Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

স্মৃতিচারণ - অমৃত মাইতি

স্মৃতিচারণ (৭ ) অমৃত মাইতি#পার্টির নির্দেশ অবনতমস্তকে মেনেছি#পার্টির নির্দেশ যতই কঠিন হোক একজন পার্টি সভ্যকে মান্যতা দিতেই হবে। এখানে ভেবে দেখা বা বিকল্প কিছু প্রস্তাব রাখা, পার্টির নির্দেশকে অসম্মান করার সামিল। নির্দেশকে অমান্য …

 


স্মৃতিচারণ (৭ ) অমৃত মাইতি

#পার্টির নির্দেশ অবনতমস্তকে মেনেছি#

পার্টির নির্দেশ যতই কঠিন হোক একজন পার্টি সভ্যকে মান্যতা দিতেই হবে। এখানে ভেবে দেখা বা বিকল্প কিছু প্রস্তাব রাখা, পার্টির নির্দেশকে অসম্মান করার সামিল। নির্দেশকে অমান্য করলে পার্টির সভ্যপদ থাকতে পারে না। পার্টির নির্দেশ বিনা ওজরে আপত্তিতে মেনে নেব এটাই ছিল অঙ্গীকার পত্রের ঘোষণা। আজকাল এসব কেউ মানে না ।পার্টির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই পার্টির নির্দেশ অমান্য করে। পার্টিতে কোন অনুশাসন নেই ।যে যার মত চলে। নিজের পছন্দমত যদি সিদ্ধান্ত না হয় তাহলে মান্যতা দেব না ।প্রয়োজন হলে বিদ্রোহ করা, উপদল সৃষ্টি করা, এখন অধিকারে পরিণত হয়েছে। একটা কথা প্রচলন আছে, বাচ্চার চেয়ে তার বিষ্ঠার ওজন যদি বেশি হয় তাহলে সেই বাচ্চা বাঁচে না। আপনার ত্যাগ আপনার কষ্ট যন্ত্রণা সব কিন্তু পার্টি কেন্দ্রিক। পার্টির সমৃদ্ধির জন্য আপনি যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তখন কিছু অপদার্থ কর্মীর ক্রোধ তৈরি হয়। তাদের রোষানলে পড়তে  হবে আপনাকে। আপনাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করবে। আপনার নিজের হাতে তৈরি করা বাগান লন্ডভন্ড করে দেবে চোখের সামনে আপনি দেখবেন ,চোখের জল ফেলবেন। বুকে যন্ত্রণা চেপে সেই স্থান ত্যাগ করতে হবে। ওদের উল্লাস ক্রমাগত বাড়বে। খুনির অনুশোচনা হয় না। খুন করে রক্তমাখা  হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে মাংস ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে ঘুমোতে পারে ওরা। চোখের সামনে দেখেছি কেউ সৃষ্টির জন্য পাগল ;কেউবা ধ্বংসের জন্য মরিয়া।

     আমি গর্বিত। আমাকে পার্টির উচ্চতর নেতৃত্ব যে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমি বিনা আপত্তিতে মহানন্দে  সেই নির্দেশকে মান্যতা দিয়েছি।কোন প্রশ্ন উচ্চারণ করিনি। টাকা নেই পয়সা নেই থাকার জায়গা নেই বেরিয়ে পড়েছি উড়িষ্যার পথে পার্টির নির্দেশে। কমরেড নিখিল দাস তখন রাজ্য সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য। তিনি আমাকে বললেন তুমি মেদিনীপুরে সাংগঠনিক কাজকর্ম অনেকটাই করতে পেরেছো। তোমার উপর পার্টির ভরসা আছে। তুমি দেখো উড়িষ্যাতে দলের ঝান্ডা তুলতে পারো কিনা। আমি মনে মনে গর্ব অনুভব করলাম ,দল আমাকে এমন একটা সুযোগ দিয়েছে।

