Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গল্প#রূপান্তর
#সায়ন্তনী_পলমল_ঘোষ
 " বুলান, কি বলচু ব্যাটা? ছ্যানা লিয়ে কুথাকে যাবোক ?" আতঙ্কিত চোখে অসহায় প্রশ্ন দুলালীর।
" ইত রাতে ছোট ছ্যানা লিয়ে কি করে যাব?" দু বছরের লুকুকে কোলে নিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে জবা। 
&qu…

 


#গল্প

#রূপান্তর


#সায়ন্তনী_পলমল_ঘোষ


 " বুলান, কি বলচু ব্যাটা? ছ্যানা লিয়ে কুথাকে যাবোক ?" আতঙ্কিত চোখে অসহায় প্রশ্ন দুলালীর।


" ইত রাতে ছোট ছ্যানা লিয়ে কি করে যাব?" দু বছরের লুকুকে কোলে নিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে জবা। 


" উফফ! তোদের কি করে বুজাই! যদি আমরা না পালাই উরা মোদের জ্যান্ত জ্বালাই দিবেক।" মা আর স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করে বুলান।


" ট্যাকা পয়সা লিয়ে লিছি। জলদি যে টুকুন না লিলেই লয় লিয়ে চল। উরা এল বলে। আর দেরি কোললে কেউ বাঁচব নি। " কানাই এসে গম্ভীর গলায় বলে।


" দাদু, মোরা কুথাকে যাবক?" সাত বছরের পুনির প্রশ্নের উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানাই বলে, " জানিনি রে।"


বাইরে একটা গোলমালের ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসে সকলের। বহু লোকের সম্মিলিত চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। দুলালী আর জবা ভয়ে কেঁপে ওঠে। কানাই আর বুলান দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে সকলকে নিয়ে বেরিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। একটু পরেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ওদের চোখে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে ওই আগুনের গ্রাসে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ওদের এতটুকু বাসা, ওদের সুখনীড় খানি। 


" এই দিদি, মাসিঘর যাবিনি? কটা বাজে দেখেচু?" পুষ্প চিন্তিত মুখে মালাকে ডাকে।


" কটা বাজে?" 


" দশটা।" 


" গল্প কত্তে কত্তে টাইম দেখিইনি।"  হাসি মুখে বলে মালা।


" দেখিইনি..। এবার যাবি কি করে ভাব আর কিছু পাওয়া যাবেনি মনে হয়।" মালাকে ভেংচি কেটে বলে পুষ্প। 


" এমন কচ্ছু কেন? ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।" মালা বেশ আত্মবিশ্বাসী সুরে বলে।


" মানে?" সন্দিগ্ধ সুরে জিজ্ঞেস করে পুষ্প।


" দেখ না তুই।" চোখ টিপে বলে মালা।


মালা আর পুষ্প দুই বোনের বাড়ি কুশপাতা গ্রামে। মালার বয়স উনিশ আর পুষ্পর সতেরো। মালার বান্ধবীর বৌভাত উপলক্ষে এই আধা মফস্বল পালুইপুরে এসেছে। অন্য কনে যাত্রীরা ফিরে গেছে। এখানে মালাদের  মাসিবাড়ি তাই ওরা  ফিরে যায়নি। বিয়েবাড়ি থেকে মাসিবাড়ি চলে যাওয়ার কথা কিন্তু গল্প করতে করতে মালা বড্ড দেরী করে ফেলেছে।  পুষ্প অনেকক্ষণ থেকে তাড়া দিচ্ছিল  কিন্তু সদ্য যৌবনের দরজায় পা রাখা মালার বিয়েবাড়ি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তার মতো বয়সে নব বিবাহিতা বান্ধবী, তার বর, বরের বন্ধু-বান্ধবের দল, হাসি-মস্করা এসবের আকর্ষণ বোধহয় একটু বেশীই হয়।  


