Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

স্মৃতিচারণ -- অমৃত মাইতি

স্মৃতিচারণ (১৬) অমৃত মাইতি#বরিশালের মাটি সাহিত্যে ও সমাজ চেতনায় উর্বর#অনেকদিনের লক্ষ্য ছিল বরিশাল। কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এত কাজ করছি অথচ বরিশালের মাটি ছুঁয়ে আসতে পারিনি। দীর্ঘদিন থেকে ব্যাকুল হয়েউঠছিলাম কিভাবে যাব বরিশাল। …

 


স্মৃতিচারণ (১৬) অমৃত মাইতি

#বরিশালের মাটি সাহিত্যে ও সমাজ চেতনায় উর্বর#

অনেকদিনের লক্ষ্য ছিল বরিশাল। কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এত কাজ করছি অথচ বরিশালের মাটি ছুঁয়ে আসতে পারিনি। দীর্ঘদিন থেকে ব্যাকুল হয়ে

উঠছিলাম কিভাবে যাব বরিশাল। কোন কারণে যদি যেতে না পারি তাহলে একটা বড় ধরনের আফশোস

থেকে যাবে জীবনে। নিজের কাছে নিজেই কৈফিয়ৎ দিতে পারব না। ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশাল পুরো এক রাত্রির জলপথে যাত্রা। বরিশালের কৃতি সন্তান অমৃতলাল দে কলেজের অধ্যক্ষ তপঙ্কর চক্রবর্তী

আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু কবি অসীম সাহা আমাকে বললে বরিশালে বিভাগীয় বই মেলা হবে তোমাকে আমি নিয়ে যাব অতিথি হিসেবে। তোমার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা মিটবে। যাইহোক যাওয়া হবে এটাই আনন্দ । শুধু সময়ের অপেক্ষা।

    বাংলার কাব্যজগৎকে জীবনানন্দ আলোড়িত করেছেন। তাঁর জন্মভূমিকে একবার ছুঁয়ে আসতে না পারলে সাহিত্য জীবন পূর্ণাঙ্গ লাভ করে না। বাংলা সাহিত্যের তিনি এক বিশাল আকাশ। তাঁর কাব্য সম্ভার যেন বোধের পরেও আরো গভীর বোধ, চেতনার পরে আরও সূক্ষ্ম চেতনা। তাঁর সৃষ্টির সাম্রাজ্য পরিমাপ করা অত সহজ নয়।তাঁর কবিতার অজস্র স্রোতধারা। সেই স্রোতধারার শত শত উৎসমুখ। বরিশাল সাহিত্য ও সমাজ চেতনার উর্বর মাটি। বরিশালের দুটি পত্রিকা "ব্রহ্মবাদী" এবং "তরুণ"। সত্যানন্দ দাশের সম্পাদনায় "ব্রহ্মবাদী" পত্রিকাতে কলম ধরেছিলেন জীবনানন্দ দাশ কুসুমকুমারী দাশ অশ্বিনী কুমার দত্ত কামিনী রায় সত্যানন্দ দাশ স্নেহলতা দাস প্রমূখ। পত্রিকাটির আয়ু ছিল ৪০ বছর।"তরুণ" পত্রিকায় কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুকুন্দ দাস অশ্বিনীকুমার দত্ত কাজী নজরুল ইসলাম বুদ্ধদেব বসু বিপিনচন্দ্র পাল প্রিয়ংবদা দেবী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কামিনী রায় প্রমূখ।

      বরিশাল বহু বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। আমাদের সকলেরই পরিচিত বিপ্লবী প্রজ্ঞানন্দ সরস্বতী। বরিশালের মানুষ।তিনি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজ তাকে বরিশাল থেকে বহিষ্কৃত করে। তিনি এসে উপস্থিত হলেন মহিষাদলে। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা প্রজ্ঞানন্দ সরস্বতীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন সকলেই।

