞ্জ করে মেদিনীপুর শহরে যেতে ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগতো। কালেক্টারিতে কোট -কাচারিতে সময় মত পৌঁছতে গেলে একদিন আগে শহরে গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে হতো। এটাই ছিল আমাদের অভ্যস্ত জীবন। আগে বাস সার্ভিস ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ছোট ছোট বাস লিমিটেড স্পিড।

    অবিভক্ত মেদিনীপুরের সমগ্র ঝাড়গ্রাম আমার নখ দর্পণে। একদিকে বেলপাহাড়ি তারপরে ঝাড়খন্ড। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের চিচড়া চেকপোস্ট আমাদের বর্ডার। ফেকো ঘাট থেকে গোপীবল্লভপুর। সেদিন গোপীবল্লভপুরে আমার সংযুক্ত কিষান সভার মিটিং ছিল। খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরোলাম ছয় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গড়গ্রাম বাস স্টপেজ। তারপর মেদিনীপুর শহরে কমরেড বিবেক বোসের বাড়ি। বিবেকদা বললেন তুমি এখনই বেরিয়ে যাও ঝাড়গ্রাম।ভোলা রায়ের কাছে ঠিকানাটা জেনে নিয়ে চলে যাও গোপীবল্লভপুর। সেখানে ধ্যাঙ্গা 

হাঁসদা মিটিং ডেকে রেখেছে ।তোমার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করবো। গোপীবল্লভপুরে তখন ভয়ংকর নকশাল আন্দোলনের ঢেউ বইছে। আমি ঝাড়গ্রাম গেলাম ।আগুনের হলকার মধ্য দিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি ভোলা রায়ের বাড়ি। লু বইছে। চোখ মুখ পুড়ে যাচ্ছে নাক দিয়ে গরম বাতাস। মানুষজন ঘরের মধ্যে। পেলাম ভোলাদার বাড়ি। তিনি বললেন তুমি যদি এখনই বেরিয়ে পড়তে পারো তাহলে ছটার আগে পৌঁছে যাবে গোপীবল্লভপুরে। বললাম আমি একটু চান করি। আর থাকতে পারছি না। ভোলাদার একার খাবার। খুব খিদে ।মুখে বলতে পারছি না। বললাম খেয়ে নিয়েছি। আবার হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ড। শুধু আগুনের ছাঁকা। কি অদ্ভুত ব্যাপার, একবারও মনে হয়নি এভাবেই যাওয়া যায় না। আমার বাসটা পৌঁছে গেল ছটার একটু পরে। শেষ বাস ছেড়ে চলে এসেছে

গোপীবল্লভপুর থেকে। কোথাও দেখতে পেলাম না ধ্যাঙাকে। পুরো রাস্তাটা এক কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে দেখতে পেলাম না কাউকে। আমার জন্য অপেক্ষা করে করে কোথাও হয়তো বসে গেছে। ১৯৮৪ সাল।

ফেরার বাস নাই থাকার জায়গা নেই। সেই কত ভোরে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে ।শরীরটাও ক্লান্ত। একটি গুমটি দোকানদার। নাম বংশী দাস। আমি জানতাম না সে আমাদের দলের সমর্থক। পরে ধ্যাঙ্গা আমাকে বলেছিল। যাই হোক বংশীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছি।অনেক রাতে তার বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। গোবর জলে নিকোনো উঠোনে একটি মাদুরের ব্যবস্থা হল আমার। নির্ঘুম রাত কেটে গেল আমার। খুব ভোরে সুবর্ণরেখার জলে মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে প্রাতকৃত্য সেরে নিলাম। ছটায় ফাস্ট কার ছেড়ে যাচ্ছে হলদিয়া। সুতাহাটায় আমার মিটিং। রাস্তায় বাস এক্সিডেন্ট। ডান পায়ের গোড়ালি গেল ভেঙে। বুঝতেই পারছেন তারপর প্লাস্টার করা। গাড়ি ঘোড়া নাই কিভাবে বাড়ি এলাম! এক সপ্তাহ পরে আমি ঠিক এইভাবে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে বাসে কখনো একটু সিট পেয়েছি, পৌঁছে গেছি মেদিনীপুর শহরে। অবশ্যই আমার স্ত্রী মলিনা দেবী ছিল সঙ্গে। ভাবছি এভাবে দিনের পর দিন যখন রোদ বৃষ্টি আর ভয়ঙ্কর দাবদহ উপেক্ষা করে সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি ,তখন কিন্তু অনেক বন্ধু সকাল স্কুল করার পরে দুপুরে ভাত খেয়েছে আম ডাল দিয়ে। দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে ।দিনের পর দিন বিশ্রাম করার সুযোগ পেয়েছ। আমার কিন্তু কোন বিরাম ছিল না।



