Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

লিটল ম্যাগাজিন: অন্তর বাহির - সাময়িকপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন

পর্ব : চার

সাময়িকপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
-------------

কেউ বলতেই পারেন : লিটল ম্যাগাজিন লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিপক্ষ।
#
আসলে সব পক্ষই এক পক্ষ। কেউ কেউ বলি : প্রতিপক্ষ। এই যা। আমার বন্ধুরা আমার সব কাজে প্রশংসা করে। আম…


পর্ব : চার

সাময়িকপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
-------------

কেউ বলতেই পারেন : লিটল ম্যাগাজিন লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিপক্ষ।
#
আসলে সব পক্ষই এক পক্ষ। কেউ কেউ বলি : প্রতিপক্ষ। এই যা। আমার বন্ধুরা আমার সব কাজে প্রশংসা করে। আমার শত্রুরা আমার সব কাজে নিন্দা করে। আমার বন্ধু ও শত্রুরা সমান্তরাল। উভয়ই দু'মাত্রার। উভয়েই এক। তবুও বোকা বোকা বলি : প্রতিপক্ষ। আসলে সব পক্ষই এক। সব পত্রিকাই একটি শব্দবন্ধের নীচে। তার নাম লিটল ম্যাগাজিন। নতুন পত্রিকার জন্ম হলে কেউ কেউ বলেন :  আবার! এ নিশ্চয়ই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফসল। সুতরাং, বিরোধিতা। যদি তাই-ই হয় অর্থাৎ এক পত্রিকা থেকে আরেক পত্রিকার জন্ম হয় তবে বিরোধিতা বরং জন্মলগ্নেই মিটে যায়! কারণ দুটি পত্রিকাই তো এবার থেকে নিজের নিজের প্রচার করে। পাঠককে উৎসাহিত করে। তাহলে প্রচার 'এক' যুক্ত 'এক' হয়ে 'দুই' হয়। 'দুই'-এর সুফল তো দুজনেরই। সুতরাং, প্রতিপক্ষ মানে কিন্তু শত্রুতা নয়।
#
দেখা যায়, এক লিটল ম্যাগাজিনের অসমাপ্ত কাজ অন্য কোনও লিটল ম্যাগাজিন করতে উদ্যোগী হচ্ছে। নতুন করে সূচি নির্মিত হচ্ছে। নতুন সূচি নিয়ে প্রকাশ পেল নতুন সংখ্যা । আসতে শুরু হল অভিমত। সম্পাদক বুঝতে পারলেন অসম্পূর্ণতার দিকগুলো। সম্পাদকের মধ্যে জন্ম নিল প্রতিপক্ষ।  শুরু হল অসম্পূর্ণতা থেকে সম্পূর্ণতার দিকে যাত্রা। তবে সম্পূর্ণ বলে, চরম বলে কিছু হয় না। ফলে বর্তমান সম্পাদকের অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেয়ে যান ২০/৩০ বছর বাদে আর কোনও নবীন সম্পাদক। তিনি আরও গুছিয়ে সম্পাদনা করলেন। একবিচারে, তিনি তো আগের সম্পাদকের  প্রতিপক্ষ। অথচ প্রতিপক্ষ হয়েই আগের সম্পাদকের হয়ে কাজটা করলেন। অর্থাৎ সব প্রতিপক্ষই এক পক্ষ। নদীর একূলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির কাছে সহজেই জন্ম নেয় ও-কূল। কিন্তু নদীতে ভেসে যাওয়া, সংগ্রামী  মানুষটির মূল লক্ষ্য : কূল। এ-কূল, ও-কূল বিভাজন কাজ করে না। লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন আমাদের সজাগ করে। জানিয়ে দেয় আমাদের অস্তিত্ব।
#
 বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার লেখ্যরূপে ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত। বাস্তবটা কিন্তু অন্য। একক স্বরকে বহুতে রূপান্তরের সবচেয়ে ভালো ক্ষেত্র হল লিটল ম্যাগাজিন। ঐক্যের বিকল্প নেই। বহু স্বাধীন স্বরের ঐক্য গড়ে তুলতে পারে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন। কোনও সমাজই চায় না--সব মানুষ চিন্তাবিদ হয়ে উঠুক। চায় না সবাই তার নিজের স্বাধীন মতকে প্রকাশ করুক। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের স্বাদ বড়ই প্রাচীন, লোভনীয়। লিটল ম্যাগাজিন বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী।