সকলের মধ্যে এই উপলব্ধি হয়তো নেই কিন্তু আমি ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। কারণ উড়িষ্যাতে আমাদের একটিও লোক তখন ছিল না, দল তো দূরের কথা। একজন সংযোগকারীকে পেয়ে গেলাম। বিমান সাউ অনেক বছর উড়িষ্যাতেই আছে। সে চিরকালই এলোমেলো অগোছালো লোক। জগৎসিমপুর কেন্দ্রপাড়া তুঁতিয়াপাল এলাকায় তার পিতৃপুরুষের সময় থেকে জমিজায়গা আছে। বিমান বহুদিন থেকে আমাকে তার ওড়িশার পরিচিত এলাকাতে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। মেদিনীপুরের দক্ষিণাংশের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এলাকার বহু মানুষ বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। আমিও বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে দেখেছি আমারই পরিচিত বহু মানুষ সেখানে আছে। কিন্তু তারা সাহস করে সকলে আমাদের সঙ্গে দল করতে চাইলো না। যে যার নিজেদের মতো ঘরবাড়ি বংশবিস্তার করছে। যাই হোক আমি কিন্তু সাধ্যমত চেষ্টা করব পিছিয়ে আসবো না নিজের কাছে আমার অঙ্গীকার। কত লোকের বাড়িতে উঠোনে কখনো হাটচালাতে রাত কাটিয়েছি।

ঝড় জলের রাতে দুর্গন্ধ আঁশটে গন্ধ মাছের আড়তে থেকেছি। ধীরে ধীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল ,ফলে পারাদ্বীপ পোর্ট এলাকাতে কাজ শুরু করি এবং একটু স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার সুযোগ পাই ।আন্তর্জাতিক নেহেরু গেস্ট হাউসে বঙ্গোপসাগরের প্রায় উপরেই। ওখানকার পি আর ও এবং কর্মচারীরা আমি পশ্চিমবাংলা থেকে গিয়েছি সাংগঠনিক কাজের জন্য এইসব জেনে  আমার প্রতি আতিথিয়তা প্রদর্শন করে। যাই হোক সময় সময় এবং ওড়িশা থেকে কাজ কর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে টেলিফোনে যোগাযোগ করতাম ক্ষিতি গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি বললেন আপনি একটা মিটিং ডাকুন আমি যাব,। ক্ষিতিদা খুবই উৎসাহী মানুষ । একটি প্রকাশ্য মিটিং ডাকলাম তুঁতিয়াপালে। দুজন একটি গাড়িতে যাচ্ছি। বললাম ওই দেখুন ঝান্ডা উঠছে আরএসপির। ক্ষিতিদা যেন গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বেন। আরে অমৃত বাবু কি করেছেন এত দূরে আরএসপির ঝান্ডা উড়ছে :এতো ইতিহাস। লিখতে আনন্দ পাচ্ছি। দু দুবার উড়িষ্যাতে আমরা বিধানসভায় আর এস পি র প্রতীকে লড়াই করেছি। ওখানকার পঞ্চায়েতে লড়াই করেছি। তিন চারটি আসনে জিতেছে। সমস্যায় পড়েছিলাম, পার্টির কোন লিটারেচার সেখানে নেই।ওড়িয়া ভাষাতে প্রথম আমাদের পার্টির বই আমার লেখা "প্রসঙ্গ: আরএসপি ও মার্কসবাদ"। হয়তো বড় কিছু নয় তবু আমার কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ আমি বক্তৃতা দিয়ে চলে আসার পরে, হাতে একটা কিছু না থাকলে সেখানকার কর্মীরা কাজ করবে কি করে? তাই এই উদ্যোগ। বইটি প্রথম ছাপা হয় বাংলাতে ক্রান্তি প্রেস থেকে কলকাতায়। তারপর ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ করে কবি সাহিত্যিক শিক্ষক হেমন্ত রাউত। হেমন্ত আমার বহু কবিতা সেখানকার কাগজে ছাপিয়েছে। তার সঙ্গে প্রতিদিনের আমার যোগাযোগ। একবার ভুবনেশ্বরে একটি সমাবেশ করেছিলাম। চারটি জেলা থেকে প্রায় আড়াইশো তিনশো লোকের উপস্থিতি ছিল। সেই সভাতে তখনকার সর্বভারতীয় ইউ টি ইউ সি'র সাধারণ সম্পাদক সুনীল রঞ্জন সেনগুপ্ত ছিলেন । বিমান সাউ সেখানকার সংগঠক, হেমন্ত রাউত গুরুচরণ বড়াল ও অন্যান্য কমরেডরা উপস্থিত ছিল। আমাদের এখান থেকে কয়জন বন্ধু গিয়েছিল কৌতুহল বসত। ছিল অশ্বিনী জানা ।উৎসাহ নিয়ে থেকে গেল কয়েকদিন।