স্মৃতিচারণ (২)

(জাম্বানি/ঝাড়গ্রাম)

আমার খুবই প্রিয় একটি স্মৃতি যা ভাবলে জিভে জল আসে। শীতকাল। গন্তব্য জাম্বানি(ঝাড়গ্রাম )। চিচড়া চেকপোস্ট থেকে দু কিলোমিটার ভেতরে চিয়াপাড়া যুধিষ্ঠির গিরির বাড়ি। বাড়ি থেকে দেড় ঘন্টা হাঁটার পরে গড়গ্রাম বাস স্ট্যান্ড ।চারটায় ফাস্ট কার। তারপর নন্দকুমারে এসে হলদিয়া বাস ধরে চিয়াপাড়া চেকপোস্ট। বাস থেকে নামলাম ঠিক দশটায়।এক আদিবাসী রমণীকে জিজ্ঞেস করলাম, চিয়াপাড়া যুধিষ্ঠিরের বাড়ি কোন পথে,? আমার পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর সাদা চাদর। বুঝতে অসুবিধা হয় না আমি ঝোপঝাড় জঙ্গলের মানুষ নই। আমাকে দেখল তারপরে বিরক্তি ভরে দেখিয়ে দিল সঠিক রাস্তাটি। একবার পথ হারিয়ে গেলে জঙ্গলে , গন্তব্যে পৌঁছানো বিপদ।

ছোট্ট একটি খড়ের চালা। উঁচু উঠোন। ভেতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। ডাকলাম যুধিষ্ঠির বাড়ি আছো? যুধিষ্ঠিরের বউ বেরিয়ে এসে বলল ও বাড়ি নেই। আপনার আসার কথা ছিল। বিরাট লেবু বাগান। উঁচু উঁচু গাছ ছায়া ঘেরা হালকা রোদ। একটি খাটিয়ায় শুয়ে গেলাম আমি ।চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। বারোটা নাগাদ যুধিষ্ঠির এল। দাদা উঠুন চান করতে হবে। মাটি বলতে মোরাম। পুকুরে জল মনে হলো লাল। যুধিষ্ঠির বললে জলটা কিন্তু স্বচ্ছ। মনে হচ্ছে লাল। চান করার পরে লেবু বাগানে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা। মাটিতে পেতে দিল চট। একটি কলাই করা ডিশে ভাত। কাঁচা সবুজ শালপাতায় আলু মাখা মাটিতে। আরেকটি এলুমিনিয়ামের বাটিতে বুনো আলু আর চারা মাছের ঝোল। খিদের জন্যই হোক রান্নার গুনেই হোক পরম আনন্দের তৃপ্তিতে খেলাম। আজও সেই খাবার আমার জিভে লেগে আছে। কি অপূর্ব স্বাদ। যখনই মিটিংয়ে দেখা হয়েছে যুধিষ্ঠিরকে বলেছি তোর বাড়ির খাওয়ার ভুলবো না কোনদিন। না আজও ভুলিনি। এই খাবারের সঙ্গে ছোটবেলার একটা স্মৃতি আমার ভেসে ওঠে বারবার। আমি মা ও বাবা। আমি এবং বাবা খাচ্ছিলাম ।পরিবেশন করছে মা। বাবা বললেন রান্নাটা ভালো হয়নি। আমি বললাম বাহ কি সুন্দর রান্না। তোমার শুধু মায়ের খুঁত ধরাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবা বললেন তুই তো বানরের জাত তোর মুখে সবটাই মিষ্টি। আমার খাওয়ারে কোনদিন কোন অরুচি নেই। আজো আমি শাক সেদ্ধ একটা পোড়া লঙ্কা ভাতের সঙ্গে খেয়ে আনন্দ পাই। শাকের একটা অদ্ভুত স্বাদ আছে। একটু বেশি শাক পুরো ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে মাখিয়ে পোড়া লঙ্কা কেটে কেটে খেলে এক অখন্ড তৃপ্তি পাওয়া যায়। শাক একটু বেশি হলেই ভালো ।

যতটা ভাত ততটা শাক আমার চাহিদা।

শাক ভাত কেন এত ভালো লাগে আমি তার একটি কারণ অনুসন্ধান করেছি। ভাতের উৎপত্তিস্থল মাটি। শাকের উৎপত্তিস্থল মাটি। উভয়ের জন্মরস মাটি থেকে নেওয়া। তাই দুয়ে মিলে স্বাদের ভান্ডার। আমার গ্রাম আমার আবেগ আর মাটিতে লেগে থাকা জন্মদাগ আত্মতুষ্টির অন্যতম কারণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সীমিত চাহিদা। তাইতো যুধিষ্ঠিরের বউ আমাকে যত্ন করে যেটুকু খাওয়ার খাইয়েছিল তা স্মৃতিপটে সঞ্চিত আছে।

(চলবে)...


