পর্ব: তিন
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন
-------
লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পাদক শুভানুধ্যায়ী সকলেরই আসল ও প্রধান পরিচয় হল এঁরা প্রত্যেকেই লিটল ম্যাগাজিন '। 'কর্মী' শব্দে যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে যুক্ত …
পর্ব: তিন
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন-------
লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পাদক শুভানুধ্যায়ী সকলেরই আসল ও প্রধান পরিচয় হল এঁরা প্রত্যেকেই লিটল ম্যাগাজিন '। 'কর্মী' শব্দে যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে যুক্ত হতে চান না। আন্দোলন শব্দটি নিছক আক্ষরিক নয়, ব্যবহারিক।
#
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন হল--
ক. লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পাদকরা লিটল ম্যাগাজিনের অপমানে পথে নামবেন, প্রতিবাদ করবেন।
খ. মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠায় বারবার সরব হবেন।
গ. দুঃস্থ লেখক শিল্পীর পাশে আর্থিক ও মানসিক ভাবে দাঁড়াবেন।
ঘ. রাজনীতির আবর্তে পড়বেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিমনস্ক হবেন।
ঙ. গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হবেন, তবে ব্যক্তিকে অস্বীকার করে নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও অনেক সময় ভুল করেন। সমাজ সেই সব ভুলকে লালন পালন করে।
চ. শুধু নিজের লেখাটি লিখলাম, পত্রিকা দপ্তরে পাঠালাম,ছাপা হল,অন্য নামে ফেসবুক বানিয়ে কবিতা পোস্ট করলাম, পত্রিকা করে আত্মীয় পরিজনদের ছড়িয়ে দিলাম। সাহিত্য মহাকাশ নামক পুরস্কার পেলাম, তিন বছর বাদে পুরস্কার ফিরিয়ে দিলাম। ৩২ টি কবিতার বই, ৮টি গদ্য বই, ৩০২ টি সংখ্যা প্রকাশ করলাম। মরে গেলাম। মৃত্যুর দু'তিন বছর বাদে সব উধাও। ১৮ নং বইটি কোথায় পাব! ১০৫ তম সংখ্যা! আসলে বহু কাজ করলেই হয় না। সংরক্ষণেরও ভাবনা সমান্তরাল ভাবে করে যেতে হয়। লেখক-সম্পাদকটি ব্যক্তি মানুষ হিসাবে ১২ লক্ষ টাকার জীবনবীমা করেছেন, অথচ লেখক-সম্পাদক জীবনের কোনও বীমা নেই। তাই প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা বারবার সচেষ্ট হবেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তুলতে। কখনওবা সরকারের কাছে দাবি জানাবেন। কখনওবা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে গড়ে তুলবেন ছোটোখাটো একটি সংরক্ষণাগার।
ছ. অনেকে ভাবেন আন্দোলন মানে রেলগাড়ির সামনে বসে পড়তে হবে। বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের ছায়াতে দাঁড়াতে হবে। তা কিন্তু নয়। কলমকে সচল রাখলেই হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি কলম। লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার প্রসার ও অক্ষরকর্মীদের জন্য, মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠালাভে পত্রিকায় লিখুন প্রবন্ধ, হ্যান্ডবিলে লিখুন নিবন্ধ। বারবার বলতে বলতে, লিখতে লিখতেই তো সমাজ সচেতন হবে। অনেককেই বলতে শুনি, কী হবে এসব লিখে! কিছুই হবে না। এঁরা স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছেন--অথচ কবিতা লেখেন। এঁরা নিছক কবি হতে চান। কবি তো অনেক পরে, আগে তো ভালো মানুষ হতে হবে। ভালো মানুষ মানে নম্র, ভদ্র, আত্মকেন্দ্রিক, মগ্ন কবি নয়। তিনি যদি পুরোনো ঢঙে কবিতা লেখেন, অথচ তিনি যদি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে যুক্ত,তাঁকেই সম্মান দেব বেশি করে। যেহেতু আমার পরিচয় লিটল ম্যাগাজিন কর্মী হিসাবে।