     এখন ওড়িশার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে লিঙ্গরাজ কর। প্রায় প্রতিদিন আমার সাথে তার যোগাযোগ হয়। 

আর এস পি'র সর্বভারতীয় নেতা প্রয়াত কমরেড অবনী রায় আমার সঙ্গে একবার গিয়েছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন বেরহামপুর স্টেশনের কাছাকাছি পার্টির সদস্যপদ স্ক্রুটিনি করতে। একেবারে অন্ধ্রের বর্ডার। এখন এইসব স্মৃতিচারণ করছি আর লিখছি। লেখা কোন কাজে লাগবে কিনা জানিনা। দলের নির্দেশকে মান্যতা দিতে হয় এটাই শোভন সুন্দর পদ্ধতি।



স্মৃতিচারণ (৮) অমৃত মাইতি

#অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারতাম#

ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।

সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা এবং নিষ্ঠা একজন কর্মীর বড় পরিচয়। স্মৃতিচারণ করব এ সম্পর্কে যা নিজেরই ভালো লাগে। একদিন পশ্চিম মেদিনীপুরের পার্টির জেলা সম্মেলন করলাম আমি ও কমরেড সুকুমার ঘোষ। সম্মেলন শেষ করে রাত্রে থেকেছি মেচেদাতে। খুব ভোরে বেরিয়ে বাংলাদেশ বিমানবন্দরে পৌঁছে গেছি সকাল আটটায়। তারপর সেখান থেকে সোজা চলে গিয়েছি ময়মনসিংহে একটি সাহিত্য বাসরে। তারপর রাত্রি একটার সময় ফিরলাম ঢাকা বিমানবন্দরের পাশে সৈয়দ আজিজের বাড়ি উত্তরাতে। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার গতিবিধি দেখে ভালবাসার বন্ধুরা বলেছেন আপনার পায়ের সরিষা বীজ থাকে? এরকম বহু ঘটনা আছে। স্বল্প পরিসরে সামান্য কিছু উল্লেখ করব।

আমার কর্মসূচি সাজানো থাকতো। কোন কর্মসূচি আমি ফেল করিনি ।অসুস্থ হয়ে পড়িনি। একদিন অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা কমিটির মিটিং করলাম পাঁশকুড়াতে। উপস্থিত ছিলেন ক্ষিতি গোস্বামী। তাঁকে কুকড়াহাটিতে পৌঁছে দিয়ে রাত্রে বাড়ি ফিরলাম। কতটুকু বিশ্রাম করলাম জানিনা। ভোর চারটায় বেরোলাম। বাড়ির সামনে গাড়িতে উঠলাম। ভুবনেশ্বর পৌঁছে গেলাম ঠিক দশটায়। কিছুটা বিশ্রামের পর মিটিং করলাম বিভিন্ন জেলা থেকে যারা এসেছিলেন তাদেরকে নিয়ে। ঠিক সন্ধ্যা ছটায় আবার গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভারকে বিশ্রাম দিতে হয় খাওয়া দাওয়া করতে হয়। ভোর পাঁচটায় বাড়ি পৌছালাম। তখন ন্যাশনাল হাইওয়ে আজকের মত ছিল না। বিশ্রামের সময় নেই। কারণ সকাল সাতটায় তৎকালীন সেচ মন্ত্রী গণেশ মণ্ডলের সঙ্গে নন্দকুমারে আমার দেখা হওয়ার কথা। উনি যাবেন নন্দীগ্রামের পূর্বাংশে নদী ভাঙন দেখতে। ঠিক সময় দেখা হল আমাদের। তারপর হলদিয়াতে চা টিফিনের পরে বেরিয়ে পড়লাম ভুট ভুটিতে নদী ভাঙ্গন দেখা জন্য। ফিরে এসে হলদিয়াতে খাওয়া দাওয়া। সেচ দপ্তরের লোকজনদের নিয়ে গণেশদার মিটিং। রাত্রি ৮ টায় পৌছালাম গেঁওখালিতে। ভাবুন কত ঘন্টা বিরামহীন এত দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করেছি।

