Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

স্মৃতিচারণ (২২) অমৃত মাইতি

স্মৃতিচারণ (২২) অমৃত মাইতি#পেট্রাপোল সীমান্ত#একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলা ভাষার একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র যখন থেকে হয়েছে তখন থেকেই পেট্রাপোল পেট্রাপোল আর পেট্রাপোল। বাংলা ভাষার একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেদিন থেকে বোধের জগতে শুধুই স…

 


স্মৃতিচারণ (২২) অমৃত মাইতি

#পেট্রাপোল সীমান্ত#

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলা ভাষার একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র যখন থেকে হয়েছে তখন থেকেই পেট্রাপোল পেট্রাপোল আর পেট্রাপোল। বাংলা ভাষার একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেদিন থেকে বোধের জগতে শুধুই স্বপ্ন আনাগোনা করে। কবে যাব কখন যাব মুক্তিযোদ্ধাদের সেলাম জানাতে যাব। আমার দুটি তীর্থক্ষেত্র। সেলুলার জেল আর বাংলাদেশ। যত ভাবছি পাগল করে দিচ্ছে ব্যাকুলতা বাড়ছে অস্থির হয়ে উঠছি কবে যাব ।একবার কি বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়ে আসতে পারবো না! এ যেন আমারই বাংলা ভাষার রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। কেমন মানুষ তারা যারা শুধু ভাষার জন্য রক্ত দিতে পারে ,জীবন দিতে পারে, শহীদ হতে পারে। কেমন আবেগ তাদের বাউল আর ভাটিয়ালি লিখতে পারে, গাইতে পারে। খুব দেখতে ইচ্ছে করে পদ্মার মাঝি কেমন করে ঝড় তুফানে পার করে দেয় যাত্রী। একবার কি দেখতে পাবো না ?একুশে ফেব্রুয়ারির জনসমুদ্র গোটা বাংলাদেশের রাস্তা জুড়ে। যত বিলম্বিত হচ্ছে তত আক্ষেপ বাড়ছে। মনে হয়েছিল বাংলাদেশ বুঝি কোন দূরতম দ্বীপ। সেখানে বুঝি সহজে যাওয়া যায় না। তাই একবার লিখেছিলাম "একান্তই" কবিতাখানি।

"কখনো কখনো আমারও তো মনে হয়েছে

দ্বীপান্তরে গিয়ে মুঠো মুঠো আকাশ আর বৃষ্টি চুষে খাই"

স্কুলে মাস্টারমশাই বলেছিলেন, 'যত আবেগে চাবে তত বেগে পাবে"।

এলো সেই দিন ২০০৩ সাল ১৮ ফেব্রুয়ারি। পেট্রাপোল পেরিয়ে গেলাম। পেরবার সময় সিকিউরিটি চেক করে নিচ্ছে। তারপর নো ম্যান্স ল্যান্ড। কোন রাষ্ট্রের নয়। যেন মুক্ত মানুষ মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। মাটিটা আমার। এক অদ্ভুত আনন্দ অসাধারণ শিহরণ। পেরিয়ে গেলাম। তখন পেটে খিদের জ্বালা। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কোথায় কি আছে খাওয়ার। পেয়ে গেলাম প্রিয় মুখোরোচক  খাওয়ার। আমাদের চুনো মাছকে ওরা বলে কাচকি মাছ। ঝরঝরে ঝাল দেওয়া মাছ আর ভাত। ওই খাওয়ারটার জন্য মনে হয় বারবার যাই।

তারপর ছুটে চলেছি, মনে হচ্ছে অফুরন্ত অক্সিজেন বাসের জানালা দিয়ে ছুটে আসছে ।বাবলা ফুল মাটির সোঁদা গন্ধ , নদী নালা খাল বিল, এ তো আমরই বাংলাদেশ। প্রায় ৩০ বার গেছি বাংলাদেশ। কিন্তু পেট্রাপোল দিয়ে যাওয়া হয়নি। কিন্তু খুব স্মৃতি রোমন্থন করি। পেট্রাপোল বারবার হাতছানি দিয়ে  ডাকে আমাকে। প্রথম দিনের সুখস্মৃতি , প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে পা দেওয়ার আখাঙ্খা পূরণ।

