সৃষ্টি সাহিত্য পরিবারনাম:- মূঁঢ়া গাঁয়ের উপকথাকলমে:- তপন কুমার রায়তারিখ:- ১৬/০৬/২৩ (৯০)
নিতাইদের দশ দিনে কাজ। এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করতে হবে। মাথার ওপর তো কেউ নেই বড়, এক মা আছে। আর আছে দিদি প্রসাদী…
সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার
নাম:- মূঁঢ়া গাঁয়ের উপকথা
কলমে:- তপন কুমার রায়
তারিখ:- ১৬/০৬/২৩
(৯০)
নিতাইদের দশ দিনে কাজ। এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করতে হবে। মাথার ওপর তো কেউ নেই বড়, এক মা আছে। আর আছে দিদি প্রসাদী।প্রসাদী ছোট ভাই মানু কে খুব ই ভালোবাসো তাও কখন কি নিয়ে চেঁচাবে তার তো ঠিক নেই। তবে নিতাই তাকে কিছু বলবে না।
নিতাই সকাল বেলা একবার শ্বশুর বাড়ী গেল। সকালবেলাটায় গীতার বাবা বাড়ীতেই থাকেন। কথাবার্তা হোক বা না হোক নিমন্ত্রণ টা সেরে আসতে পারবে। বাড়ীতে ঢুকতেই দুলালের বউ "এসো ঠাকুরজামাই এসো" বলে আপ্যায়ণ করল। তারপর একটা কম্বল আসন পেতে বসতে দিল শ্বশুরমশাইয়ের পাশেই। গজেন্দ্র বাবু জিজ্ঞেস করলেন---- কাজকর্মের ব্যাপারে কিছু ঠিক করলে নিতাই?
----- না।এমনি পুরোহিতকে তো বলে রেখেছি। আর খাওয়ান দাওয়ানের ব্যাপারে ছোট করেই সারবো ভেবেছি।
এখন নিমন্ত্রণ গুলো সারতে হবে এই যা। দুলালের বউ রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে---- -- " ঠাকুরজামাই চা খাবে না কি?" বাসু বলে ---"জিজ্ঞেস করার কি আছে? নিতাইয়ের সাথে আমাদের ও একটু কোরো"।
চা খাওয়া কারো শেষ হয়নি ভাস্করের বাড়ীর কাছ থেকে একটা আাওয়াজ ভেসে আসে--- --- " ওরে বাবা রে,মেরে ফেলল রে। আমি কি করেছি রে শালী? আমাকে এখানে মারছিস কেন। কে আছো, আমাকে বাঁচাও, এই কুলোটা মেয়েছেলেটার হাত থেকে, বাঁচাও"। ফণীদা র গলা না? কি হলো আবার! নিতাই উঠে পড়ে। গোমস্তামশাই বলে---- নিতাই পাড়ার ছেঁড়া ঝামেলায় যেও না। এই অবস্থায় বরং এখানে একটু বসে বাসু - দুলালের সাথে কথা বলো।
নিতাই বলে,-_---" না। একটু দেখে আসি " , বলে উঠে পড়েে।
----- "বাপের ছেলে তো। রক্ত আর যাবে কোথা।" বলে গজেন্দ্র বাবু ও উঠে পড়ে। তাকে তো আবার সেরেস্তা যেতে হবে।
নিতাই বেরিয়ে দেখে ভাস্করদার বাড়ীর সামনে অনেক লোককে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে।ভাস্করদা তার ডাক্তারখানায় নির্লিপ্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। লোকজন সরিয়ে সামনে এসে দেখে,ফণীদা মাটিতে পড়ে পড়ে চিৎকার করছে, আর মঞ্জু একটা লাঠি দিয়ে ফণীপালকে মারছে। নিতাই গিয়ে মঞ্জুর হাত থেকে লাঠি টা কেড়ে নেয়।জিজ্ঞেস করে ------কি হয়েছে কি? ফনীদাকে মারছো কেন? কি করেছে কি? মঞ্জু বলে----" ওর এত সাহস যে আমাদের ঘরে উঁকি দিচ্ছিল সকালে?"
