অরুণ কুমার সাউ, তমলুক: শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয়েছিল কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে। পুরান অনুসারে জানা যায় এই অসুর এক সময়ে স্বর্গ- মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সকল দেবগনের আবেদনে সাড়া দিয়ে দে…
ফাইল চিত্র |
অরুণ কুমার সাউ, তমলুক: শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয়েছিল কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে। পুরান অনুসারে জানা যায় এই অসুর এক সময়ে স্বর্গ- মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সকল দেবগনের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারী রূপে কোলাসুরকে বধ করেন। তারপর থেকে কুমারী পুজোর প্রচলন শুরু হয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কুমারী পূজা হয়ে আসছে। ১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত যে কোন কুমারী মেয়েকে কুমারী রূপে পুজো করা হয়। বিভিন্ন বয়সের কুমারী বিভিন্ন নামে পূজিত হয়। এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা , দুই বছরের কন্যা সরস্বতী , তিন বছরের কন্যা ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কন্যা কালিকা, পাঁচ বছরের কন্যা সুভগা, ছয় বছরের কন্যা উমা, সাত বছরের কন্যা মালিনী, আট বছরের কন্যা কুব্জিকা, নয় বছরের কন্যা কালসন্দভা, দশ বছরের কন্যা অপরাজিতা, একাদশ বছরের রুদ্রানী, দ্বাদশ বছরের কন্যা ভৈরবী, ত্রয়দশ বছরের কন্যা মহালক্ষী , চতুর্দশ বছরের কন্যা পিঠনায়িকা , পঞ্চদশ বছরের কন্যা ক্ষেত্রজ্ঞ, ষোড়শ বছরের কন্যা অম্বিকা রুপে পূজিত হয়।
সাধারণত ব্রাহ্মণ পরিবারের কুমারী কন্যাকে লাল রঙের শাড়ি পরিয়ে কুমারী পূজা করার জন্য সাজানো হতো। মাথায় দেওয়া হতো ফুলের মুকুট। গায়ে ফুলের গহনা। পায়ে চাওড়া করে আলতা পরানো থাকতো। দেবী দুর্গার কুমারী রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। মুখ ধোয়ানো, মিষ্টিমুখ করানো, পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, ধুপ, দীপ দিয়ে আরতি করা সকল কিছুই পুরোহিত করেন। সামনের মন্ডপে তখন বাজতে থাকে শঙ্খ, ঢাক, ঘন্টি , বাজনা। দলে দলে মানুষের ভিড় জমে এই অপূর্ব পুজো দেখতে। এই ছোট্ট কুমারীর মধ্যে তখন নাকি দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়। অষ্টমী পূজোর পর এই কুমারী পুজো হয়ে থাকে।
কুমারী পুজো কেন হয় বা এই পুজোর জন্য কেন কুমারীদের নির্বাচন করা হয় তা নিয়েও বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হল নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। কুমারী কন্যা শক্তির উৎস , সৃষ্টির শক্তি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ত্রিশক্তি বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তি বীজাকারে কুমারীতে নিহিত আছে। তাই কুমারীতে দেবীভার আরোপ করে সাধনা করা হয় এমনটা পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত আছে। শুধু তাই নয় প্রাচীন ভারতে যে আটটি বস্তুকে শুভরূপে গ্রহণ করা হতো তার মধ্যে অন্যতম ছিল কুমারী কন্যা। প্রাচীনকাল থেকেই কোন শুভ অনুষ্ঠানে কুমারী কন্যার দর্শন ও পূজন রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। রামায়ণ থেকে জানা যায় রামচন্দ্রকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানে কুমারী কন্যারা বিশেষভাবে যুক্ত ছিল। এটাও জানা যায় শ্রী রামচন্দ্র যখন বনবাসের চতুর্দশ বৎসর অতিক্রম করে অযোধ্যায় ফিরে আসেন তখন তাকে কুমারী কন্যারা সাদরে বরণ করেছিলেন। মহাভারতে একাধিক স্থানে কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুমারীকে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে । তান্ত্রিক মতে সকল কুমারীই দেবীর প্রতীক। তবে দুর্গোৎসবের ক্ষেত্রে কুমারী দেবী দুর্গা রূপেই পূজিত হন।
শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণ পরিবারের কুমারী কন্যাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা হয়ে থাকে। কুমারী পূজার ক্ষেত্রে কুমারী নির্বাচনের কথা বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে পাওয়া যায়। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী , সুলক্ষণা , শ্রীময়ী, মাধুর্যপূর্ণ কন্যাদের সাধারণত কুমারী রূপে নির্বাচন করা হয়। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সমস্ত রীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে পুজো করেছিলেন মুসলমান কন্যাকে। তিনি জাত পাতের ঊর্ধ্বে দেবী দর্শন করেন। তিনি ইব্রাহিম নামে এক মাঝির কুমারী কন্যাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।ঝিলাম নদীর তীরে দেবীরূপে পূজা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। পরে তিনি বেলুরমঠে কুমারি পূজার প্রচলন করেছিলেন। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজীর ধ্যানে ও দর্শনে তা স্বীকৃত তাই তিনি মুসলমান কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন। বেলুড় মঠের কুমারী পূজা তিনি এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে মঠের এক প্রিয় দাদা রামলালের মেয়েকে কুমারী আসনে বসিয়েছিলেন। যুগাবতার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কুমারীকে দেবী ভগবতীর অংশ মনে করতেন। কুমারীর মধ্যে দৈবী ভাবের প্রকাশ দেখা এবং জননী রূপে পূজা করা সার্থক প্রকাশ। অনেক ক্ষেত্রেই কুমারী কন্যাকে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার ভাবি উত্তর শরিক জ্ঞানে পূজার রীতি স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছিল।