পূর্ব মেদিনীপুর , তমলুক: একটা অচেনা মিসড কল, তার থেকে শুরু হওয়া আলাপ, ধীরে ধীরে ঘনিয়ে ওঠা প্রেম। প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল এক নাবালিকা। ভেবেছিল, নতুন জীবনের শুরু হবে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের খেসারত দিতে হল ভয়ঙ্করভাবে। য…
পূর্ব মেদিনীপুর , তমলুক: একটা অচেনা মিসড কল, তার থেকে শুরু হওয়া আলাপ, ধীরে ধীরে ঘনিয়ে ওঠা প্রেম। প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল এক নাবালিকা। ভেবেছিল, নতুন জীবনের শুরু হবে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের খেসারত দিতে হল ভয়ঙ্করভাবে। যে যুবককে প্রেমিক ভেবে আঁকড়ে ধরেছিল, সে-ই ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ঠেলে দিল তাকে মহিষাদলের যৌনপল্লির অন্ধকার গলিতে।
দীর্ঘ ১০ বছর বিচার প্রক্রিয়ার শেষে অবশেষে রায় দিয়েছে তমলুকের পকসো আদালত। শনিবার আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছে তিন অভিযুক্তকে। রায়ে বলা হয়েছে— দুই অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, আর এক অভিযুক্তকে দু’বছরের জেল হেফাজতে কাটাতে হবে।
ঘটনাটি ২০১৫ সালের। পাঁশকুড়া থানার অন্তর্গত এলাকার ১৭ বছরের এক নাবালিকার সঙ্গে হঠাৎ করেই ফোনে আলাপ হয় এক যুবকের। নিজেকে সে পরিচয় দিয়েছিল ‘সাদ্দাম’ নামে। নিয়মিত ফোনালাপে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা, গড়ে ওঠে বিশ্বাসের সম্পর্ক। একদিন সেই যুবকের ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি ছাড়ে কিশোরী। ভেবেছিল প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধবে। কিন্তু বাস্তব ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে তার এক আত্মীয় অসুস্থ থাকায় তার বাড়ি যাবার বাহানা দিয়ে ‘সাদ্দাম’ তাকে সোজা নিয়ে যায় মহিষাদলের যৌনপল্লিতে। সেখানেই ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় মেয়েটিকে। এরপর প্রায় পনেরো দিন ধরে কিশোরীর উপর চলে অমানবিক নির্যাতন।
অত্যাচারের শিকার হয়ে একসময় যৌনপল্লিতে আসা এক গ্রাহকের কাছে সাহস করে নিজের দুঃখের কাহিনি খুলে বলে নাবালিকা। অনুরোধ করে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য। গ্রাহক ফোন করেন মেয়েটির পরিবারে। খবর পেয়েই থানায় ছুটে যায় পরিবার।
অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁশকুড়া থানার তৎকালীন এসআই মানস মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুলিশ মহিষাদলের ‘রায়ের ঠেক’ এলাকায় হানা দেয়। সেখানে গিয়ে উদ্ধার করা হয় নাবালিকাকে। ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়, নেওয়া হয় তার গোপন জবানবন্দি। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় ওই যৌনপল্লির মূল কারবারি সায়েরা বানু ও তার স্বামী টিটু রায়কে।
প্রথমে ধরা না পড়লেও দেড় বছর পর পুলিশের জালে আসে মূল অভিযুক্ত প্রেমিক। ধরা পড়ার পর জানা যায়, ‘সাদ্দাম’-এর আসল নাম শাহজাহান চিত্রকর। তিনি পূর্ব মেদিনীপুরেরই চণ্ডীপুরের বাসিন্দা। টিআই প্যারেডে কিশোরী তিন অভিযুক্তকেই শনাক্ত করে। সেই থেকেই জেল হেফাজতে ছিল শাহজাহান ওরফে সাদ্দাম।
বছরের পর বছর মামলা চলার পর অবশেষে ওই তিন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে মঙ্গলবার সাজা ঘোষণা করেন তমলুকের পক্সো আদালতের বিচারক সুস্মিতা ভট্টাচার্য। নারী পাচারচক্রে অভিযুক্তদের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। শাহাজান চিত্রকর ও সায়েরা বানুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং টিটু রায়কে দু’বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাদ্দাম তথা শাহাজান চিত্রকর এর স্ত্রী উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেন।
এই ঘটনা আবারও সামনে এনে দিল মোবাইল ফোনের অচেনা আলাপ থেকে শুরু হওয়া ‘প্রেমের ফাঁদ’-এর ভয়াবহ দিক। মহিষাদলকাণ্ডের রায়ে আদালত যেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তেমনই এক কঠিন শিক্ষা দিল— ভুয়ো প্রেমের মোহে যে অন্ধকার গহ্বরে নাবালিকাদের ঠেলে দেওয়া হয়।