শাল পাতার ডায়েরি ঃ তিন
অমিত মাহাত
লালপার্টি বনাম লাল কালি
১
কলাবনির ভেতর দিয়ে ঢ্যামনা সাপের পথ। খানা-ডোবা। গাড্ডা। কয়েক কিমি এগিয়ে যান। একটি গ্রাম পাবেন। ঘটিডুবা পেরিয়ে। ল্যাদাবহড়া।
গাঁ হিসেবে বর্ধিঞ্চু। অঞ্চল অফিস। লাল পার্টি।…
শাল পাতার ডায়েরি ঃ তিন
অমিত মাহাত
লালপার্টি বনাম লাল কালি
১
কলাবনির ভেতর দিয়ে ঢ্যামনা সাপের পথ। খানা-ডোবা। গাড্ডা। কয়েক কিমি এগিয়ে যান। একটি গ্রাম পাবেন। ঘটিডুবা পেরিয়ে। ল্যাদাবহড়া।
গাঁ হিসেবে বর্ধিঞ্চু। অঞ্চল অফিস। লাল পার্টি। পার্টির ঝান্ডা। দেওয়ালে দেওয়ালে দা হাতুড়ি। কমরেড অমর রহে। মরে আকাশের তারা। মাহাতো আর সাঁওতাল ঠাসাঠাসি ভাবে। অঞ্চল অফিস হওয়ায় পার্টিবাবুদের আনাগোনা।
হাওয়ায় হুইপ জারি হল। প্রথমত লাল কালির পোস্টার। শ্রেণী শত্রু খতম করুন। প্রথম পোস্টার দেখে হেলু মাহাত। ছাগল চাষি। ভোর ভোর কাটারি নিয়ে শাল ডাল আনতে গিয়েছিল। পালা আনা আর হল না। রীতিমত ভয় পেয়েছে সে। বেলপাহাড়ি লালগড়ে এমন পোস্টার উদ্ধারের আলোচনা অঞ্চল অফিসে শুনেছিল সে। যখন সে বর্ষায় দেওয়াল ভেঙে পড়ায় অঞ্চলে গেছিল। ত্রিপলের ধান্ধায়।
সে পোস্টার এখন নিজের গাঁয়ে। ছাতি তো ঢড়াস হবেই। খবর টা বেলা উঠা দ অব্দি কাউকে জানায় নি। ভয় পেয়েছিল এতটাই।
বেলার দিকে চাউর হল ঘটনা টা। আরও অনেকের নজরে পড়ায় অঞ্চল অফিসে জটলা বাড়ে। জরুরি তলব পড়ল অফিস থেকে। হেলুকে চেঙ দোলা করে তুলে নিয়ে গেল ল্যাদাবহড়া অঞ্চল অফিসে।
রবিলোচন লাল পার্টির নেতা। জনগনের ভোটে পঞ্চায়েত। পদাধিকারবলে অঞ্চল প্রধান। দাপট রয়েছে। এ তল্লাটের মা বাপ। আদেশ করলেন -আগে ব্যটাকে দু ঘা দে। সকালের খবর এখন বাইসাম।
হেলু বলে -ইতে হামার কি দোষ? ছাগল ডাল আনতে যায়েছিলি।
--তো না নিয়েই ঘর ঘুরলিস যে? বনে কাকেও দেখেছিলিস?
--নআই তো। কনঅ দেখি দেখি নাই।
রবিলোচন পুলিসের ভয় দেখায়। কেটে ভেলাই বাগানে পুঁতে দেওয়ার কথা বলতে হেলুর গামছা ঢিলে হয়ে যায়।
--গামছা উঢ়া কাকেও দেখেছিলিস?
--নাই ত। হেলু মাথা নাড়ে।
দিন কতক বাদে ফের পোস্টার পড়ল। এবার পার্টি ছাড়ার। পোস্টারে লেখা - আমি শ্রী ভানু মাহাত। গ্রাম ল্যাদাবহড়া। আমি আজ থেকে পার্টি ছাড়িলাম। লাল পার্টির সাথে কোনরকম সম্পর্ক রাখিব না। জনগনের সাথে দুর্ব্যবহার করিব না। এই মর্মে মুচলেকা দিলাম।
হেলু মাহাত ফাঁপড়ে পড়ল। বর্ষায় দেওয়াল ধ্বসে পড়েছে একপাশে। অন্যপাশ আদ্দা। ওই আদ্দা দেওয়ালে দা হাতুড়ি। রবিলোচন কে ভোটে জেতানোর প্রচার। তার ঠিক উপর বরাবর -'আমি শ্রী ভানু মাহাত 'লাল কালি।
২
পাঁচ বছর বাদে।
এই তো সেদিন। বাবাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে দশ বছরের মেয়ে কুশনি তুলে নিয়েছিল কলম। এ বেশি দিনের কথা নয়। বছর পাঁচেক আগের সেদিন টা আজও দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে। যেমন দাঁড়িয়ে রয়েছে মরচে ধরা টিনের একতলা মাটির বাড়িটা। আজও একইরকম। সে বাড়ি আর তার নড়বড়ে কাঠামো।
ভয়ার্ত কুশনির কাঁপা কাঁপা হাতে লাল কালির অক্ষরে লেখা পোস্টার সেদিন বাঁচাতে পারে নি বাবাকে। গ্রামের শাল জঙ্গলের মাথায় লাল মোরাম রাস্তায় কুশনির বাবা পড়েছিল পিছমোড়া লাশ হয়ে।
সেসব আজ ইতিহাস। এবং কুকীর্তি।
এই পাঁচ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। দশ বছরের কুশনি আজ অনেকটাই বড়। এবারে মাধ্যমিক দেবে। পায়ে হাঁটা মোরাম পথ। যেখানে পড়েছিল বাবার রক্তাক্ত শরীর। রাস্তাটি আজ পিচঢালা। একশ দিনের কাজ হয়। তবে বছরে একুশ দিন। রেশনে সপ্তাহান্তে দু টাকা কিলো চাল। সে চালের ভাত খেয়ে ইস্কুলে যায় কুশনি।
স্কুল থেকে ফেরার পথে কুশনি দাঁড়াল শাল জঙ্গলের ওখানটায়। বাবা তো ওখানেই পড়েছিল...।
এই ক বছরে এত সবুজ হয়েছে জায়গাটা। এত ঘাস গজিয়ে গেল লাল মাটির বুকে! এ গাঁয়ের যে ছেলেটা 'মিটিং আছে 'বলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাবাকে। সে ছেলেটি এবার পুলিসে চাকরি পাবে। এইসব লিখেছে কাগজে।
কুশনির চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে জলে।