----- "ও তোমাদের ঘরে উঁকি দিয়েছে মানে কি? ও তো তোমাদের ঘরেরই লোক, যখন খুশী ঢুকতে পারে।"
----- "না। ও ওবাড়ীর পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল।" বলে কানুতাঁতীর বাড়ীটা ইশারায় দেখিয়ে দিলো।
ফণীভূষণ পাল কয়াল বাড়ীর লোক।তার মদ- মেয়েছেলের নেশার সুযোগ নিয়ে সুফল চক্রবর্তী আর কানুতাঁতী তার সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়। তার বসত বাড়ীটুকু পর্যন্ত নিয়ে নেয়।ফণীর বউ মঞ্জুকে কানু তার বাড়ীতে কাজের নামে রেখে কার্যত রক্ষিতা করে রাখে। মঞ্জুর পেটে কানুর তিনটি সন্তান হয়। সব সন্তান ফণীর বলেই চালায়। কানুর বউ প্রতিবাদ করলেই প্রচন্ড মারধোর খায়। ভয়ে সব মেনে নিয়েছে। কিছু বলে না।
যে ফণীভূষণ সিল্কের পাঞ্জাবি, পাম্প সু, ধাক্কা পাড় ধুতি ছাড়া পড়ত না। সেই ফণী এখন একটা আধময়লা খাটো ধুতি পড়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায় বাড়ী বাড়ী ছোট ছাটা কাজের খোঁজে। কয়েকটা বাড়ীতে রোজ খড় কেটে গরুর জাবনা করে। কারো গোয়াল কেড়ে( পরিস্কার) দেয়। কারো বাগানের বেড়া বেঁধে দেয়। কারো ইট বয়ে নিজের বিড়ির পয়সাটা যোগাড় করে। গীতা মাঝে মাঝেই ফণী কাকাকে ডেকে চা খাওয়ায়। ফণীও পরম তৃপ্তি করে চা টুকু খায়।
মঞ্জু আগে সারাদিন কানুর বাড়ী কাজ করে রাতটুকু ফণীর বাড়ীতেই কাটাতো। ইদানীং মঞ্জু ছেলে মেয়ে গুলোকে রাতে খাওয়ানোর পর ফণীর বাড়ীতে রেখে আসে। ফণীর সাথে এ নিয়ে চেঁচামেচি রোজকার ব্যাপার ছিল। আজকাল আর এ নিয়ে ফনী কিছু বলে না। বলে লাভ তো কিছু নেই।
কাল রাত থেকে বড় ছেলেটার খুব জ্বর। ও ফণীর ছেলে নয় ফণী জানে,তবুও ছেলে মেয়ে গুলোর ' বাবা ' ডাক শুনতে শুনতে ফণীর ওদের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। তাই সারা রাত ছেলেটার মাথায় জলপটি দিয়ে, সকাল বেলা মঞ্জুকে ডাকতে গিয়েছিল। কানুতাঁতীর প্রাসাদতুল্য বাড়ীতে দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে বা ডেকে ডেকেও কোন সাড়াশব্দ পায় না ফণী। তাই বাড়ীর পিছন দিকে গিয়ে কাউকে ডাকা যায় কিনা দেখতে ঢুকেছিল।একটা ঘরে তখনও আলো জ্বলছে আর জানালা খোলা দেখে ফণী এগিয়ে গিয়েছিল। খোলা জানালা দিয়ে দেখে কানু আর মঞ্জু উদম শরীরে সঙ্গমে লিপ্ত। এই দৃশ্য দেখে ফণী নিজেই কেমন ভয় পেয়ে যায়। তার নিজের বউয়ের সাথ অপর লোককে সঙ্গমরত দেখে ফেলে ফণীর রাগের বদলে কেমন ভয় পেয়ে গেল। সে কোন ক্রমে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলতে পারল--- " বড় খোকার সারারাত খুব