তারপর পদ্মার ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে একটি বড় বার্জ আমাদের পৌঁছে দিল পদ্মার ওপারে। এই প্রথম পদ্মা দর্শন। মনে গুনগুনিয়ে উঠেছে তখন নজরুলের গান,"পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা "

     অনেক রাতে আমরা পৌঁছে গেলাম ঢাকার সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে তখন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য সালেম সূলেরী সৈয়দ আল ফারুক ও অন্যান্য বন্ধুরা। "সাদা কালো" কাগজের সম্পাদক সালেম সুলেরী আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একুশের অনুষ্ঠানগুলিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমরা অনেকেই একসাথে গিয়েছিলাম। আমার পরিবার, শ্যামলকান্তি দাশ রতন তনু ঘাঁটি অপূর্ব দত্ত দীপ মুখোপাধ্যায়। আমাদের একটি অন্য উদ্দেশ্য ছিল। হলদিয়াতে একটি বৃহৎ মাপের কবি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম আমরা। বাংলাদেশী কবিদের আমন্ত্রণ জানানোর উদ্দেশ্য ছিল ওই ভ্রমণের সঙ্গে। সেই সম্মেলনে আমি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট,শ্যামল এবং রতন যুগ্ম সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন আশিস সান্যাল। ২০০৩ সালে হলদিয়ার কবি সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন ৪২ জন।

প্রায় সমস্ত প্রথম সারির বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল।

 সেই যে নিবিড়।সম্পর্ক তৈরি হলো আজও মলিন হয়নি। এখন সেই সম্পর্ক অনেক অনেক শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার সময় বার্জের ছাদে আমার একটি কবিতার জন্ম হয়।"ভালোবাসি পদ্মার পানি"। বই আকারে প্রকাশ করে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। এখন সে টরেন্টোর অধিবাসী। নিউজ ব্যাংক হলে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আয়োজক সালেম সুলেরী। ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন আমাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন কমরেড লাল সেলাম। তুমি এসেছো শুনে আমি এলাম। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করে যেও ,তোমার কাছে এই প্রত্যাশা।

খুব মনে পড়ে আমাদের মতাদর্শের মানুষ বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক নির্মল সেন।তাঁর সঙ্গে আলাপ করার জন্য সুলেরীকে বারবার বলেছিলাম।

নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল পার্টি অফিসে। অনেক কথা হলো তাঁর সঙ্গে। আমি আজও পেট্রাপোলর স্মৃতি ভুলতে পারিনি। কারণ পেট্রাপোল বাংলাদেশে যাওয়ার আমার প্রথম হাতছানি। পেট্রাপোল যেন দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে।

প্রথমবারেই আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে "খাঁটি"।,"বাউল গন্ধ বাতাস/,সোঁদা গন্ধ মাটি/ধূসর হৃদয়ে মনে হয়/ আমি খাঁটি বাংলাদেশী।"

(চলবে)


স্মৃতিচারণা ( ২৩ )অমৃত মাইতি

#সুইট হোম ত্রিপুরা আমার আনন্দ#

ত্রিপুরার আগরতলা আমার এমন একটা বাড়ি যেখানে মাঝে মাঝে গিয়ে সময় কাটিয়ে মনটাকে একটু অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে পারি। বেশ কিছু জন আমার মনের মানুষ আছেন সেখানে। একটু একঘেয়েমি কাটাতে বা একটু বেদনায় প্রলেপ দিতে আমি চলে যাই আগরতলা। আগরতলায় আমার কিছু নির্ভেজাল আড্ডার জায়গা আছে, লোকও আছে।

