*রাতচরাদের কথা*
*লেখা ও ছবি – রাকেশ সিংহ দেব*
রাতচরা’রা গ্রাম বাংলার এক অদ্ভুত পাখি। নাম থেকেই বোঝা যায় রাতের সাথে এই পাখিটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। দিনের আলো নিভে এলেই সারাদিন ঢুলু ঢুলু চোখে নিশ্চুপ ব…
*রাতচরাদের কথা*
*লেখা ও ছবি – রাকেশ সিংহ দেব*
রাতচরা’রা গ্রাম বাংলার এক অদ্ভুত পাখি। নাম থেকেই বোঝা যায় রাতের সাথে এই পাখিটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। দিনের আলো নিভে এলেই সারাদিন ঢুলু ঢুলু চোখে নিশ্চুপ বসে থাকা এই পাখির ডানা মেলার সময়। যেন সন্ধ্যার আকাশ ‘রাতচরা’ পাখিকে আহ্বান জানায় ঘর ছেড়ে বেরুবার। এদের প্রধান খাবার ঝিঁঝি পোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা ও অন্যান্য উড়ন্ত নিশাচর কীটপতঙ্গ। আমাদের অবিভক্ত মেদিনীপুরে তিন ধরনের রাতচরা দেখতে পাওয়া যায়।
*১। বাংলা নাম: ল্যাঞ্জা রাতচরা, | ইংরেজী নাম: লার্জ-টেইলড নাইটজার (Large-tailed nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus macrurus* | এরা আমাদের এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। গ্রামগঞ্জের ছোটখাট ঝোপঝাড় কিংবা বাঁশবনে এদের বিচরণ বেশি। রাতচরা লম্বায় ২৫-৩৩ সেন্টিমিটার। গায়ের উপরের রঙ হলদেটে-ধূসর মিশ্রিত, কালো ছিট। ঘাড়ের পাশে লালচে কালো ছাইরঙা ছোপ। চোখের পাশ থেকে চিবুক পর্যন্ত রয়েছে অল্পক’টি খাড়া লোম। লেজ ও ডানা বেশ কিছুটা লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত আড়াআড়ি ডোরা দাগ। গলায় হালকা সাদা বন্ধনী। লেজের তলার পালক ফিকে রঙের। পা লালচে-বেগুনি। স্ত্রী পাখির লেজের প্রান্তে থাকে হলদে-লালের মিশ্রণ যা দেখে এদের পার্থক্য করা যায়।
*২। পাখির বাংলা নাম: মেঠো রাতচরা, ইংরেজি নাম: সাভানা নাইটজার (Savanna Nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus affinis ।* তুলনামূলক পাথুরে এবং তৃণময় সমভূমি এলাকায় দেখা মেলে। দৈর্ঘ্য ২০-২৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের গায়ের উপরের রং বাদামি-দারুচিনি মিশ্রিত ছিট এবং কালচে ডোরাকাঁটা। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পসল্প খাড়া লোম। লেজ ও ডানা সামান্য লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত রয়েছে আড়াআড়ি ডোরা দাগ। লেজ তলার পালকে বাদামি-সাদার ছিট। চোখ বাদামি। ঠোঁট কালচে, ওপরের ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় অভিন্ন।
*৩। পাখির বাংলা নাম: দেশি রাতচরা, ইংরেজি নাম: ইন্ডিয়ান নাইটজার (Indian Nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus asiaticus* | এরা আমাদের এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। গ্রামগঞ্জের জঙ্গলাকীর্ণ মেঠো রাস্তার ওপর, ছোটখাট ঝোপঝাড় কিংবা বাঁশবনে এদের বিচরণ বেশি। লম্বায় ২১-২৪ সেন্টিমিটার।গায়ের উপরের রঙ কালচে-বাদামি মিশ্রিত ছিট। চোখের পাশ থেকে চিবুক পর্যন্ত অল্পস্বল্প খাড়া লোম। লেজ ও ডানা সামান্য লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত রয়েছে আড়াআড়ি ডোরা দাগ। গলায় হালকা ক্রিমসাদা বন্ধনী। লেজের তলার পালক ফিকে রঙের। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে।
রাতচরাদের শারীরিক গড়ন একটু ব্যতিক্রমী। গায়ের পালকের বিন্যাস এবং রঙ অনেকটাই গাছের মরা ডাল বা শুকনো পাতার মতো। ধূসর শুকনো পাতার মাঝে চুপটি করে বসে থাকা অবস্থায় এদের খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। গ্রাম-গঞ্জের হালকা ঝোপজঙ্গল কিংবা বাঁশবনে রাতচরাদের অবাধ বিচরণ। সূর্যাস্তের খানিকটা পরেই ঝোপজঙ্গলের ভিতর থেকে ডাকতে শুরু করে ‘চউঙ্ক-চউঙ্ক-চউঙ্ক’ সুরে। প্রজনন মরসুম ছাড়া বেশির ভাগ সময় একা একা বিচরণ করে। প্রজনন মরসুম মোটামুটি ভাবে এপ্রিল থেকে অগাস্ট। তবে অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। এসময় এরা সরাসরি মাটির উপরে শুকনো পাতা জড়ো করে বাসা বাঁধে এবং তার উপরে দুইটি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮দিন। স্ত্রী এবং পুরুষ রাতচরা পাখি দেখতে প্রায় অভিন্ন। একসময় সুলভ দর্শন হলেও বর্তমানে এরা অসুলভ এবং বিপন্ন হয়ে উঠছে শুধুমাত্র আবাস সংকটের কারণে। গ্রামে আগের মতো ঝোপজঙ্গলও নেই, নেই বাঁশঝাড়ও ফলে এরা ভীষণ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দিনের পর দিন মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে করে পোকামাকড় পুরোপুরিভাবেই শেষ করে ফেলেছি আমরা। ফলে পোকার ওপরই যাদের জীবন নির্ভর করতো তারা এখন বিলুপ্তির পথে। তাদের মধ্যে প্রথমেই আছে এই নিশাচর পাখি, রাতচরা।