জ্বর। জলপটী দিয়েও কমছে না"। জানালার সামনে ফণীকে দেখে কানু ল্যংটো অবস্থায় ই ছুটে এলো----" শুয়ারের বাচ্ছা অন্যর বাড়ীর জানালায় উঁকি দিয়ে দেখা? সাহস তো কম নয়। রান্ডীর বাচ্চা তোকে আজ জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো।" বলে উত্তেজনার বশে দরজা খুলে বেরিয়েই দেখে তার বউ ঘরের সামনে। তাকে দেখে লজ্জায় বা ধরা পড়ার লজ্জায় আবার ঘরে ঢুকে লুঙ্গি পড়ে নেয়। মঞ্জু জানে, ফণী সব কিছু জানে তবুও এমন সঙ্গমরত অবস্থায় একটু লজ্জা, একটু অস্বস্তি, হয় বইকি। কাপড়টা জাড়ানোর চেষ্টার মাঝে,কানুর বউ ঘরে ঢুকে আসে আাধল্যাংটো মঞ্জুকে বাটাম দিয়ে ভীষণ মার মারে। কানুর অন্যায় বোধ যে হারিয়ে গেছে তা নয়,আবার তারই আদরের মঞ্জু কে মারবে তারই সামনে তাতে পৌরুষেও কোথাও লাগে। নিজের অন্যায়কে চাপা দিতেও অন্তত বউকে শাসন করা দরকার। তাই নিজের বৌকেও দুটো চড়- চাপটা মারে। কানুর বৌ চেঁচায় ওই খানকিটার জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে। এর ফাঁকে মঞ্জু জামাকাপড় পরে বেরিয়ে যায়।
ফণী তার অসমর্থ শরীরে এতটা ছুটে এসে ভাস্করের বারান্দায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। ভাবছিলো তার জীবনে আর কি আছে।তার আর থাকাই কি, না থাকাই কি? ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল ফণী।
হঠাৎ একটা লাঠি নিয়ে দৌড়ে এসে ফণীর ওপর সপাটে বসিয়ে দেয় মঞ্জু। নিরীহ অশক্ত ফণীর ওপর মঞ্জুর আক্রমনের কারণ বিশ্লষণ ভগবানের অসাধ্য। তার বিবাহিত স্বামী, তাকে অবাঞ্ছিত অবস্থায় দেখে ফেলার লজ্জাটা ঢাকতে, কি রাগ দেখানো এটা?নাকি তার উপপতি রাগটাকে কি তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে? নাকি লোকের সামনে মারধোর করে প্রমান করতে চাওয়া ফণীই দোষী। বোঝা খুব মুশকিল মঞ্জুর এই ব্যবহার।
ইতিমধ্যে গ্রামের অনেক লোক জমে গেছে ডাক্তারখানার সামনে। মঞ্জুর চেঁচামেচি তখনও চলছে, তবে ফণীকে মারধোর টা বন্ধ হয়েছে। ফণীর শরীরে কয়েক জায়গায় কেটেকুটে গেছে।
ফণী নিতাইকে বলে আমি এর বিচার চাই।তোমাদের বিচার করতে হবে। কিন্তু নিতাই স্বামী-স্ত্রী র মধ্যে ঝগড়ার কি আর বিচার করবে। এ ধরণের বিচার হওয়াও বোধহয় এখানে উচিত নয়। এর জন্য কোর্ট আছে, আইন আছে। তবু ফণীর চাপাচুপিতে বলে---- ফণীদা, তোমাদের ঝগড়ায় বিচার কি করে হবে বলো তো। তবুও বলছি, আমার অশৌচ চলছে তুমি জানো।তোমার অভিযোগ গজেন্দ্রবাবু, গনেনবাবু, ভাস্করবাবু, ধীরেন বাবুকে বলো। ওরা মনে করলে তোমার অভিযোগের বিচার করবে।