আমি গেলে তারা খুশি হয়। তারাও চলে আসে আমার কাছে। কত রাত্রি পর্যন্ত আমরা যে আড্ডা দিই ভাবতে পারবেন না। আমাদের আড্ডায় মূলত থাকে রাতুল দেববর্মন রামেশ্বর ভট্টাচার্য তাপস দেবনাথ শেখ আকবর খোকন সাহা কল্যান ব্রত চক্রবর্তী বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী কৃত্তিবাস চক্রবর্তী সঞ্জীব দে অপাংশু টনি লাল পান্ডে এছাড়া আরো অনেকে। সর্বোপরি কমরেড মানিক সরকার যাঁর সঙ্গে আমি সান্ধ্যকালীন গল্প করি চা মুড়ি খেতে খেতে। তিনি আমার 'প্রবন্ধ সংগ্রহ".আগরতলা শহরে উদ্বোধন করেছিলেন ।৪০ মিনিট বক্তৃতা দিয়েছেন বইটির উপরে। কমরেড মানিক বাবু আমার ক্যান্সার পেশেন্ট স্ত্রীর খবর নেন। "জীবন এক অভিজ্ঞতা" বইটি আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছি।কমরেড পবিত্র কর খুব গল্প হয় তাঁর সঙ্গে ।রাজনৈতিক বিষয়ের টুকিটাকি ।তিনি নানান ভাবে আমাকে সাহায্য করেন আগরতলায় থাকার জন্য। "আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা পুরস্কার" অর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উদ্বোধক ছিলেন আগরতলা বইমেলায়।তাঁর সঙ্গে আমার এতটাই ঘনিষ্ঠতা একদিন সকালে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আমার কিন্তু বৃষ্টির জন্য যেতে পারিনি। দুপুরে আমার ফ্লাইট। তিনি চলে এলেন আমার কাছে। এক অদ্ভুত ধরনের আন্তরিক টান। এইসব কারণে আমি আগরতলাকে বলি আমার সুইট হোম।আগরতলায় সিপিআইএমের রাজ্য অফিসে ,জেলা পার্টি অফিসে, কিষান ফন্টের অফিসে, ডেইলি দেশের কথা অফিসে সন্ধ্যার পরে আমার ঘুরে বেড়ানো একটা অভ্যাস। রাজনীতির লোক বলেই এটা আমার এক অন্তর্নিহিত আবেগ। ডেইলি দেশের কথার সম্পাদক সমীর পালের সঙ্গে আমার হরিহর আত্মা। ত্রিপুরা বেড়ানোর পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। আগরতলা থেকে ট্রেন ধরে ধর্মনগর চলে যান। সেখানে আমাদের কবি বন্ধুদের সংখ্যাটাও কম না। সেখানে থাকেন "জলজ" পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ রায়। ওখান থেকে সেই বিখ্যাত উনকোটি পরিদর্শন করে নেওয়াটা খুবই যুক্তি সঙ্গত এবং জরুরী। কারণ ভ্রমণ পিপাসুদের ঊনকোটি হাতছানি দিয়ে ডাকে। ধর্মনগর থেকে পাহাড়ি জঙ্গল পথ অতিক্রম করে সেখানে যেতে হয়। আগরতলার পাশে ভারতের শ্রেষ্ঠ কোপারেটিভের দাবিদার দুর্গাবাড়ি চা বাগান। সুধাময় মজুমদার (পানু বাবু)

দুর্গাবাড়ি চা বাগানের প্রাণপুরুষ। তিনি মৃতপ্রায় বাগানটিতে সবুজের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। ত্রিপুরার এক নম্বর চা বাগান। বামপন্থীদের হাতে পড়লে রাংও সোনা হয়ে যেতে পারে। দুর্গাবাড়ি চা বাগান শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সেই কারণে। ত্রিপুরার প্রতি মানুষের একটা নৈতিক টান ও আগ্রহ অনুভূত হয ,তার অন্যতম কারণ হলো প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সরকার পরিচালনা এবং উন্নয়নের পরিকল্পনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অসাধারণ দক্ষতা দেখে। সমগ্র ত্রিপুরাতে এক অনন্য সৌন্দর্যময়তা পর্যটককে বারবার আকর্ষণ করে। আগরতলা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে এক মনমুগ্ধকর দর্শনীয় জায়গা "বাঁশগ্রাম"। আমাদের দেশে আর কোথাও এমন সৌন্দর্যমন্ডিত বাঁশ বাগান আছে কিনা জানিনা।