#
কীভাবে আসবে বিকেন্দ্রীকরণ! লড়াই-র মধ্য দিয়ে। কার সঙ্গে লড়াই! নিজের সঙ্গে। লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই তার নিজের সঙ্গে।
#
ক্ষুদ্র পত্রিকা, ছোটো পত্রপত্রিকা ইত্যাদি নানান প্রতিশব্দ থাকলেও বহুল ব্যবহারে ও চরিত্রগত বিশেষ দিককে গুরুত্ব দিতে গিয়ে লিটল ম্যাগাজিন শব্দটিই বেশি গ্রহণীয়, আজও। আক্ষরিক অর্থে সামান্য। 'সাময়িকপত্র' নাম নিয়ে বাংলা পত্রিকার যাত্রা শুরু। যতদিন গেছে, ততই আক্ষরিক অর্থ ছাড়িয়ে সামায়িকপত্রের একটি ধারা ব্যঞ্জনার দিককেই একমাত্র আশ্রয় করেছে। অর্থাৎ যাকে বলছি তুচ্ছ, ছোটো--আসলে তা ছোটো নয়, সামান্য নয়। এ কথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য পৃথিবীর যে কোনও ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। তবে শব্দটির 'ব্যঙ্গ্য' প্রতিষ্ঠা পেতে কিছু সময় লেগেছে। আক্ষরিক অর্থের মাত্রা সংখ্যা এক, ব্যঙ্গ্য তথা ব্যঞ্জনা কিন্তু বহুমাত্রিক। এটি সুবিধেও বটে, অসুবিধেও। সুবিধে হল, বহুমাত্রিকতার কারণেই লিটল ম্যাগাজিনের বিষয়বৈচিত্র‍্য ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরণ। অসুবিধের দিক হল, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ও সময়কে ধরতে না পারলে কিংবা অতীতমুখী হলে আক্ষরিক অর্থকেই আশ্রয় করতে চায়। অর্থাৎ তখন লিটল ম্যাগাজিন তার নিজস্ব মেজাজ হারিয়ে শুধুমাত্র ম্যাগাজিন বা পত্রিকা।
#
এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে দুটি রূপ পাচ্ছি--১. আক্ষরিক অর্থে লিটল ম্যাগাজিন বা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন। ২. নিজস্ব মেজাজ নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন।  প্রথম রূপ নিয়ে প্রত্যাশা কম, আক্ষেপ বেশি। দ্বিতীয় রূপে প্রত্যাশা যেমন বেশি তেমনি ধর্মচ্যুত হলে তার চরিত্র নির্ণয় অসাধ্য। চরিত্র ও মেজাজ ধরে রাখতে একসময় যে লড়াই ছিল বড় কাগজ তথা বাণিজ্যিক পত্রিকার সঙ্গে এখন কিন্তু তা নয়। তবে লড়াইটা চলছে। বর্তমানের লড়াই তার নিজের সঙ্গে।
#
J.C Marshman- এর ' The Life and Times of Carey, Marshman, and Ward' (London1859) তথা শ্রীরামপুর মিশনের ইতিহাস গ্রন্থ অনুসরণে বলা চলে প্রথম সাময়িক পত্র 'দিগদর্শন'(১৮১৮,এপ্রিল)। 'দিগদর্শন'-কে লেখক বাংলার প্রথম 'লিটল ম্যাগাজিন' বলে উল্লেখ করেছেন ওই গ্রন্থে। তবে আজকের মতো সে-সময় পত্রিকার এত চরিত্র বৈচিত্র‍্য ছিল না। তখন ছিল জন্মলগ্ন। 'সাময়িক পত্র' নামকরণই তখন একমাত্র। সেই বিচারে বলা যায়--সম্ভবত ক্ষুদ্র ও সাময়িকপত্র রূপে আক্ষরিক অর্থেই 'লিটল ম্যাগাজিন' শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী সময়ে যে অর্থে ও লক্ষ্যে লিটল ম্যাগাজিন শব্দটির বহুল প্রচার হয় সে অর্থে হয়ত নয়। তিনি এও উল্লেখ করেছেন, প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সংবাদপত্র: 'সমাচার দর্পণ'(১৮১৮, ৩১ মে থেকে)। তবে, প্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর (১৮৩৯)। ভারতীয় কর্তৃক ভারতীয় ভাষায় এটিই প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।