ফণী, ভাস্কর ডাক্তারের কাছ থেকে বড় ছেলের জন্য ওষুধ নিয়ে বাড়ী ফিরে যায়। তারপর ঘুরে ঘুরে গাঁয়ের মুরুব্বিদের সকলের কাছে অভিযোগ জানায়।মহাপ্রভুতলায় বিচার সভা বসাতে বলে। মঞ্জু কিন্তু কানুর বাড়ীই ফিরে গেল,ছেলেটা অসুস্থ জেনেও একবার দেখতে গেলো ন। কানুর বাড়ীর সকালের ঝগড়ার উত্তাল আগুন সময়ের সাথে খানিক কমে এলেও কিন্তু তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকলো। কানুর বউ বাড়ীর প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে চুপ করে বসে রইলো, প্রথম দিকে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল, কিছুক্ষণ পরে কান্নাও তাকে ছেড়ে গেলো। কানু একবার মুখ বাড়ীয়ে দেখে বলে যায় বাড়ীর কাজকর্ম আছে নাকি, চুপ করে বসে থাকলেই চলবে? এ বাড়ীতে এখন থেকে মঞ্জুর কথাতেই চলবে।কান খুলে শুনে নাও। না পোষালে বাপের বাড়ী চলে যাও।
সন্ধ্যেবেলা মহাপ্রভুতলায় আলো জ্বেলে শতরঞ্জি বিছিয়ে বিচারসভা বসেছে। এই বিচারে কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে প্রচুর লোক এসেছে।মুরুব্বিরা সবাই এলেও কানুতাঁতী আসে নি।কারন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হলেও কানুর কথা তো আসবেই। নানা খারাপ কথা শুনতে ভালো লাগবে না।
মুরুব্বিরা প্রথমে অভিযোগকারী হিসাবে ফণীকে সব বলতে বলে। ফণী বড় ছেলের প্রচন্ড জ্বর, জলপটি দেওয়া, ডাকতে যাওয়া, বাড়ীর সামনে দিয়ে ডেকে সাড়া না পাওয়া, পিছন দিয়ে ডাকতে গিয়ে, কানু ও মঞ্জুকে উদম সঙ্গমরত দেখা৷ সব বর্ণনা করে। তারপর মঞ্জুর ফণীকে অকারণ মারার কথা বলে। এরপর সকলে মঞ্জুর কি বলার আছে জিজ্ঞেস করে। মঞ্জু আমতা আমতা করে। এসময় মহাপ্রভুতলার পিছনের আকাশে আগুনের শিখা দেখা যায় , আগুন- আগুন শব্দ ভেসে আসে। কানু আশপাশেই অন্ধকারে ঘোরা ফেরা করছিল কথাবার্তা শোনার জন্য। সে বুঝতে পারে তার বাড়ীর দিক থেকেই আগুনের শিখাটা আসছে। দেখে সে ছুটে যেতে গিয়েও থেমে যায়, নিশ্চয় বউ গায়ে আগুন দিয়েছে। যা হবার আগে হয়ে যাক। না হলে দোষ তার নামে আসতে পারে। বাড়ীতে ছেলে মেয়েরা অন্তত বলবে কানু বাড়ী ছিল না। সভা ভেঙে সকলে দৌড়ালো কানুতাঁতীর বাড়ী। সেখনে উঠোনে খড়ের পালুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে কানুর বউ মাথায় কেরোসিন ঢেলে, গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।সদর দরজা ভেঙে সকলে বাড়ীতে ঢুকে দেখে কানুর বউ পোড়া কালো কাঠর মত দাঁড়িয়ে। কালো রঙের ভিতর থেকে তার জ্যান্ত চোখ গুলো শুধু জ্বলজ্বল করে। পিছনে দাউদাউ করে খড়ের গাদা জ্বলছে।
( চলবে )