তাই বরিশালের মাটি স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল বহুদিনের। অবশেষে কবি অসীম সাহার সঙ্গে জল পথে যাত্রা করলাম বরিশালের উদ্দেশ্যে। আমাদের নিয়ে যাবে,"সাঁঝের নিহার নীল সমুদ্র মথিয়া"। জলযানটির কেবিনের বাইরে আকাশের দিকে অন্ধকারের মোহিনী মায়ায় নক্ষত্র তাকিয়ে আছে,"নিষ্পলক যুগ্ম ভুরু তুলে/চেয়ে আছে অনাগত উদধীর কূলে/মেঘ রক্ত, ময়ূখের পানে/জ্বলিয়া  যেতেছে নিত্য নিশি অবসানে/নতুন ভাস্কর"। জলযানটি ছুটে চলেছে বরিশাল অভিমুখ। সারারাত বুড়ি গঙ্গার এপার ওপার দেখতে দেখতে, রাত্রির মহিমা পর্যবেক্ষণ করতে করতে কখন কেটে গেল নির্ঘুম রাত। ভোরে পৌঁছে গেলাম বরিশাল "শরীরে জলের গন্ধ মেখে"। আমি যেন আনন্দে আত্মহারা কি একটা আবিষ্কার করে ফেলেছি। সাধের ও সাধনার বরিশাল। ২০১৪ সালের মে মাস। তপ্ত দিনের ইতিহাস। ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে আসলাম সানী শাহাদাত হোসেন নিপু এবং ফিরদাউসী কুইন।

গেস্ট হাউসে তখন অপেক্ষা করছে আমার জন্য  তপঙ্কর চক্রবর্তী। হাতে তার একটি জীবনানন্দ দাশের নামাঙ্কিত স্মারক,যা ওখানকার জীবনানন্দ মেলায় আমাকে দেওয়ার কথা ছিল। সময় নষ্ট না করে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম বরিশাল ভ্রমণের জন্য। শুধু দেখা দেখা আর চোখ ভরে দেখা আর মনের মধ্যে স্মৃতি সঞ্চয় করা। তাঁর ভিটে মাটির সামনে তখনও গেটে লেখা আছে"ধানসিঁড়ি'।

কে বলে জীবনানন্দ নাই এখানে। তিনি বাঙালি হৃদয়ে তৃষ্ণা স্বপ্ন ও বাস্তব। তিনি যেন বলছেন,"তোমরা চলিয়া এস/তোমরা চলিয়া এস সব।/ভুলে যাও পৃথিবীর এই ব্যথা - আঘাত - বাস্তব'।

  দুজন মনের স্বাদ মিটিয়ে ঘুরলাম। বিকেলে বিভাগীয় বই মেলা। সভাপতি কবি অসীম সাহা। উদ্বোধক তৎকালীন বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সৌভাগ্যবশত আমি সেই বইমেলায় একজন অতিথি।

যথারীতি রাতে ফিরলাম বৃহৎ আকারের জলযানটিতে। সারাদিন জীবনানন্দীয় এক ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিলাম।"ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব - ধীরে ধীরে পৌষের রাতে - কোনদিন জাগব না আর /কোনদিন জাগব না আমি কোনদিন আর"। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরছি; ফিরে আসতে হবে তাই। "চোখ আর চায় না ঘুমাতে"/জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে"। কখন কেটে গেছে রাত। ঢাকার উপকণ্ঠে বুড়িগঙ্গায় সদরঘাটে তখন ঝড়ের দাপাদাপি। নোঙ্গর ফেলার সময় হয়েছে এখন।

তৃষিত হৃদয়ে বিয়োগব্যথা। এক করুন আনন্দঘন হৃদয়।




স্মৃতিচারণ (১৭)অমৃত মাইতি

#ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্মদিন#

আমার কাছে একটি অভাবনীয় ঘটনা ২০০৮ সালে আমার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রায় প্রথম সারির লেখক বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি সাধারণত ১৩ মার্চ কোন প্রোগ্রাম করি না। কারণ সাহিত্যের জগতের বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এত গভীর তারা ওই দিনটি আমাকে নিয়ে কোননা কোন অনুষ্ঠান করেন।

