রাকেশ সিংহদেব
বলির রক্তের বদলে মাটির মালসায় নৈবেদ্য গ্রহণে আজও তৃপ্ত হন জঙ্গলমহলের জাগ্রতা লৌকিক দেবী শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীমাতা বামুনবুড়ি।
আজও তাই পুজো দিতে আসা সমস্ত ভক্তরা চিড়ে ভোগের মাটির মালসা সজিয়ে মায়ের কাছে নিজের মনস্কামন…
রাকেশ সিংহদেব
বলির রক্তের বদলে মাটির মালসায় নৈবেদ্য গ্রহণে আজও তৃপ্ত হন জঙ্গলমহলের জাগ্রতা লৌকিক দেবী শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীমাতা বামুনবুড়ি।
আজও তাই পুজো দিতে আসা সমস্ত ভক্তরা চিড়ে ভোগের মাটির মালসা সজিয়ে মায়ের কাছে নিজের মনস্কামনা পূরণের আশায় মানত করেন। কেউ হাজার, কেউ বা তারও বেশীও মালসা ভোগ মানত রাখেন৷ ফলে সন্ন্যাসী থান লাখো লাখো মালসা ভোগের লম্বা লাইন পড়ে যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার
শালবনীর পিড়াকাটা সংলগ্ন কলসীভাঙ্গার পাড়ুআয়মা তে প্রতি বছর ৩ রা ও ৪ ঠা মাঘ বামুন বুড়ি সন্ন্যাসী মাতার আরাধনা করা হয় পূর্ণ ভক্তি নিষ্ঠা সহকারে। পুজো উপলক্ষে মন্দির সংলগ্ন মাঠে বিশাল মেলারও আয়োজন করা হয়। লাখো লাখো ভক্তের উপস্থিতি মন্দির চত্বর হয়ে উঠে মিলন ক্ষেত্র।
পাড়ুআয়মা, পাথরি, বুড়িপালা, কলসীভাঙ্গা সহ বিস্তৃত এলাকার জাগ্রতা দেবী হলেন বামুন বুড়ি সন্ন্যাসী মাতা। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে এই দেবীর পুজোর প্রচলন শুরু করেছিলেন কলসীভাঙ্গা গ্রামের জনৈক লক্ষীকান্ত মাহাত। তিনি গত হওয়ার পর তার বংশধরেরা এখনো এই পুজো করে আসছেন পুরনো রীতিনীতি মেনেই। জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকায় অতীতের ন্যায় আজও জঙ্গল থেকে কাঠপাতা এনে এবং গোচারন করে সংসার প্রতিপালন করেন এলাকার মানুষজন। কথিত আছে একবার লক্ষীকান্ত মাহাতোর এক আত্মীয় গোরু চরাতে গিয়েছিলেন জঙ্গলে । সারাদিন ধরেই জঙ্গলে গোরু চরছিল। বিকেলে হয়ে যাওয়ার পর গোরু নিয়ে ঘর যাওয়ার সময় দেখেন একটি বলদ নেই। অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয় যায়না। তিনি এই কথাটি জানান আত্মীয় লক্ষীকান্ত মাহাতকে। তিনিও খুঁজে খুঁজে যখন হয়রাণ হয়ে একটি গাছের নীচে বসে ভাবছেন কি করবেন কোথায় যাবেন। আর কিছু ভাবতে না পেরে বনদেবীর নাম স্মরণ করেন। এমন সময় এক বয়স্কা বৃদ্ধা এসে তাকে বলেন যে গোরুটি জঙ্গলের কোন খানে আছে এবং গোরুটি নিয়ে আসতেও বলেন। লক্ষীকান্ত বাবু তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে দেখেন বয়ষ্কার কথা মতো গোরুটি সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গোরু নিয়ে আবার সেই গাছের তলায় ফিরে এসে দেখেন বয়স্কা বৃদ্ধা তখনও বসে আছে সেই গাছেরই নীচে। লক্ষীকান্ত বাবু তখন তার কাছে করজোড়ে জানতে চায় তাঁর আসল পরিচয়। তখন সেই বয়স্কা বৃদ্ধা জানান যে তিনি সন্ন্যাসী মাতা বামুন বুড়ি। এই জঙ্গলেই তাঁর বাস। এখানে তাঁর পুজোর কথা বলেন। তিনি জানিয়ে যান যে এই জঙ্গলে যদি কারো কোনো সমস্যা হয় তাঁকে যেন স্মরণ করে, তিনি উদ্ধার করবেন। তারপর থেকেই ঐ স্থানে বামুন বুড়ি সন্ন্যাসী মাতার আরাধনার প্রচলন শুরু হয়। শোনা যায় এলাকার অনেকেরই গবাদিপশু জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার পর এই দেবীর স্মরনাপন্ন হওয়ার পর গবাদিপশু ফিরে পেয়েছেন সকলেই। লক্ষীকান্ত বাবু মারা যাওয়ার পর তারই বংশধর রবীন্দ্রনাথ মাহাত সেবাইত ছিলেন দেবীর। তিনিই এই পুজো এবং মেলার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটান। বর্তমানে কংক্রিটের মন্দির তৈরি করা হয়েছে। গর্ভগৃহে হাতি ঘোড়ার ছলনে পূজিতা হন দেবী। বর্তমানে মায়ের সেবাইত আছেন কালিপদ মাহাত। প্রতিবছর ৩রা ও ৪ঠা মাঘ খুব ধমধাম সহকারে পুজো করা হয়। এছাড়াও নিত্য পুজো হয় প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার। এবারের বার্ষিক পুজোতে প্রায় দুই লক্ষ মালসা মানত পড়েছে বলে খবর। পুজোর সময় সমস্ত মালসাগুলি চিঁড়ে কলা আর বাতাসা দিয়ে মন্দিরের সামনে সাজিয়ে রাখা হয়। সারা মন্দিরের সিঁড়ি থেকে মন্দির চত্বর ভরে ওঠে মালসায়। স্থানাভাবে সব মালসা সাজানো সম্ভব হয়ে উঠে না। বামুনবুড়ি মেলা কমিটির সভাপতি বিমল মাহাত জানান, " দুইদিন ধরে চলা এই পুজোতে মেলারও আয়োজন করা হয়। মেলাতে লাখ লাখ দর্শক হাজির হয়। মেলা উপলক্ষ্যে যাত্রা সহ সারা রাত্রিব্যাপী নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়।