#
 ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যভাষার প্রচলন। তার আগের ৮০০ বছর কেটেছে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, অনুবাদ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদিতে। অর্থাৎ সবই ছিল কাব্য। তখন বাংলা সাহিত্য মানেই ওই কাব্য। ১৮০০-র পরে গদ্যভাষা চালু হলে, বাংলা সাহিত্যে এল গদ্যসাহিত্য। এই গদ্যসাহিত্যকে পুষ্ট করেছে সে সময়ের সাময়িকপত্র। ১৮১৮ তে শুরু হল বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র 'দিগদর্শন'(মাসিক)। ক্রমে প্রকাশ পায় 'সমাচার দর্পণ', 'সম্বাদ কৌমুদী', ' সমাচার চন্দ্রিকা' ইত্যাদি। এগুলি লিটল ম্যাগাজিন নয়। সাময়িকপত্র। সময় বিশেষে ঘটে তথা অল্পকালস্থায়ী এমন বিষয়ই মূল লক্ষ্য 'সাময়িকপত্র'-র ক্ষেত্রে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন চাইল সমকাল ও ভবিষ্যতকে জয় করতে। স্বাভাবিক কারণে তার লড়াই-র অনুশীলন শুরু হল সাময়িকপত্রের সঙ্গে, বড় কাগজ তথা বাণিজ্যিক কাগজের সঙ্গে। এই লড়াইটা শুরু হয়েছে সময়ের দাবি মেনেই। তাই আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)-ই প্রথম বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন শব্দটি ব্যবহার করেন। স্বাভাবিক কারণে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' (১৯৩৫) ও পরবর্তী বিশেষ কিছু পত্রিকাকেই লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে আমরা ধরতে পারি। যদিও বুদ্ধদেব বসু প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র'(১৯১৪) পত্রিকাকেই বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলেছেন।
#
প্রথম দিকের পত্রিকা তথা সাময়িকপত্রে সংবাদ, ধর্ম, সমাজসংস্কার ইত্যাদিই ছিল মূল বিষয়। সাহিত্য প্রায় ছিল না। সময়কে জয় করতে চাই কল্পনায় ভর করে সৃষ্টিশীল সাহিত্য। স্বাভাবিক কারণেই লিটল ম্যাগাজিন সৃজনশীল সাহিত্যকে গুরুত্ব দিল। এই বিচারে 'সংবাদ প্রভাকর'(১৮৫৩)-এর মধ্যেই প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণ দেখি। ১৮৩১ সালে কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদনা করেন 'সংবাদ প্রভাকর'। ১৮৫৩ সালে প্রকাশ পায় ওই পত্রিকার মাসিক সংস্করণ যা প্রথম সার্থক সাহিত্য পত্রিকা। তবে শুধু সাহিত্য নির্ভরতাই যদি শেষ কথা হয় তাহলে তো সাহিত্য পত্রিকা নামকরণটিই সুপ্রযুক্ত হত। তাহলে 'লিটল' শব্দ মাধ্যমে ব্যঙ্গ প্রকাশ কেন! এককথায় উত্তর : এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদী স্বভাব। এই প্রতিবাদ একক স্বরের মাধ্যমে নয়। এক বিশেষ গোষ্ঠীর। সুুুতরাং লিটল ম্যাগাজিন হল বিশেষ লেখকগোষ্ঠীর গোষ্ঠীচেতনায় বিশ্বাসী এবং সাহিত্যনির্ভর। পাশাপাশি, চরিত্র গুণেই বড় প্রতিষ্ঠানের বিপরীত। (১৮৫৩) 'সংবাদ প্রভাকর'-এর মাসিক সংস্করণকে কেন্দ্র করে দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র, রঙ্গলালদের নিয়ে বিশেষ লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তবে চরম যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রতিবাদ লক্ষ করা যায় 'সবুজপত্র'(১৯১৪) পত্রিকায়। চলিত ভাষাকে মর্যাদা তথা বাংলা গদ্য ভাষার জন্মান্তর ঘটে এই সবুজপত্র-র হাত ধরেই। 'কবিতা' আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রভাবনা থেকে সরে নতুন আবহাওয়া-র জন্ম দিতে সচেষ্ট হয়েছিল 'কল্লোল'। এ পত্রিকাগুলির স্বতন্ত্র স্বভাব-চরিত্র-মেজাজ ছিল। নিজস্ব চরিত্র নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই আজও বহু লিটল ম্যাগাজিন করে যাচ্ছে।
#
লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন-ই।
________________