১৩ মার্চ আমার জন্মদিন। ভালোবাসা এতটাই গভীর ওই দিনটিতে লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও কবি সাহিত্যিক বন্ধুরা আমাকে নিয়ে একটু সময় বেশি করে কাটাতে চান নানান রকমের সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে। কলকাতাতে প্রথম শ্যামল কান্তি জানা দীপ মুখোপাধ্যায় আশিস গিরি প্রদীপ আচার্য অপূর্ব দত্ত ও অন্য বন্ধুরা আমার ৬০তম জন্মদিন পালন করেন বিপুল সমারোহে। তারপর থেকে প্রতিবছর এই দিনটি সকলে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রয়াস চালু করে। মিথ্যা কথা বলবো না বা রেখে ঢেকে বলছি না

আমার কিন্তু ভালো লাগতো। এই যে মিলন এটাই আনন্দের ছিল আমার কাছে। ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে থেকে বছরে একটা দিন একটু ভিন্ন ভাবে থাকা আমার কাছে অক্সিজেনের সমান। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে আমারও আগ্রহ কম ছিল না। হঠাৎ একদিন আসলাম সানী ও সৈয়দ আজিজ আমাকে টেলিফোন করল এবার আমরা তোমার জন্মদিন পালন করব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সিতে।

শুনে তো আমি অবাক। কিন্তু আমার কর্মসূচি সাজানো ছিল শুধু একদিন অর্থাৎ ১৩ ই মার্চ ফাঁকা ছিল। আমি পুলকিত হয়েছিলাম এই আমন্ত্রণে । বললাম শুধু একদিনের জন্যই যাব। কারণ আমার হাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ১৩ ই মার্চ সকাল আটটায় ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। আমাকে নিয়ে গেল সৈয়দ আজিজ তার বাড়ি উত্তরাতে। ২০০৮ সাল থেকে আমার একটি স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল আজিজের বাড়ি। আজিজ বললে বাংলাদেশে এলে তুমি আমার বাড়িতে থাকবে। অনেক বছর এটাই ছিল আমার স্থায়ী ঠিকানা। কারণ আজিজের গাড়ি আছে নিজস্ব এবং যেকোনো সময় যে কোন জায়গায় যাতায়াতের আমার কোন সমস্যা নেই। হ্যাঁ ঠিক বিকাল তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গিয়ে দেখি প্রায় লম্বা ১৫ ফিট কয়েকটা ব্যানার বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে। সেখানে লেখা আছে কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক অমৃত মাইতির জন্মোৎসব। অনুষ্ঠানটা আমি চেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এভাবে প্রচারটা আমি চাইনি। নিজেরই কেমন লজ্জা লাগছিল। কিন্তু বাংলাদেশী ভাষাপ্রেমী বন্ধুরা তো ওদের মতো করে আমাকে নিয়ে ভাবছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না ,বাংলাদেশী বন্ধুদের আমি খুব মন জয় করতে সক্ষম হয়েছি। সেদিন ওরা ওদের মতো করে আমাকে নিয়ে মেতে গেল। জন্মদিনের গান কেক কাটা উপহার সামগ্রী বই পত্র এত দিলেন আমাকে, আমি ঢাকা পড়ে গেছি। রাত্রি নটা পর্যন্ত যেন অনুষ্ঠান শেষ হয় না, কেউ কাউকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে পারছে না। পরস্পরের সঙ্গে অন্তরে অন্তর মিশে গেছে।আমি সেদিনের সেই মুহূর্তটি জীবনে কোনদিন ভুলবো না। আমাকে নিয়ে একটি দৈনিক কাগজে বিস্তৃত ভাবে লিখেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ গোপ।"অমৃত মাইতির কবিতায় মাটির গন্ধ" আমাকে নিয়ে কবিতা গান আড্ডা যেন শেষ হতে চায় না। শিল্পী ও ছড়া লেখক গোলাম নবী পান্না আমার একটি সুন্দর স্কেচ এঁকেছিলেন। এবং সেই স্কেচটি খবরে কাগজে ছিল। একে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন পালনের সৌভাগ্য, পাশাপাশি পত্র পত্রিকাতে আমাকে নিয়ে লেখা। কাউকে ভালবাসলে যে এভাবেই ভালোবাসা যায়, আমি বাংলাদেশী বন্ধুদের কাছে শিখেছি। সেদিন উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উপস্থিত ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ আসাদ চৌধুরী সমুদ্র গুপ্ত রবীন্দ্র গোপ আরো গুণী মানুষজন। সভাকক্ষ উপচে পড়েছিল। মার্চ মাসে বাংলাদেশে গেলেই আমাকে নিয়ে জন্মদিন পালন করবেই বন্ধুরা। একবার টাঙ্গাইলে সাহিত্য সম্মেলনের ঘটনা।