পুষ্প চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মতে তার দিদিটা একটু ঢলানি গোছের। মিনা দিদির বরের বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে এত রাত করে দিল। আজ ওর মেসো বাড়ি নেই তাই মাসি বারবার করে ওদের বলে দিয়েছিল যে সময় থাকতে থাকতে টোটো ধরে ফিরে যেতে। ওরা দুইবোন আগেও একলা একলা মাসিবাড়ি এসেছে। টোটোতে করে পালুইপুরে ঘুরেছে তাই যখন মালা ঠিক করেছিল যে ওরা বাড়ি না ফিরে মাসীবাড়ি চলে যাবে পুষ্প রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন পুষ্পর মনে হচ্ছে মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। মিনার এই সদ্য বিয়ে হয়েছে তার শ্বশুরবাড়িতে রাত কাটানোর কথা তো আর বলা যায় না। বিয়েবাড়িতে প্রচুর লোকজন। তারা যে সমস্যার মধ্যে রয়েছে এটাই বা এখানে কাকে বলবে। এ বাড়িতে একমাত্র পরিচিত মিনা কিন্তু সে তো নতুন বউ।  দিদির ওপর ভীষন রাগ হচ্ছে পুষ্পর। রীতিমতো ভয়ও লাগছে তার। কি করে মাসি বাড়ি পৌঁছবে?


পুষ্পর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো মালা। তার বোকা বোনটা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিল।  বিয়েবাড়ির এত মজা ছেড়ে সাত তাড়াতাড়ি মাসিবাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছিল। সে জানতো ঠিক একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে আর তার ধারণাই সত্যি হল। মিনার বরের দুই বন্ধু অরুণ আর রজত নিজে থেকেই মালাদের সমস্যা বুঝতে পেরে ওদের পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিল। দুজনেরই মোটর সাইকেল আছে। মাসীদের পাড়াটাও ওরা চেনে। এক্ষুণি পৌঁছে দেবে ওদের দুই বোনকে। মালা আর পুষ্প নিশ্চিন্ত মনে উঠে বসল বাইকের পেছনে।


আকাশের গোল থালার মত চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বসে ছিল দুলালী। পূর্ণিমা এখানেও আসে, চাঁদ এখানের আকাশেও জোৎস্না ঝরায় কিন্তু দুলালীর মন ভরে না। তার মন পড়ে থাকে সেই জঙ্গল ধারের ছোট্ট মাটির বাড়িটায়। জঙ্গলের গাছের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের রূপ যেন গর্ভবতী মায়ের মতো উপচে পড়ত। দুধ সাদা জোৎস্না  দুলালীর উঠোনে ঢেউ তুলত। চাঁদের আলো ধোয়া উঠোনে বসে দুলালী আর কানাই নাতি-নাতনীর সঙ্গে গল্প করত, খেলত। মেটে বারান্দার এক পাশে উনুন ধরিয়ে রান্না চাপাত জবা। গরম ভাতের গন্ধ ধীরে ধীরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত। বুলান কাজ থেকে ফিরে নেয়ে-ধুয়ে চুপটি করে রান্নাশালে এসে জবার গা ঘেঁষে বসত। জঙ্গলের গাছেরা যেমন করে কথা বলে তেমনি ফিসফিসিয়ে দুজনে ভাব-ভালোবাসা, মান-অভিমানের কথা বলত। গরীবের সংসার  তাদের তাই পরিবারের সকলকেই গায়ে-গতরে খাটতে হত কিন্তু আনন্দের ঘাটতি ছিল না। সকলে মিলে খেয়ে-পরে সংসারটা চালিয়ে নিত। পালা-পার্বনে মেলা দেখা, আত্মীয়-কুটুমদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ সবই হত কিন্তু আট বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনটার পর থেকে সব বদলে গেল। তাদের সহজ সরল জীবনটা একটা রুক্ষ, কঠিন যুদ্ধ ক্ষেত্রের রূপ নিল। পালাতে পালাতে ঠোক্কর খেতে খেতে তারা আর লুকুকে ধরে রাখতে পারল না। অর্ধাহার আর অসুখকে সঙ্গী করে মাত্র তিন বছর বয়সে লুকু জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিয়ে নিয়েছিল। হাসপাতালের ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়েছিল আর কটা ওষুধ কিনতে বলেছিল আর বলেছিল একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে। বলাই বাহুল্য লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, কর্মহীন অসহায় একটা পরিবারের জন্য লুকুকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখাটাই ছিল ভবিতব্য। পালাতে পালাতে অবশেষে বছর পাঁচেক আগে এখানে এসে একটু থিতু হবার সুযোগ পায় তারা। নিয়তি যেমন করে হঠাৎ তাদের ভিটে ছাড়া করেছিল তেমনি করেই হঠাৎ বুলানের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তার সাহায্যেই বুলান আর বুলানের বাপের কারখানায় কাজ জুটে যায়। জবাও একটা মেয়েদের দলের সঙ্গে জুটে কাজকর্ম শুরু করে। এখন তাদের অভাব নেই। টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা পাকা বাড়ি হয়েছে। পুনি ইস্কুলে পড়ে।  জবার কোল জুড়ে আবার একটা ছেলে হয়েছে কিন্তু সেই ছেলেকে কোলে নিতে পারে না দুলালী। কোলে নিলেই মৃত লুকুর মুখটা ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। চিৎকার করে ওঠে সে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকলে মানিয়ে নিয়েছে। সবাই বেশ ভালোই আছে এখন, কিন্তু দুলালী? না সেই দিনের পর থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যও ভালো থাকতে পারে নি। শহর, পাকা বাড়ি, আর্থিক স্বচ্ছন্দ্য কিছুই তার অতীতকে ভোলাতে পারেনি। দুলালীর স্মৃতি জুড়ে তার সমস্ত সত্ত্বাকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার ফেলে আসা ভিটে, জঙ্গলের সঙ্গে সহবাস, বর্ষার জলে ভর্তি ধানের জমি, লুকুর খিলখিল হাসি, মৃত লুকুর বিবর্ণ মুখ। তাই তো দুলালীর রাতে ঘুম হয় না। বাড়ির সবাই যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায় সে রাতের পর রাত জেগে বসে থাকে বাড়ির উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে। প্রতি রাতেই সে পরিশ্রান্ত কানাইয়ের পাশ থেকে উঠে বাইরে এসে বসে। তার মাথার মধ্যে অনেক জট পাকানো হিসেব নিকেশ চলে।  আজও বসে আছে দুলালী। আজ বাড়ির সবাই একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুলালী ভাবছিল, জঙ্গলের মধ্যে আজও কি জোৎস্না লুকোচুরি খেলছে? দুলালী আর তার ভাবনাদের মধ্যে হঠাৎ সম্পর্ক ছিন্ন হল একটা অস্বাভাবিক আওয়াজে। ওই ফাঁকা জায়গাটার পরে যে নতুন বাড়িটা তৈরি হচ্ছে সেখান থেকে শব্দটা এল বোধহয়।


