বাবলু বন্দ্যোপাধ্যায়। তমলুকপূর্ব মেদিনীপুর জেলার রূপনারায়ণ নদের পাড় বরাবর কোলাঘাটে আগনিত মানুষের সমাগমে জমে উঠল ছট পুজোর তৃতীয় দিন। কোলাঘাট, মেছেদা, তমলুক, পাঁশকুড়া, বালিচক, খড়গপুর সহ বিভিন্ন জায়গা হতে মূলত হিন্দিভাষী…
বাবলু বন্দ্যোপাধ্যায়। তমলুক
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রূপনারায়ণ নদের পাড় বরাবর কোলাঘাটে আগনিত মানুষের সমাগমে জমে উঠল ছট পুজোর তৃতীয় দিন। কোলাঘাট, মেছেদা, তমলুক, পাঁশকুড়া, বালিচক, খড়গপুর সহ বিভিন্ন জায়গা হতে মূলত হিন্দিভাষী মানুষজন নতুন পোশাকে দলবেঁধে হাজির হন নদীর পাড়ে।
ছট ব্রতীরা সূর্যাস্তের সময় অস্তগামী সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে গঙ্গা ঘাটে ডালা ভর্তি করে গোটা আখ, গোটা হলুদ, নারকেল ,কলা এছাড়াও পূজার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে গিয়ে ভক্তিপূর্ণ মনে নিবেদন করতে দেখা গেল বৃহস্পতিবার।
সুর্য্য অস্তাচলের মুহূর্তে পুজার্চনায় মেতে উঠে। যে যার মত ছট পুজোর মন্ত্র ও গানে গানে সুর মেলান। তারপর রূপনারায়ণের স্রোতধারায় অবগাহন করেন। অনেকে বাদ্যবাজনা সহ ট্রেনে, বাসে, বিভিন্ন ছোট বড় গাড়িতে করে হাজির হন। নিরাপত্তায় প্রশাসনের পক্ষ হতে নজরদারী চালানো হয়। কোলাঘাট থানার পক্ষ থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ছিল সকাল থেকে।
ছট পুজোতে অংশ নেওয়া ছাড়াও স্থানীয় বহু মানুষ দেখার জন্যেও ভীড় জমান।
সবমিলে এদিন ছট পুজোর ভীড়ে কোলাঘাট রূপনারায়ণের পাড় , যেন এক টুকরো বিহার বা ঝাড়খন্ডের চিত্র ফুটে উঠেছিল। সনাতন ধর্মে যে নিত্য পাঁচ দেবদেবী পূজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে একজন হলেন সূর্য্য দেবতা। সেই সূর্যদেবতা এবং তাঁর পত্নী ঊষা তথা প্রত্যুষার উদ্দেশ্যেই এই ছট পূজা করা হয়ে থাকে। সূর্যের রশ্মি কে -'ছটা' বলা হয়।তার থেকে ছট পূজার নাম হয়েছে বলে কথিত। অন্যদিকে সূর্যের পত্নী উষা দেবীকেও ছটি মাইয়া হিসেবে গণ্য করা হয়।আর যেহেতু হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে প্রত্যেক বছর অমাবস্যার কালীপূজা শেষ হলে, কালী পূজার ছয় দিন পরে কার্তিক মাসের ষষ্ঠীর দিন এই সূর্য দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে সেই কারণেও এই পূজার নাম- ছটপূজা হয়েছে বলে লোকশ্রুতী।সনাতন ধর্ম অনুসারে যে দেবকে প্রত্যক্ষ দেখা যায় তিনি হলেন সূর্যদেব। তিনি সমস্ত শক্তির উৎস। যেহেতু সূর্যদেবকে প্রত্যেকদিন প্রত্যক্ষ করা যায় সেই কারণে এই ছট পূজায় কোনো মূর্তির প্রয়োজন পড়ে না। ভারতবর্ষে হিন্দু ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এই পূজার চল বেশি। তবে এই পূজার সবথেকে বেশি প্রাধান্য দেখা যায় মূলত উত্তর ভারতের-বিহার, ঝাড়খন্ড, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দিভাষী মানুষদের মধ্যে। সনাতন ধর্মেও এই ছটপূজার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রামায়ণ এবং মহাভারতের কাহিনীতেও এই ছট পূজার বর্ণনা পাওয়া যায়। রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্র লংকা থেকে অযোধ্যায় ফিরে আসার পর রামচন্দ্রের রাজ্য অভিষেক করা হয়। রামচন্দ্র তখন তার পত্নী সীতার সঙ্গে প্রজা কল্যাণের উদ্দেশ্যে রামরাজ্য স্থাপনের জন্য কার্তিক মাসের এই শুক্ল ষষ্ঠীতে সূর্যের উপাসনা করেছিলেন।
এছাড়াও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী মা অন্নপূর্ণার ছটপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। একবার আষাঢ় মাসে বর্ষার কারণে চাষীরা খেতে শস্য বুনে দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে বর্ষা নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। তখন সূর্যের প্রবল দাবদাহে মাঠ-ঘাট পুড়ে যাবার উপক্রম হয়। চাষীদের ঘরে অন্নের অভাব দেখা যায়। চাষিরা তখন মা অন্নপূর্ণার শরণাপন্ন হন। মা অন্নপূর্ণা উপায় না দেখে সূর্যদেবের ধ্যানে মগ্ন হন। কিন্তু সূর্য দেবের ধ্যান করে বিশেষ ফল পাওয়া যায় না। ধরিত্রীর অবস্থা সূর্যের প্রখর রোদে ক্ষীণ্য হয়ে যায়। এই অবস্থা দেখে সকল দেবতারা সূর্যদেবের শরণাপন্ন হন। সূর্যদেব তখন মা অন্নপূর্ণা কে কার্তিক মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতে গঙ্গাতীরে গিয়ে সূর্য উপাসনা করার বিধান দেন। এরপর মা অন্নপূর্ণা চাষীদের কল্যাণে ভক্তি ভরে সূর্যের উপাসনা করেন এবং ধরণীকে শস্য-শ্যামলা করে তোলেন। সেই থেকেই পরিবারের মহিলারা মূলত পরিবার ও বিশ্বের কল্যাণের উদ্দেশ্যে ছট পূজার মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন।মোট চারদিন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই ছটপূজা পালন করা হয়ে থাকে। ছট পূজার তৃতীয় দিনটি হলো সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই দিনটিকে ষষ্ঠীর দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। ছট পূজার চতুর্থতম দিন অর্থাৎ সপ্তমীর দিন ছট ব্রতীরা সূর্যোদয়ের সময় ঘাটে গিয়ে আবারও সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করে ছট উপবাস ভঙ্গ করেন। ভক্তিপূর্ণ পূজা পালনে মনস্কামনা পূর্ণ হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস। এছাড়াও ছট পূজার একটি বৈজ্ঞানিক দিকও রয়েছে। ছটপূজার ব্রতর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রাণ শক্তি কে আরো উজ্জীবিত করতে পার। সমস্ত কজে উৎসাহ নিয়ে আসতে পারে।