সেদিন ১৩ ই মার্চের আগে ৩ মার্চ । ১৩ তারিখের আগেই আমাকে জন্মদিনের উপহার তাঁরা দিয়েছিলেন। আমার হাতে এক বিশাল মাপের ফুলের তোড়া তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক এবং মাহমুদ কামাল। এমন বহুবার আমাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন জন্মদিনকে কেন্দ্র করে। তাদের এই অন্তরের টান আমি কোনদিন উপেক্ষা করতে পারিনি। যখনই কোন মানসিক অশান্তি হয়েছে ছুটে গেছি যেন আমার অফুরন্ত অক্সিজেনের ভান্ডার বাংলাদেশ।

ঢাকায় জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসবে আমি ২০০৫ সাল থেকে টানা ১১ বছর আমন্ত্রিত ছিলাম। বিপ্লবের মাটি চট্টগ্রাম গিয়েছি আমি ৪ বার। টাঙ্গাইল গিয়েছি মোট আটবার। ময়মনসিংহ গেছি চারবার। সোনারগাঁও গিয়েছি আমি তিনবার। ২০১৩ সালে সেখানকার একটি সেমিনারে আমি ছিলাম প্রধান আলোচক। বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল সোনারগাঁয়ের অনুষ্ঠানে অন্য একটি বছরে। এভাবে অজস্র স্মৃতি আমাকে জাগিয়ে রাখে প্রাণবন্ত করে।



স্মৃতিচারণ (১৮) অমৃত মাইতি

#কানাডা ও একুশে ফেব্রুয়ারি#

১৮ জানুয়ারি ২০১৯ জীবনের একটি অমূল্য স্মৃতি।

আমার অভ্যেস ঘুম থেকে উঠে ইমেইল সার্চ করা।

অবাক কান্ড। কানাডার মন্ট্রিয়েল থেকে চিঠি এসেছে

একুশের বইমেলায় আমন্ত্রণ। আমন্ত্রণ জানিয়েছে কানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটির পক্ষ থেকে। এমন একটা চিঠি পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এত দূরে!

আকাশ পথে ২২ঘন্টা সময় লাগে। গোটা দেশটা বরফে ঢাকা। যাওয়ার কথা ভাবলে রোমাঞ্চিত হতে হয় আবার ভয়ে কুঁকড়ে যাই। ঘনিষ্ঠজনেরা সকলেই বারবার বলছে, আপনাকে যেতেই হবে। এমন চিঠি, সবাই পায় না। আমরা গর্বিত। যত কষ্ট হোক যত অসুবিধা থাক আপনাকে যেতেই হবে। চিঠিটা পড়ছি তারপর মেসেঞ্জারে ফোন করলো জিয়াউল হক জিয়া। কি সুন্দর কথা"দাদা কেমন আছেন?"ভাবতে অবাক লাগে যেন কবেকার আপনজন খোঁজ নিচ্ছে আমার।