মালা আর পুষ্প মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে কত বড় ভুল করেছে। বোধহয় তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এই ভুলের মাশুল হয়ত সারা জীবন ধরে দিতে হবে অবশ্য জীবনটা যদি থাকে। চোখ ফেটে জল আসছে মালার। আজ তার জন্য তার বোনের জীবনটাও শেষ হতে বসেছে।  অরুণ আর রজতের ভালো মানুষের মুখোশের পেছনে যে এত কদর্য একটা রূপ আছে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। সত্যি কথা বলতে কি রজতের প্রতি সে কিছুটা আকৃষ্টও হয়েছিল। সেই কারণেই অন্ধের মত বিশ্বাস করে বসেছিল সে রজতকে। যে ছেলেটা বিয়েবাড়ি মাতিয়ে রেখেছিল তাকে এখন একটা রাক্ষস ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না মালার। পুষ্প তো ভয়ে, আতঙ্কে প্রায় স্থবির হয়ে গেছে।  অরুণ আর রজত জোর করে ওদের একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংএ নিয়ে এসেছে। চারিদিক অন্ধকার। রজত ওর মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে রেখেছে শুধু। ওদের আরও দুই বন্ধুকে ফোন করে আসতে বলেছে। মালা কাতর অনুনয় করে, " আমাদের ছেড়ে দাও । আমাদের এত বড় ক্ষতি করনি গো তোমরা।"


" জানেমন, এত রাতে হাতের সামনে দুটা ডবকা মাল পেয়ে কি করে ছেড়ে দিই বল। দুটা বন্ধুকেও ডেকেছি। ভালো জিনিস একলা কি করে খাই বল?" খিক খিক করে হাসতে থাকে রজত। অরুণ কথা কম কাজে বেশি বিশ্বাসী। সে নজর দিল পুষ্পর ওপর। পুষ্পকে তার বেশি মনে ধরেছে। পুষ্পকে দুমড়ে মুচড়ে তারপর মালাকে চাখবে এরকমই ইচ্ছে তার। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো অরুণ ঝাঁপিয়ে পড়তেই এতক্ষণ ভয়ে মুখবন্ধ করে সিঁটিয়ে থাকা পুষ্প শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলো আর সেই সঙ্গে তার গলা চিরে বেরিয়ে এল বাঁচার জন্য প্রচণ্ড এক আর্তনাদ। 