জ. বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করুন বা এঁদের ভোট দিন--এ কথা বলে না লিটল ম্যাগাজিন। বরং আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতায় আপনি ভোট দিন। স্বাধীন ভাবেই মত প্রকাশ করুন সবাই। ভয়হীন ভাবেই সরকার ও দেশের সমালোচনা করুন। এতে তো আত্মসমালোচনাই হয়। হয় আত্মশুদ্ধি। দেশ বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। দেশ মানে মানচিত্র নয়। দেশে বাস করলেই দেশকে চেনা যায় না। দেশের নামে অকারণ জয়ধ্বনি করলেই দেশপূজা হয় না। কর্মের মধ্য দিয়েই বহুত্বের বোধ। বহুত্বের অন্য নাম দেশ। সুতরাং পৃথিবীও একটা দেশ। পৃথিবীর সমস্যা লিটল ম্যাগাজিনেরও সমস্যা।
#
লিটল ম্যাগাজিন যেমন বিশেষ প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসী নয়, তেমনি বিশেষ দলের প্রতিও দেখাবে না আনুগত্য। বিবেকের মতো তার ভূমিকা, দল বা সরকার--যে যখন ভুল করবে তার সমালোচনা করবে লিটল ম্যাগাজিন। কেউ বলবেন, সমালোচনার পাশাপাশি প্রশংসা আসবে না! উত্তর : প্রশংসনীয় কাজের লক্ষ্যেই তো তাঁদের ব্রত। উন্নতি ও কাজের চরম সীমা বলে কিছু হয় না। তাই ঘৃণ্য কাজগুলোর সমালোচনায় সরব হবে লিটল ম্যাগাজিন, কিন্তু প্রশংসার নামে বিশেষ দলকে সমর্থনের কথা বলবে না।
ঝ. সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত লাইব্রেরিগুলোতে সংবাদপত্র কেনা হয়। কেনা হয় নতুন বই। জেলার লেখকদের বই ও পত্রিকা কেনা বাধ্যতামূলক করা যায় না! তাহলে তো অন্তত বর্ধমানের কোনও কবির কোনও বই খুঁজে পেতে হলে বর্ধমান গেলেই হবে। রাজ্যের জেলায় জেলায় ঘুরতে হবে না। জেলা বইমেলার লক্ষ্য কী! যদি না জেলার লেখক সম্পাদক পুস্তক বিক্রেতারা উপকৃত হন! কবিরা তো ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা! তাহলে তাঁরা ভবিষ্যৎ লেখক জীবনবীমার কথা ভাববেন না! সংরক্ষণের কথা! আগামী পাঠক বিশেষ বই বা পত্রিকা পেতে চাইলে কীভাবে পাবেন! কোথায় পাবেন! দশ পনের জন সম্পাদক মিলে ওয়েবসাইট বানিয়ে তাঁদের লেখাগুলোকে মহাকাশে সাজিয়ে রাখতে পারেন, যাতে একশ দুশো হাজার বছর বাদেও পাঠক তাঁর প্রয়োজন মতো মহাকাশ থেকে সংরক্ষণ করে পড়ে ফেলতে পারবেন। এই সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ-ভাবনা লিটল ম্যাগাজিনকেই তো করতে হবে। সরকার সরকার করে হাহুতাশ করে নিজেদের দায়িত্ব এড়ালে চলে না। সংরক্ষণাগারের জন্য সরকারের কাছে দরবার করার পাশাপাশি নিজেদের শক্তি দিয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করতেই হবে।
ঞ. লেখক শিল্পীর প্রয়াণে স্মরণসভা, তাঁদের পুনর্পাঠ, পুনর্মুদ্রণ ইত্যাদির মাধ্যমে শেকড়ের টান অনুভব করা সম্ভব। ঐতিহ্যকে অস্বীকার মানে তো নিজেকেও মিথ্যা ভাবা। খুঁজে খুঁজে ভালো লেখা পুনরায় পাঠককে দেওয়া, অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ, ইতিহাসকে বিশ্লেষণ ও পুনরায় আবিষ্কার লিটল ম্যাগাজিনের কাজের অংশ। দুর্লভ সংখ্যার প্রদর্শনী, তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহী করা ইত্যাদিও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের বিষয়।