একবার মহালয়ার দিন সকালে নিমতৌড়িতে জেলা কমিটির মিটিং করে বাড়ি ফিরছি একটায়। তারপর তিনটি বই ও পত্রিকা উদ্বোধন করেছি মুগবেড়িয়াতে।

এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম কারণ আমি যাব বাংলাদেশ। তখন আমার পকেটে ১০০ টাকাও ছিল না। এভাবেই আমার পকেটের অবস্থা। নিম্নবিত্তের মানুষদের যেমন অবস্থা হয়। এইসব মানুষদের শখ খুব। সমাজের সব কিছুতেই থাকতে চায়। এটা আমার পারিবারিক বাপ ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া। সাহিত্য রাজনীতি সামাজিক কাজকর্ম সর্বত্র থাকা একটা নেশা এবং দায়বদ্ধতা। সাহিত্য বলুন রাজনীতি বলুন যোগাযোগের জন্য জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মঠ চন্ডিপুর। এখানে আমার একটি বাসা ২০০৩ সাল থেকে ছিল। এখানে আমাদের পার্টির সর্বোচ্চ নেতারা এসেছেন ।এমএলএ এমপি মন্ত্রী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এবং সাহিত্যের জগতের দেশ-বিদেশের সাহিত্য সাথীরা আড্ডা দিয়েছেন, থেকেছেন। যার বাড়িতে আমি থাকতাম তার নাম গৌতম দাস। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাকে বললাম ৫০০ টাকা ধার দাও। গৌতম বললে ,আপনি বাংলাদেশ যাবেন যে? আমি বললাম এই টাকাটা টোলগেটে লাগবে। আমার কাছে টিকিট আছে ফ্লাইটের। আমার সুবিধা হল অনেকেই জানেন ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পরে গাড়ি থাকা খাওয়া ভ্রমণ যতদিন আমি থাকি আমার কোন ব্যক্তিগত পয়সা লাগে না। পত্রিকায় লেখা বেরোলে কিংবা কবিতা পাঠের আসরে অংশগ্রহণ করলে আমি টাকা পাই। ফেরার সময় খালি হাতে আসতে হয় না। আমার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে পথে বেরোলে পকেটে পয়সা থাক না থাক কোন টেনশন হয় না। কোন না কোন জায়গায় আমার থাকা খাওয়া ঠিক জুটে যায়। আর জেলার মধ্যে সেসব কোন সমস্যা নেই। সময়কে আমি খুব কাজে লাগাতে পারতাম। পার্টি মেম্বারশিপ স্রুটিনি চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ যেতে হবে দুদিন। সকালে কাজ করেছি বিকালে বেরিয়ে গেছি । দুদিন পরে বাংলাদেশ থেকে ফিরে সোজা কোলাঘাটে এবং মাতঙ্গিনী দুটো ব্লকে মেম্বারশিপ স্ক্রুটিনি করেছি। রাত্রিতে বাড়ি ।পরের দিন পাঁশকুড়ায় কাজ করলাম। আমি এভাবে টানা কাজকর্ম করতাম। অর্থাৎ লেখালেখি সাহিত্যের জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি আমাকে কোনদিন বাতিল করতে হয়নি।