দুর্গা বাড়ি চা বাগান ,বাঁশগ্রাম যাওয়ার পথে মনোরম সবুজের সমারোহ ছায়াছায়া পথ ।

একবার একান্ত প্রীতিভাজন রামেশ্বর ভট্টাচার্য টেলিফোন করে বললে দাদা আমার মেয়ের বিয়ে দিন ধার্য হয়ে গেছে। আজি প্রথম আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখন তিন মাস সময় আছে হাতে। ভাবতে অবাক লাগে শুধু আমাকে তার মেয়ের বিয়েতে পাওয়ার জন্য দিন ধার্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করছে। আমি আমার নাতি-নাতনি নিয়ে গিয়েছিলাম তার মেয়ের বিয়েতে। হাজার একটা কারণ আছে ত্রিপুরাকে আমার সুইট হোম বোলার। ২০০৮ সালের প্রথম যখন ত্রিপুরা গেলাম তখন আগরতলা বিমানবন্দর থেকে নিয়ে গেল কবিও ছড়াকার বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী। আমার সঙ্গে ছিল অশ্বিনী জানা গৌতম দাস সোমা প্রধান।

ত্রিপুরা নিয়ে আরো কিছু কথা,

"ত্রিপুরা আমার সুইট হোম

 ত্রিপুরা আমার আর একটা বাড়ি

ত্রিপুরা আমার ব্যথা বেদনার উপশম

ত্রিপুরা আমার আনন্দ নিকেতন

ত্রিপুরা আমার মুগ্ধ সবুজ প্রান্তর

ত্রিপুরা আমার গতানুগতিক জীবনের বিকল্প

ত্রিপুরা আমার জীবনের ছন্দ

ত্রিপুরা আমার আন্তরিক মানুষের সন্ধান

ত্রিপুরা আমার বাড়তি অক্সিজেন

ত্রিপুরা আমার সবুজ ছায়া

ত্রিপুরা আমার মায়াময় জ্যোৎস্নার রাত

ত্রিপুরা আমার শিউলি ঝরা সকাল

ত্রিপুরা শমসের গাজীর আত্মত্যাগের মন্ত্র

ত্রিপুরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়

ত্রিপুরা বামপন্থার জন্য রক্ত ঝরায়

ত্রিপুরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আর এক নাম

ত্রিপুরা আমার পরকীয়া প্রেম

ত্রিপুরা আমাকে ভালোবাসার গান শোনায়।"

"শোনো গো দখিন হাওয়া

প্রেম করেছি আমি

লেগেছে চোখেতে নেশা

দিক ভুলেছি আমি।

শোনো গো দক্ষিন হাওয়া

প্রেম করেছি আমি। "


ত্রিপুরার আয়তন ১০,৪৯১ বর্গ কিলোমিটার।

(চলবে)


স্মৃতিচারণ (২৪) অমৃত মাইতি

#আমি সাঁওতাল হতে চাই #

আমার সহজাত আবেগ এবং বৈশিষ্ট্য হল সহজ-সরল

অনাড়ম্বর জীবনযাপন এবং জল বাতাস সবুজ প্রকৃতির মত সহজ আবেগ। কোন রকম কাঠিন্য আমি সহ্য করতে পারি না। আমার কষ্ট হয়। বাস্তবে অনেক প্রতিকূলতা এবং রূঢ় আচরণ আমাকে ভীষণ পীড়িত করে। অথচ আমার দুর্ভাগ্য অকারণে অনেক বিপদসংকুল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে সারা জীবন। আমার পাশের বহু ঘনিষ্ঠ মানুষ তারা হয়তো আমার এই সারল্যকে ঈর্ষা করে। এই ঈর্ষা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমাকে বিপন্ন করেছে।