#
চাইলেও আমরা সমাজের জন্য সমানভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। পরিস্থিতি ও ব্যক্তিত্ব তার জন্য দায়ী। ব্যক্তিত্বের মধ্যে জেগে ওঠে যতখানি প্রবৃত্তি, আবেগ--সেই অনুযায়ী আমরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। এর সঙ্গে শুধু সাহিত্যসেবা নয়, দেশসেবাও যুক্ত। এই চরম সত্য আজও দেশ বোঝেনি। দেশের কেউ কেউ বুঝেছিলেন। যেমন, প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন : সাহিত্য জাতির খোরপোশের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, কিন্তু তাকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
#
অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
#
পত্রিকার আকার বাড়লে সমাজে সম্মান বৃদ্ধি হয় কিছুটা--এটা অস্বীকার করা যায় না। স্বাস্থ্যবান মানুষ সব সমাজেই কদর পান। অবশ্য অকারণ মেদবৃদ্ধিতে অসুখ বাসা বাঁধে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, দশটি প্রবন্ধের মধ্যে চারটি প্রবন্ধ প্রায় এক। সুতরাং ১০০ পাতার মধ্যে ৩০ পাতা মেদ। শরীরের মেদ কমানোর উপায় অনেক। পত্রিকা একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে সেখান থেকে ৩০ পাতা কীভাবে বাদ দেব! প্রায় একই প্রবন্ধ পাঠ করায় পাঠকের যে সময় নষ্ট হল তার দায় সম্পাদককেই নিতে হবে। এই একই সমস্যা ৩০ পাতার পত্রিকার ক্ষেত্রেও ঘটে।
#
লক্ষ সচেতনতা সত্ত্বেও মেদবৃদ্ধি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ১০ কিংবা ২০ বছর অন্তর নির্বাচিত লেখা নিয়ে সংকলন করা যেতে পারে। যে পাঠকদের সময় কম তাঁরা সংকলনটির প্রতি আগ্রহী হবেন। তাছাড়া অনেক ভালো লেখা স্রোতে, ভিড়ে হারিয়ে যায়। সংকলনের মাধ্যমে তাকে উপহার দেওয়া যায় পাঠকের কাছে। সেক্ষেত্রেও খেয়াল রাখা--উপহারটি যেন উপহার হয়। বারবার উপহার বলে ঘোষণা করলাম অথচ পাঠকের যোগ্য সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখলাম না--তাতে ফলাফল শূন্য। পত্রিকায় যখন লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল, তখনকার আবেগ যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু দশ বছর বাদে সংকলন করার সময়ও যদি সেই পুরোনো আকুলতা কাজ করে, দশ বছর সময় যদি সম্পাদককে নিরপেক্ষ না করে তাহলে সংকলন না করাই ভালো। অন্তত দ্বিতীয় ধাক্কা থেকে পাঠক বাঁচবেন!
#
সরকারি বিজ্ঞাপন ও সহযোগিতা লিটল ম্যাগাজিন চাইতেই পারে। তবে সরকারি বেসরকারি যেকোনও সাহায্য প্রত্যক্ষ হলেই মুশকিল। আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল প্রভাবিত, সরকারি বিজ্ঞাপনের অর্থে পুষ্ট। সরকারের সমালোচনায় তাই দ্বিধা। বেসরকারি কোম্পানির বিজ্ঞাপনে লাভবান। সুতরাং কোম্পানির দূষণে সংবাদপত্র অন্ধের ভূমিকা নেয়। রাষ্ট্রনায়ক বিশেষ মন্দির বিশেষ মসজিদে গিয়ে নত হচ্ছেন। আর সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ছে হু-হু করে। ধর্মের নামে তিনিও রাষ্ট্রকে শান্ত রাখতে চান। বলা ভালো, ভোটের লক্ষ্যে তিনিও ধর্মের প্রচারক। অথচ, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়। সে তো কথার কথা। তাই ধর্ম, সরকার, সংবাদমাধ্যম, সংবিধান--সবই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। একই দোষে দুষ্ট। তাই সরকারি কিংবা বেসরকারি সহযোগিতা নিতেই পারে লিটল ম্যাগাজিন, তবে পরোক্ষে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনও বিনিময় না থাকে। যেন না নত হতে হয়।
#
লিটল ম্যাগাজিন আত্মসম্মানবোধে সবসময় সজাগ ও সচেতন।
.............. চলবে
___________________