আসতেই হবে আপনাকে ।আমাদের এবার সপ্তম বইমেলা। আপনাকে আমরা একুশের পদক দেব।এই প্রথম আমরা ভারতকে আমন্ত্রণ করলাম। আপনার জন্য কর্মসূচি তৈরি করেছি। আপনার ভিসা পাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না সমস্ত রকমের কাগজপত্র ।।আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। জিয়ার স্ত্রী শামসাদ রানা বললে আপনার খাওয়া থাকার কোন রকম অসুবিধা হবে না। আপনার কি খাওয়ার পছন্দ বলবেন, আমি আপনার বোন এখানে আছি চিন্তা করবেন না। সব সময় মনে করবেন বাড়িতে আছি। আমার সমস্যা হল আমার ব্লাড সুগার এবং ব্লাড প্রেসার ৩২ বছর হয়ে গেল। প্রস্টেডের সমস্যা। লিভার ট্রাবলে বেগ পেতে হয়। ক্যান্সার ছাড়া সবকিছুই আছে। একা এত লগেজ

নিয়ে যাব কি করে! যাই হোক ভেবে ভেবে ভিসা করতে দিলাম। কানাডার ভিসার অফিস দিল্লিতে। কলকাতায় একটি ডকুমেন্টস রিসিভ করার অফিস আছে। সেখানে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ভাবছিলাম যদি ভিসা পেতে দেরি হয় তাহলে যাওয়া হবে না। আপাতত একটা কৈফিয়ৎ। কিন্তু মাত্র সাত দিনে আমার ভিসা চলে এলো। আমি চেয়েছিলাম ১০ দিনের ভিসা। রাত্রিতে পাসপোর্ট খুলে দেখি আমাকে ভিসা দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের। যাই হোক ভয় ও রোমাঞ্চ আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। রাত্রি ৩ টা ১৫ ফ্লাইট দমদমে। আরব সাগরের তীরে দোহা পৌঁছলাম আর সাগর থেকে লাফিয়ে উঠলো লাল সূর্য। বিদেশ বিভূঁয়ে আমি যে একাকী সেসব মনে হয় না। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ আর অপার সৌন্দর্য ।আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দোহার এয়ারপোর্ট দেখে অবাক হয়ে গেলাম।মনে হল দিল্লির এয়ারপোর্ট ভিখারিদের জন্য। এয়ারপোর্ট এর প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম কাজকর্ম সেরে নির্ধারিত বিমানে উঠতে হলো। দমদম থেকে দোহা ৬ ঘন্টা। ইতিমধ্যে চার ঘন্টা সময় পিছিয়ে গেছি। কারণ দোহাতে যখন নামলাম সেখানকার ঘড়ি অনুযায়ী ভোর ছয়টা। এবার আমাকে মন্ট্রিয়েল বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে হবে টানা ১৪ ঘন্টা। নির্বান্ধব একাকী আকাশে কাটিয়ে দিলাম শুধু সামনের স্ক্রিনে দেখছি বিমানের গতিপথ। এক বিশাল মাপের এয়ারপোর্ট। নানান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে সময় লাগলো বেশ কিছুটা সময়। বিমান থেকে নেমেই জিয়াকে টেলিফোন করলাম। দাদা আমি আসছি। বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম। যেদিকে তাকাই সেদিকে শুধু সাদা সাদা বরফ ।আর কিছু দেখা যায় না। একটি বড় ফুলের তোড়া নিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে জিয়া। কোথায় আমার জন্মভূমি আর কোথায় গিয়ে মানুষের ঘনিষ্ঠতা ও উষ্ম আলিঙ্গন। ধন্যবাদ জানালাম বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে।