কখনো কোন কাজে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। ফাঁকি দিলে ফাঁকির ফাঁকে পড়ে যেতে হয়। অবিভক্ত মেদিনীপুরে জেলা বামফ্রন্টের সভা সকাল ১০ টায় ডাকা হতো। নন্দীগ্রাম থেকে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে দশটার মধ্যে আমি ঠিক পৌঁছে যেতাম। নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়ানুবর্তিতা সম্পর্কে আমি সবসময় সচেতন থেকেছি অন্যের কাছে নিজেকে খাটো করিনি। দেরি করে গেলে মনে হতো আমি সময়ের দাম দিতে শিখিনি। তমলুকের জেলখানা মোড়ে আমাদের একটি পার্টি অফিস ছিল। সেখানে মিটিং করার পরে কাঁথি হয়ে কুঁদি(এগরা থানা) পার্টি অফিসে পৌঁছে গেলাম ঠিক ছটায়। রাত্রি নটার সময় বেরিয়ে পড়লাম। এই বিষয় উল্লেখ করার কারণ আছে। সারাদিনের ক্লান্তি । হু হু করে বাতাস গাড়িতে ঢুকছে। বাইরে তখন রোমান্টিক চাঁদনী রাত। দূরে দূরে পাড়া। কোথাও কোথাও ঝাউ দেবদারু ইউক্যালিপটাসের সারি।মাঠময় সবুজের কার্পেট। ফাঁকা জায়গাতে ড্রাইভারকে বললাম একটু দাঁড়াও। নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। মনে হলো কারুর কি আসার কথা ছিল এখানে! হয়তোবা আমার দেরী দেখে চলে গেছে সে। তাহলে আমার গাঁথা মালাটা কাকে দিয়ে যাব! এভাবেই সেদিন একটি কবিতার জন্ম হয়েছিল। টুকরো টুকরো শব্দগুলো অন্ধকারের প্যাডে কোনরকমে লিখে রাখলাম। বাড়ি ফিরে কবিতাটি সাজিয়ে নিলাম। ঝাড়গ্রাম আমার বাড়ি থেকে অনেকটা পথ। গাড়িতে বসে বসে যাতায়াতের সময় আমি খুব কবিতা লিখতাম। দীর্ঘ ৫৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আমি যেমন ফাঁকি দিইনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে, ঠিক তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করেছি নিবিড় ভাবে। কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক সাহিত্যের সব সাক্ষাতেই বিচরণ করেছি। আমার বইয়ের সংখ্যা বর্তমানে ৮২।

প্রবল বাধা ও মানসিক নির্মম যন্ত্রনা অত্যাচার সাহিত্য রচনায় আমাকে শান্তি দিয়েছে। কি পরিমান অমানুষিক পরিশ্রম নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা থাকলে একটি নিম্ননিত্ত গ্রামের মানুষের এত কাজ করা সম্ভব! কষ্ট পেয়েছি, কাজের মধ্যে থাকা আমার যন্ত্রণার প্রলেপ।


স্মৃতিচারণ (৯)অমৃত মাইতি

#সেলুলার জেল /আন্দামান#

"The Daily Telegrams"Port Blair: আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী থেকে ১৮ জুলাই ২০০৯ একটি সংবাদ পরিবেশিত হয় --

Port Blair, July 17: Shri Amrito Maity, a noted Bengali poet from West Bengal who is currently on a visit to these islands participated at a function held yesterday by

Baakprotima in the premises of Hotel ASM,

Dairy farm, Local artists and literature recited self composed poem to the delight of the gathering communication said here .

আন্দামানের পত্রিকা "বাকপ্রতিমা "সম্পাদক অনাদি রঞ্জন বিশ্বাস। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ।

এই পর্বে আমি ভ্রমণ কাহিনী লিখছি না। আমি বহু জায়গাতে সেলুলার জেল ও আন্দামান নিয়ে লিখেছি , ফেসবুক লাইভে আলোচনা করেছি। "নীল জলে বন্দী " আমার প্রবন্ধের নাম। একটি দৈনিক খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। এছাড়া আমার প্রবন্ধের বইতে আছে।আমি দুবার গিয়েছি।আর একবার যাওয়ার বাসনা অনেকদিন থেকে খোঁচা দিচ্ছে। সম্ভবত সেই সাধ পূরণ হবে না। সেলুলার জেল আমার কাছে তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থক্ষেত্রে বারবার যেতে হয়। যতবারই যান না কেন তার পরেও মনে হবে আর একবার ঘুরে আসি।

এখানে ইতিহাস আছে ভূগোল আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আগ্নেয়গিরি জারোয়া জল জঙ্গল সবকিছু এখানে সাজানো। আমার স্মৃতিচারণ পর্বে সেলুলার জেল বাদ যেতে পারে না। এই পর্বে আমি উচ্চারণ করতে পারি মোহিনী চৌধুরীর সেই গান,

"মুক্তির মন্দির সোপানো তলে

কত প্রাণ হলো বলিদান,

লেখা আছে অশ্রুজলে

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,

বন্দিশালার ওই শিকল ভাঙ্গা

তাঁরা কি ফিরবে আর সুপ্রভাতে

যত তরুন অরুণ গেল অস্তাচলে?"