সামাজিক কোন কোন ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছি আমি। সমস্ত ক্ষেত্রে ক্ষমতার বাইরে সময় দিয়েছি ,ঝুঁকি নিয়েছি, খুব কষ্ট করে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। এই সমস্ত কারণে আমি তথাকথিত সভ্য সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি, যদিও এই কঠিন বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। শ্রেণীগত কারণে মানুষের মধ্যে কৃষ্টি সংস্কৃতি ও চেতনার তারতম্য আছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যও মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। বিভিন্ন দিক থেকে আমাকে নিংড়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতাও আছে। এই সমস্ত কারণে আমি প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। রাজনৈতিক কারণে আমি যখন ঝোপঝাড় জঙ্গলে যাই তখন বিস্তৃত বনরাজি, সবুজ প্রকৃতি অফুরন্ত অক্সিজেন স্নিগ্ধ বাতাস আর আদিবাসী জীবন আমাকে অন্তরঙ্গ করে নেয়। তাদেরকে নিবিড় করে নিতে আমার মধ্যে এক আন্তরিক টান অনুভব করি। তখন মনে মনে বলি বাহ এটাই তো প্রকৃত জীবন। আমার সমস্ত রকম হতাশা ও ব্যথার কাহিনী ভুলিয়ে দেয় শাল -মহুয়া , ডুলুং, পারাং।

আমাকে নিঃস্ব করে দেয়। আমাকে সাঁওতাল করে দেয়। আমি তখন মুক্তবিহঙ্গের ছাড়পত্র পাই। আমার আর কোন কিছু টান নেই। আমি একজন প্রকৃত সাঁওতাল। যদিও প্রকৃতপক্ষে সাঁওতাল হওয়া যায় না।

তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে অরণ্য মহলের অধিবাসী হতে ইচ্ছে করে। আমার খুব পছন্দ চিল্কিগড। ঝাড়গ্রামের সমস্ত এলাকা, সমস্ত বন জঙ্গল আমি ঘুরেছি। শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, ঝাড়খণ্ডেরও বহু জায়গা আমি ভ্রমণ করেছি। প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা করেছি। ভারতের পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা আসাম এবং বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবন যাপনে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তাদের সংস্কৃতি শিক্ষা দীক্ষা আচরণ আমাকে এবং যেকোনো আবেগপ্রবণ মানুষকে আকর্ষণ করে। যে সমস্ত এলাকা আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তাদের সংস্কৃতি তাদের জীবনযাপন এতটাই মনমুগ্ধকর, আমরা যারা অ -আদিবাসী তারা আকৃষ্ট হই। এর বড় কারণ হলো মুক্ত আকাশের নিচে প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় জঙ্গলের নান্দনিক পরিবেশে তারা নিজেদেরকে প্রকৃতির আনন্দের সঙ্গে খুশির মেজাজে রাখতে চায়। পেটের খিদের জ্বালা ভুলিয়ে দেয় এই নান্দনিক পরিবেশ আর প্রকৃতিদত্ত খুশির মেজাজ।বহু রাত কাটিয়েছি আমি ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক কারণে।মাদলের শব্দ শুনেছি। চাঁদনী রাতে নাচতে দেখেছি। বেতালার জঙ্গলে গভীর রাতে নাচতে দেখেছি আমি আদিবাসীদের।

হৃদয়কে রাঙিয়ে নিয়েছি। আজও ভীষণ প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে অরণ্য মহলে যাওয়ার অপেক্ষা করি।

"পিন্দারে পলাশের বন

পালাবো পালাবো মন

ন্যাংটা ইঁদুরে ঢোল কাটে

হেই, ন্যাংটা ইঁদুরে ঢোল কাটে

হে কাটে রে

বতরে পিরিতির ফুল ফুটে

আরে বতরে পিরিতির ফুল ফুটে"

কোথায় চলে যাবে আপনার বুকের যন্ত্রনা। মাদলের নাচের তালে তালে আপনিও সাঁওতাল হয়ে যাবেন।

    জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৪ ,সিদ্ধান্ত হয় প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করা হবে। বিশ্বের আদিবাসীর সংখ্যা

