আজকের গল্প - পরজন্মে ✍️কবিতা চক্রবর্ত্তী
না,রূপকথার গল্পের সিন্ডারেলার মত সে একপাটি জুতো ফেলে যায়নি। সে ফেলে গেছিলো একটা ডাইরি।
এক পড়ন্ত শীতের বিকেলে, সূর্যমামা যখন আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে, ,আর চারপা…
আজকের গল্প - পরজন্মে
✍️কবিতা চক্রবর্ত্তী
না,রূপকথার গল্পের সিন্ডারেলার মত সে একপাটি জুতো ফেলে যায়নি। সে ফেলে গেছিলো একটা ডাইরি।
এক পড়ন্ত শীতের বিকেলে, সূর্যমামা যখন আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে, ,আর চারপাশটা আরো বেশি বেশি করে ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, সেই গোধূলি বেলায় বোরখার মধ্যে দিয়ে শুধু দেখেছিলাম তার অপূর্ব দুটো চোখ। কি যে অপূর্ব নেশা ধরানো সেই চোখদুটো। কালো দীঘির মত টলটলে সেই চোখে ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
স্টেশনের একদম সামনে দিকের বেঞ্চে বসেছিল সে । একলা। হাতে একটা ডাইরি।
জানিনা সেই দৃষ্টিতে কি ছিল। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো সেইদিকে। চুম্বকের মত আকর্ষণ করছিল ওই চোখদুটো।
হটাৎ একটা ট্রেন আসতেই সে উঠে পড়েছিলে ট্রেনে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেনটা ছেড়ে যেতেই নজরে পড়লো বেঞ্চের ওপর তার হাতের ডাইরিটা। ভুল করে ফেলে গেছে।
ডাইরিটা বাড়ি নিয়ে এলাম। কারণ ততক্ষণে ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে।
উল্টে পাল্টে দেখলাম প্রথমে ডাইরিটা। ডাইরিটাতে কি সুন্দর একটা গন্ধ। যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। প্রথম পাতা খুললাম। নাম লেখা মমতাজ । ঠিকানাও দেওয়া। অপূর্ব সুন্দর হস্তাক্ষর।
প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত অনেক কবিতা লেখা। প্রত্যেকটা পাতায় ভীষণ আকুতি ভরা এক একটা কবিতা লেখা নামহীন প্রেমিকের উদ্দেশ্যে। একটাই বক্তব্য কবিতায়, তুমি কবে আসবে? অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সে ক্লান্ত। উল্টেপাল্টে দেখলাম। অপূর্ব সব কবিতা।
কবিতার ভক্ত আমি কোনদিনই না। তাও অনেক রাত জেগে বেশিরভাগ কবিতাগুলো পড়ে ফেললাম। শেষের কিছুটা আর পড়া হয়নি। অদেখা তার প্রেমিকের জন্য বেশ হিংসাই হলো আমার। নিজের মনেই হেসে ফেললাম। রেখে দিলাম ডাইরিটা। ভাবলাম কাল ওই ঠিকানায় গিয়ে যার জিনিস তাকে দিয়ে আসবো। স্বপ্নেও তাকেই দেখলাম সেই রাত্রে।
পরদিনই অফিস থেকে সন্ধ্যাতে ফেরার পথে অনেক খুঁজে সেই ঠিকানায় গেলাম। একটা বহু পুরনো পোড়ো বাড়ি। বেল বাজাতেই একজন লোক দরজা খুলে দিলো। বাড়ির কাজের লোক মনে হলো। নাম বলে কারণ জানালাম আসার। ভেতরে বসতে বললো।
ঘরের চারদিকে বেশ বনেদিয়ানার ছাপ। পুরোনো দামী আসবাবপত্র। বিশাল এক বুক সেলফে ভর্তি বই। চারদিকে দেখছি সব। আর কালকের দেখা চোখদুটো মনের মধ্যে ভেসে উঠছে।
একটু পরে সে এলো। আজও বোরখায় ঢেকে নিজেকে । সামনের চেয়ারে বসলো। সেই লোকটি এসে এক গ্লাস জল রেখে গেল সামনে।
ওই মুহূর্তে সেই চোখদুটো দেখে সত্যিই ভুলে গেলাম কি করতে এসেছি এখানে। আমি তাকিয়ে থাকলাম তার চোখের দিকে। দেখলাম ওই চোখ জোড়াও মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
-- আপনি কাল স্টেশনের বেঞ্চিতে এটা ফেলে গেছিলেন।
ডাইরিটা ফেরত দিতে যাবো,তার আগেই সে বললো,
--আপনি পড়েছেন ডাইরিটা?