" এই শালী চুপ কর।" পুষ্পকে এক চড় কষালো অরুণ। 


চড় খেয়ে যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠলো পুষ্প। 


 আলো-আঁধারীর মধ্যে হঠাৎ ওরা ঘরের মধ্যে অন্য কারুর উপস্থিতি অনুভব করল। বন্ধুরা এসেছে ভেবে ফিরে তাকিয়ে রজত আর অরুণ আবিষ্কার করল উস্কোখুস্ক চুল, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে এক আদিবাসী বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। 


" এই বুড়ি তুই কে রে?" ঝাঁঝিয়ে উঠল অরুণ। তার উন্মত্ত পৌরুষ বাধা পেয়ে বিরক্ত।


" মুই ডান আছি রে। দুলালী ডান।" হি হি করে হাসতে হাসতে দুলালী তার হাতের শক্ত লাঠিটা দিয়ে গায়ের জোরে আঘাত করে রজতকে। অরুণ আসতে সেও দুলালীর হাত থেকে রেহাই পায় না। এখন দুলালীদের আর খাবার অভাব নেই তাছাড়া চিরকালই দুলালীর গায়ে প্রচুর জোর। সকলে বলত দুলালী একটা পুরুষের সমান কাজ পারে। রজত আর অরুণ দুলালীর লাঠির সামনে নিজেদের ঠিক সামলে উঠতে পারে না। দুলালী এলোপাথাড়ি মারতে থাকে ওদের।


" পালা মেইছ্যানারা। পালা।" অর্ধ উন্মাদ দুলালীর মাথাটা যেন পরিস্কার হয়ে গেছে।


মালা আর পুষ্পর মনে হয় যেন স্বয়ং মা দুর্গা এসেছেন তাদের অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করতে। 


" এই ভদ্রমহিলার জন্যই আজ আপনার মেয়েরা বেঁচে গেল। মেয়েদের কাছে তো সব শুনেছেন।"  মালার বাবা খবর পেয়ে থানায় এসেছে। ইন্সপেক্টর আঙ্গুল তুলে যেদিকে দেখালো সেখানে একটা বেঞ্চের ওপর দুলালী বসে আছে আর তাকে দুপাশে ঘিরে আছে বুলান আর কানাই।  মালার বাবা নয়ন সেদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পায়ের তলার মাটিটা কেঁপে উঠলো তার। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অপর পক্ষও তাকে দেখে খুব একটা স্বস্তিতে নেই। কানাইয়ের মন শঙ্কিত, বুলানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, চোখের সামনে নিজের মৃত সন্তানের মুখটা একবার ভেসে উঠল। মনে মনে আগামী যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল সে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেবে না সে। কানাই আর বুলান একবার পরস্পরের দিকে তাকালো। আর দুলালী? সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নয়নের দিকে। একবারও চোখ সরায় নি। দুলালীর চোখের সামনে জলছবির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে আট বছর আগের একটা দিন। কানের মধ্যে আছড়ে পড়ছে কতকগুলো বাক্য, " ওই দুলালীটাই শয়তানি। উ একটা ডাইনী।" 