প্রায় কুড়ি কোটি। হুল উৎসব ছৌ নৃত্য আদিবাসীদের সংস্কৃতি। আমি সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে গিয়েছিলাম সারা ভারত কৃষক সভার জেলা সম্মেলনে। এই প্রথম আমার ঝাড়গ্রাম দেখা। গোটা ঝাড়গ্রাম শহরে শাল মহুয়ার জঙ্গল ।অদ্ভুত শহর। প্রথম দেখা এই প্রকৃতি আর প্রথম তার প্রেমে পড়া।

১৯৭৩ সালে গিয়েছিলাম বেলপাহাড়ি। তারপরে পুনরায় গেলাম ১৯৮০ সালের জুন মাসে। দেখলাম বেলপাহাড়ি কাশমাড় চাকাডোবা পচাপানি প্রকৃতি এলাকাতে মাওবাদীদের হতে লেখা পোস্টার। সে সময় সরকারি সাহায্য অপ্রতুল ছিল।তাই জ্বর পেট খারাপের ওষুধ মাওবাদীরা সরবরাহ করত। এইভাবে মাওবাদীদের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।

কত যে ভোট হয়েছে ঠিক নাই কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই। তাই সহজে বোঝানো যায় ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না।স্বাধীকার রক্ষার কারণে অতীতের সাঁওতাল বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। স্মরণ করিয়ে দেয় মাওবাদীরা। ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার খনিজ বনজ সম্পদের পাহারাদার এই আদিবাসীরাই।

১৯১৫ সালে আদিবাসীদের একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল তার নাম "ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ।"

১৯৩৮ সালে আদিবাসীদের আরো একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল তার নাম "আদিবাসী মহাসভা"।

সাঁওতালরা প্রকৃতপক্ষে সহজ সরল মানুষ। যুগ যুগ ধরে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের স্বভাব আচরণ আমাদেরকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে।

তাই ভন্ড মানুষগুলোকে দেখলে, ঠকবাজ লোকদের দেখলে, হিংসুটে মানুষগুলোকে দেখে চলে যেতে ইচ্ছে করে ঝোপঝাড় জঙ্গলে ।সাঁওতাল হতে ইচ্ছে করে।

"দলমা পাহাড়ের কোলে নিরালা ডিমনা লেক

গা ছমছম করা রাস্তা

জুবলি পার্কের অসংখ্য রংবেরঙের

গোলাপের সৌরভে

আমার সাঁওতাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

ঘেন্না ধরে যায়

শুধু চটকদারি কথা

লোক - ভোলানো প্রতিশ্রুতি

মিথ্যার বেসাতি আর ভালোবাসার ভান।

দায়সারা অভ্যর্থনা

বাঁধা গতে শুকনো ভাষণ

সূক্ষ্ম অনুভূতি সুকোমল বৃত্তি 

কবে শুকিয়ে গেছে।

ঢের ভালো প্রকৃতির কোলে

মাটি মায়ের আদর নিয়ে

সাঁওতাল হয়ে যাওয়া।

আমি সাঁওতাল হতে চাই।"

"পারাং নদীর ডাক"কবিতাতে আমি লিখেছিলাম

"শালের ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদ

আমার গায়ে লাগে

ডলুং নদীর আমায় ডাকে- আয় আয় আয়

সুবর্ণরেখা তীরে বনভোজন সেরে শুয়ে থাকি

আমরা কালো বটে

চাঁদের আলো আমাদেরই গা চাটে -"

সত্যিই তো আমাদের গায়ে জামা কাপড় থাকে মাথার উপরে ছাদ থাকে তাই চাঁদের আলো আমাদের গা চাটতে পারে না। সেই সৌভাগ্য সাঁওতালদের। চাঁদের আলো সত্যিই সাঁওতালদের গা চাটি ।এর চাইতে প্রকৃতিতে আর কি পাওয়া যেতে পারে। তাইতো বারবার ইচ্ছা হয় সাঁওতাল হয়ে যাই।

(চলবে)