আমি একটু হেসে বললাম,
-- ঠিকানাটা জানার জন্য খুলেছিলাম। তবে আপনার কবিতাও কিছু পড়েছি কিন্তু। খুব সুন্দর লেখেন আপনি।
-- শেষ পৃষ্ঠাটা দেখেছেন? জিজ্ঞাসা করলো সে।
বললাম ,
--ঠিক মনে নেই। দেখেছি বোধহয়।
উত্তরে মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর বললো তাহলে এখন দেখুন।
একটু ইতস্তত করে শেষ পৃষ্ঠাটা খুললাম । অবাক হয়ে দেখলাম সেখানে আমার ছবি। নিচে লাল কালিতে ( রক্তেও হতে পারে,সেরকমই মনে হলো),
"আর কত অপেক্ষা করবো? এক জন্ম হয়ে গেলো তুমি আমার কাছে নেই। আর অপেক্ষা করতে পারছিনা। ফিরে এসো।খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া ।"
মাথার মধ্যে কেমন করে উঠলো। আমার ছবি??কিন্তু কি করে?? এখন আমি শিওর ,কাল এটা ছিলনা। ছবি থাকলে ঠিক চোখে পড়তো।
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি বোরখার ভিতরে সেই দুটো চোখ। ভীষণ শীতল সেই চোখে চাহনি। তাকানো যাচ্ছে না সেই চোখে দিকে। মৃত মানুষের চোখের মত ঠিক। আমি কিছুতেই পারছিনা সেই চোখের দিকে তাকাতে। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এক্ষুণি আমকে এখান থেকে বেরোতে হবে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ।
নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ছুটে দরজার দিকে দৌড়ে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিক তখনই দেখলাম বোরখার ভিতর থেকে কঙ্কালের দুটো হাত আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আর বলছে,
-- এসো,এসো ফিরে এসো। আর কত জন্ম অপেক্ষা করবো তোমার জন্য? আর কত কষ্ট দেবে আমাকে। একবার ফিরে এসো আমার কাছে।
জ্ঞান হারালাম আমি। কিচ্ছু মনে নেই আর। পরদিন আমাকে নাকি অজ্ঞান অবস্থায় স্টেশনের সেই বেঞ্চে পাওয়া গেছিলো। জানিনা ওখানে কি করে গেছিলাম। সবাই বলছিলো রাতে ওই বেঞ্চে কেউ কেউ আমাকে বসে থাকতে দেখেছে।
তবে এই ঘটনার কয়েকদিন পরে এক ছুটির সকালে, আমি সেই ঠিকানায় আবার গেছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সেই পোড়ো বাড়ির জায়গায় সেখানে একটা ভীষণ সুন্দর চারতলা বাড়ি। বাড়ির নাম দেখলাম "মমতাজ"।
আশেপাশের পুরোনো দোকানদারদের জিজ্ঞাসা করলাম এই বাড়িটার সম্মন্ধে কিছু জানে নাকি।কেউ সেরকম কিছু বলতে পারলোনা। একজন খুব বৃদ্ধ শুধু বললেন, এই বাড়ির মালিক যারা ,তাদের বেশিরভাগ সবাই বাইরে থাকে। একটা ছেলেই পরিবার নিয়ে এখনও থাকে এখানে। বেশিরভাগ ঘর এখনও বন্ধই থাকে। এখন যারা বসবাস করে তাদের ঠাকুমার নাম ছিল মমতাজ। অনেককাল আগে তার ছেলেরা যখন ছোটো ছিল, তখন তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলো। সেই স্বামীকে মমতাজ সারাজীবন খুঁজে গেছিলো। শেষকালে তো পাগল হয়ে এই বাড়িতেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো মমতাজ। তার নামেই এই বাড়ির নাম মমতাজ।
মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। কিন্তু এত লোক থাকতে আমার সঙ্গে তাহলে এমন হলো কেন? তবে কি আমি.........