শৈশবে গল্প শুনেছিলাম সেলুলার জেল সম্পর্কে। শুনেছিলাম তেভাগা আন্দোলনের নেতা সেলুলার জেল ফেরত কমরেড ভূপাল পান্ডার মুখে। বাবার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ছিল। একই রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা। আমি তাঁকে জেঠু বলতাম ।তিনিও আমাকে জেঠু বলতেন। তাঁর মুখে সেলুলার জেলের গল্প শুনে শুনে সেই শৈশবেই আন্দামান যাওয়ার অর্থাৎ সেলুলার জেল দেখার অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়।

১৬ জুলাই ২০০৯ এ আন্দামান গিয়েছিলাম মূলত সেলুলার জেল দেখব। এটাই ছিল প্রধান বাসনা। একজন বামপন্থী মানুষের সেলুলার জেলের মতো তীর্থক্ষেত্র দেখাটা খুবই জরুরী এবং মহৎ কাজ। শ্রদ্ধাভাজন কয়েকজন বিপ্লবীর সংস্পর্শ আমি পেয়েছিলাম যাদের ছবি দেখেছিলাম সেলুলার জেলে।

কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত কমরেড ভূপাল পান্ডা কমরেড গণেশ ঘোষ কমরেড কামাখ্যা ঘোষ। সুকুমার সেনগুপ্ত এবং কামাখ্যা ঘোষ বার্জ হত্যা মামলায় যুক্ত ছিলেন। ওই মামলায় যাঁদের ফাঁসি হলো তাঁরা হলেন অনাথ বন্ধু পাঁজা,মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। সেলুলার জেলে অন্যান্য বহু বিপ্লবদের ছবি সংরক্ষিত রয়েছে , যাঁদেরকে আমি চিনি। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর বিপ্লবীদের উপর সেলুলার জেলে কি অকথ্য নির্যাতন হয়েছে তার ইতিহাস আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত। অন্ধকার সেলের মধ্যে দিনের পর দিন বছরের পর বছর তাঁরা কাটিয়েছেন বিষাক্ত পোকামাকড় কামড়েছে তাদেরকে। বিপ্লবীদের দিয়ে ঘানি টানিয়েছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ্দুরে লোহার পাটাতনে আটকে রেখে চাবুক চালিয়েছে, মর্মান্তিক যন্ত্রণায় ছটফট করেছে , তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে, একটু জল চেয়ে পায়নি। নির্মম অত্যাচার বন্ধ করার দাবিতে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার দাবিতে খাদ্যের দাবিতে ইংরেজ এর কাছে যারা আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম স্বাক্ষরকারী ছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমি যতদিন ছিলাম আন্দামানে প্রতিটি সন্ধ্যায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখতাম। সেখানে ইতিহাস পেতাম। নির্যাতনের কাহিনী, একসঙ্গে তিন জনকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেওয়ার ছায়া চিত্র এখনো দেখানো হয়। সেলুলার জেলের দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত। সেজন্য সেলুলার জেল আমাকে সেই শৈশব থেকে আজও আকর্ষণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্দামানে। আমরা উত্তরসূরী। আমাদের দায় দায়িত্ব কর্তব্য অপরিসীম। আন্দামানের মোট ৫৭২ টি ছোট বড় দ্বীপ আছে। ৯২ শতাংশ জঙ্গল। ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ জায়গা আন্দামানকে আনন্দধাম বলাই ভালো।

     আমার বাড়ি মেদিনীপুর। বিপ্লবীরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইতে শীর্ষে অবস্থান করেন। বার্জ হত্যা মামলার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদেরকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। আর এক তীর্থক্ষেত্র চট্টগ্রাম। সেখানকার ২৪ জন বিপ্লবীকে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কলকাতা বন্দরে নিয়ে আসা হয় এবং সেখান থেকে সেলুলার জেলে দুটি জাহাজ "মহারাজা" ও "শাজাহান" বিপ্লবীদের নিয়ে রওনা হয়। সেলুলার জেল এবং আন্দামানের অপার সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের চিরন্তনী আকর্ষণ ক্ষেত্র।

#২০০৯ সালের প্রথমবারের আন্দামান ভ্রমণে আমার সঙ্গে কয়েকজন সঙ্গী ছিল, আমি অশ্বিনী জানা এবং আমার দুই ছেলে আরো কয়েকজন।#

( চলবে).....