আমি এতিনের ভক্ত বলেই আজকে আমি এই সুযোগ পেয়েছি। ছুটে চলল বরফের উপর দিয়ে জিয়া ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে লাইভ করতে করতে ।এক হাতে স্টিয়ারিং ধরেছে সে। আমাকে নিয়ে চলল একটি বড় বাংলো বাড়িতে। উপরের তলাতে তিনটি ঘর ডাইনিং বাথরুম। আমি একা। বারান্দায় এক ফুট উঁচু বরফ। যত ঘর বাড়ি দেখছি সব বরফে ঢাকা। বাংলোতে ঢোকার সময় দেখলাম বরফ কেটে এক ফালি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। জিয়া চলে গেল আমার জন্য তার বাড়ি থেকে রানার হাতে তৈরি করা খাওয়ার আনতে। তাছাড়া জিয়াউল হক জিয়ার অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ততা তো ছিলই। রাত্রিতে একা থাকলাম ।নিচে লক করা আছে দরজা। বাড়িতে দরজা ভেতর থেকে লাগাই না ভয়ে। ভয়ডর কোথায় চলে গেছে, একাকী পৃথিবীর উল্টোপাশে রাত্রি কাটাচ্ছি কিছুই মনে হল না। আমার পৌঁছানোর আগে সেখানকার কাগজে আমাকে নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে সেসব দেখলাম। কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেসেঞ্জারে আমাকে ফোন করছে অনেকে। আমি যে শেষমেষ কানাডায় পৌঁছেছি তাতেই তারা খুশি। পরের দিন নির্ধারিত সময়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। প্রায় সাত আটশত মানুষ হলের মধ্যে জড়ো হয়েছে। শতাধিক বইয়ের স্টল। পিঠে পুলি নানান রকমের খাবার নিয়ে বসে গেছে বোনেরা। আমার জন্য একটি "অক্ষরকর্মী" ব্যানার তৈরি করে দিল সকলে মিলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন। এমন একটা আন্তর্জাতিক বইমেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকতে পারার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ,এর চাইতে বড় স্মৃতি আর কি হতে পারে! কিছু আলোচনা এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে আমাকে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের একমাত্র আমি প্রতিনিধি। একুশের পদক দেওয়া হলো আমাকে। নিজেকে গর্বিত মনে করলাম। হয়তো অতটা যোগ্য নই। তবু ও ব্যক্তিমানুষের অনুভূতি ভালোলাগাকে অস্বীকার করা যায় না। পরের দিন ভয়ংকর বরফের ঝড় বইছে গোটা কানাডাতে। টরেন্টো থেকে শুধু আমার সাথে দেখা করার জন্য ছয় ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এসেছিল। কিছু উপহার আর একটা হাতঘড়ি দিল আমাকে দুলাল ।২০০৩সাল থেকে তার সাথে আমার সখ্যতা। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে 

হল ভর্তি পাঠক পাঠিকা অনুরাগী বুকসেলার্স সকলে উপস্থিত। আমি বক্তৃতা দিচ্ছি বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিয়ানার উপর। মন্ত্রমুগ্ধের মত সকলে বসে শুনছেন ।কোন শব্দ নেই হলের মধ্যে। বক্তৃতা শেষ হলো ছবি তোলার ভিড়। ছোটরা এসে প্রণাম করলো বড়রা জড়িয়ে ধরল। একটি কম বয়স্ক দম্পতি প্রনাম করে বললে ,মামা ভালো আছেন। কোন কষ্ট হয়নি তো আপনার? আমি অবাক হয়ে তাকালাম তাদের দিকে। তারা বললে আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহ। আমার মায়ের নাম সালমা বেগ। মা আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। কোথায় থাকো তোমরা? কুইবেক শহরে। এই ঝড়ের মধ্যে এসেছো তোমরা। ভালো লাগলো । খুশি হলাম। তোমরা কি ফিরে যাবে? আপনার বক্তৃতা শুনছিলাম খুব ভালো লাগছিল। সেই রাতে ওরা কুইবেক ফিরে গেল। তারপর গেলাম শামসাদ রানা ডেকেছিল বাড়িতে। যে কথাটি না বললে নয় তা হল ঠান্ডায় পা কনকন করছে।রানা বুঝতে পেরে পায়ের কাছে হিটারটা বসিয়ে দিয়ে চলে গেল আমার জন্য টিফিন তৈরি করতে। এই অন্তরঙ্গতা এই ভালোবাসা এভাবে আপন করে নেওয়া আমি খুব কম দেখেছি। আমি এত দূরে আছি, ওরা বুঝতেই দেয়নি। রাত্রে খেলাম ডালের ভর্তা আর মুরগির মাংস। তারপর বিভিন্ন বাড়িতে পরপর দুদিন শুধু নেমন্তন্ন।

কানাডার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটির সমস্ত বন্ধুদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।

(চলবে)