স্মৃতিচারণ (৩)/অমৃত মাইতি


ঝাড়গ্রাম ১৯৮৯ সাল। জেলা সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হল ঝাড়গ্রামে। ঝাড়গ্রাম এর বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরাঘুরি করে আমার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল ঝাড়গ্রামে পার্টির (আর এস পি) জেলা সম্মেলন করা যায়। আগেই বলেছি আমার বাড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম ১৫০ কিলোমিটার। আমি কোনদিনই শহরের মানুষ নই। শহরে বাড়ি হলে অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করা যায়।

যোগাযোগ এবং যেকোনো অঞ্চলে যাতায়াতের গাড়ি-ঘোড়ার সুবিধা। আমি চিরকাল এই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছি। প্রচারের জায়গা হল শহর। শহরে পিঠ চাপড়ানোর লোক থাকে অনেক।

সামান্য কিছু কাজ করে দ্রুত পরিচিতি লাভের সুযোগ থাকে শহরে। এসব নিয়ে ভাবি নি কখনো আমি কারণ যেখানেই থাকি না কেন সেখানেই আমার কর্মস্থল। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারাটাই উত্তরণের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

   বাড়ি থেকে।অতদূরে ঝাড়গ্রাম শহরে সম্মেলন ও প্রকাশ্য সমাবেশের স্থান ঠিক করার কাজটা খুব সহজ

 নয়। সম্মেলনের অধিবেশন কক্ষ। প্রতিনিধিদের থাকার ব্যবস্থা, সমাবেশের লোকজন জড়ো করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ । তখন দলটাও ছিল একেবারেই অগোছালো এবং তেমন পরিচিতি, বিস্তৃতি ছিল না। কিন্তু যে কোন ঝুঁকিবহুল কাজে আমার আগ্রহ এবং জেদ আমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। বাড়ি থেকে অত দূরে গিয়ে ব্যবস্থাদি করে আবার ফিরে আসা। বিভিন্ন লোকাল কমিটিগুলোতে সম্মেলন করা একই সঙ্গে চলতে থাকলো। প্রকাশ্য সমাবেশ হল সম্মেলন হল সাফল্যের সঙ্গে। সে কি তৃপ্তি আর আনন্দ। পারলাম তো। সেই যে ছোটবেলা পড়েছিলাম Where there is a will there is a way কিংবা নেপোলিয়নের ভাষায় অসম্ভব একমাত্র মূর্খদের অভিধানে থাকে। সেই বছর আমি হলাম অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক। গ্রামের মানুষ আমি। অবিভক্ত মেদিনীপুর ভাবতে অবাক লাগে ,এখন যেখানে তিনটি জেলা।

  এক সময় বিপ্লব হবে ভেবে চাকরি ছেড়েছিলাম। তাছাড়া কৃষক খেতমজুরদের সঙ্গে সংগ্রাম আন্দোলনের পুরোভাবে থাকতে গেলে চাকরি করার সময় পাওয়া যায় না। সর্বক্ষণের কর্মী হতে হয়। না হলে ঝান্ডা হাতে থাকবে ঠিকই কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকির ফাঁকে পড়ে যেতে হয়। ছাত্র যুব আন্দোলন করতে করতে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমাদের নেতারা এবং নিজেরাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম

কেরিয়ারিস্ট হওয়ার লোভ ছাড়তে হবে। যে কোন একটি পথ বেছে নিতে হবে। তাই আজীবন মানুষের সঙ্গে থাকার আর সার্বক্ষণের কর্মী হিসেবে থাকার চেষ্টার ত্রুটি করিনি। ধীরে ধীরে এগিয়েছি যত দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়েছি তত ।দিন রাত এক করে চরখির মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনো বাসের ছাদে কখনো সিঁড়িতে ঝুলে ঝুলে। গোটা জেলাকে সংগঠিত করে মেদিনীপুরে জর্জ কোর্ট মাঠে এক বিশাল সমাবেশ করতে পেরেছিলাম আমরা। কোন কোন বন্ধু এখনো সেই আলোচনা করে আমার সঙ্গে। আবেগ ও জেদ আমাকে পরিচালিত করেছে সারা জীবন। আমার মাথার উপরে কোন দাদা ছিল না। ভুল ভ্রান্তি হলেও কাজের প্রতি নিষ্ঠার ত্রুটি ছিল না। মানুষের সঙ্গে থাকা মানুষকে সচেতন করা এক অদ্ভুত নেশা সবাই অনুভব করতে পারবে না। যাই হোক আমার বোধের জগৎ আমার অনুভবের জগৎ হল শ্রেণি চেতনা। ঝাড়গ্রামের সম্মেলন আমাকে যেকোনো ভারী কাজ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। আমার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

(চলবে)....