আট বছর আগের কুশপাতা গ্রাম। সেইদিন নয়ন মন্ডলদের বাড়িতে ধান ঝাড়ার কাজে লেগেছিল দুলালী। তার সঙ্গে আরও দুজন কামিন ছিল। সকালে নয়নের মা তাদের পান্তাভাত  খেতে দিয়েছিল। দুলালী একটার জায়গায় দুটো কাঁচালঙ্কা চাওয়ায় নয়নের মা তাকে মুখ ঝামটা দিয়ে দুকথা শোনায়। ক্ষুধার্ত দুলালীও রাগের বশে বলে ফেলে, " লংকা দিবেনি তো দিবেনি। বেশি মুখ করবে নি বলে দিচ্ছি। ভালো হবে নি।" তার এই শাসানীর বিশেষ কোনও অর্থ বা উদেশ্য কিছুই ছিল না। বড় জোর নয়নের মা বেশি কটু কথা শোনালে দুলালী মাঝপথে কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসত তাতে নয়নদের ধান ঝাড়ার কাজে একটু অসুবিধা সৃষ্টি করা যেত এর বেশি আর কিছু করার সাধ্য দুলালীর ছিল না কিন্তু তার মুখ থেকে বেরোনো কতকগুলো মূল্যহীন কথা যে তাকে ভিটে-মাটি ছাড়া করবে স্বপ্নেও ভাবেনি দুলালী। সেদিন দুপুরের দিকে নয়নের মা আচমকা মারা যায়। ডাক্তারী বিদ্যায় দীর্ঘদিনের উচ্চরক্ত চাপের রুগীর স্ট্রোক হওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার কিন্তু মানুষের মন ডাক্তারী বিদ্যার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। সেইদিন মৃতার ছেলে নয়ন আর তার পাড়া-পড়শীদের চোখে দোষী সাব্যস্ত হয় দুলালী।  ডাইনী আখ্যা পায় সে। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে  দুলালী যাইহোক করে বাড়ি পালিয়ে এসেছিল। বুলান খবর পেয়ে নয়নের হাতে-পায়ে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার মা ডাইনী নয়। নয়নের মা এমনি মারা গেছে কিন্তু প্রত্যুত্তরে, " তোর মা একটা ডান।" একথা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। 


 মা অন্তপ্রাণ নয়নের মায়ের পারলৌকিক কাজের চেয়ে মায়ের হত্যাকারীকে শাস্তি দেওয়াটা বেশি কর্তব্যের বলে মনে হয়েছিল। দাহকার্য সারার পর লোকজন জুটিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল দুলালীকে জ্যান্ত দগ্ধ করার উদ্দেশ্যে কিন্তু ভগবান সেদিন ভুলবশত  ডাইনীটাকে সাহায্য করে ফেলেছিলেন। দুলালী পরিবার শুদ্ধ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ব্যর্থ আক্রোশে নয়ন ওদের ছোট্ট কুঁড়েটা জ্বালিয়ে দেয়। আশেপাশের দশটা গ্রামেও খবর ছড়িয়ে দেয় যাতে কোথাও ওদের আশ্রয় না জোটে। দুলালীকে শাস্তি দিতে না পারার যন্ত্রণা আজও মাঝে মাঝে নয়নের বুকে খোঁচা দেয়। সেদিনের পর থেকে আজ আটবছর পর সে দুলালীর দেখা পেল। এতদিন ধরে যাকে তার মায়ের হত্যাকারী ভেবে এসেছে আজ সেই তার মেয়েদের জীবনদাত্রী রূপে তার সামনে দাঁড়িয়ে। সেদিন যাকে সে ডাইনী আখ্যায়িত করেছিল আজ তার সম্বন্ধেই তার মেয়েরা বলেছে, " বাবা গো, ঠাকমাটা যেন মা দুগ্গা। একলাই বদমাশ ছেলে দুটাকে পিটিয়ে , চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে আমাদের বাঁচাল নইলে আমরা আর...।"


নত মস্তকে নয়ন দুলালীর দিকে এগিয়ে গেল।  হাতজোড় করে দাঁড়ালো তার সামনে। দেবীর সামনে তো করজোড়েই দাঁড়াতে হয়।


" আমাকে মাফ করে দাও। তমরা কুশপাতা ফিরে চল। আমি তমাদের ঘর, জায়গা সব দুব।"


যে দুলালী দিন কাটায় কুশপাতার স্মৃতি রোমন্থনে, রাত জাগে তার অতীতের চাদর গায়ে জড়িয়ে, যে ফেলে আসা ভিটে-মাটির সোঁদা গন্ধ প্রতিনিয়ত খুঁজে চলে সেই দুলালী ডাইনীর মত নাকি দেবী দুর্গার মত জ্বলন্ত চোখে নয়নের দিকে তাকিয়ে একটাই শব্দ উচ্চারন করে," নাহ।"


 দুলালী আজ খুব শান্ত অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে নয়নকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। যেখানে মানুষ ডাইনী আখ্যা পায় সেখানে আর কোনও দিন ফিরবে না সে।


                               সমাপ্ত


 


সায়ন্তনী পলমল ঘোষ