Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শাল পাতার ডায়েরি ঃ চার

শাল পাতার ডায়েরি ঃ চার

অমিত মাহাত
------------


রাতের নির্দেশনামা

নিমডিহা  যাওয়ার পথে শিমুল গাছটির তাগড়াই ডালটি  কেটে ফেলা হয়েছে রাস্তায়।মহুয়া চকে  তখন ইউক্যালিপটাস কাটা চলছে। গ্যাঁড়াশোল কুশবনীতে  চলছে রাস্তা অবরোধের প্রস্তুতি। র…

শাল পাতার ডায়েরি ঃ চার

অমিত মাহাত
------------


রাতের নির্দেশনামা

নিমডিহা  যাওয়ার পথে শিমুল গাছটির তাগড়াই ডালটি  কেটে ফেলা হয়েছে রাস্তায়।মহুয়া চকে  তখন ইউক্যালিপটাস কাটা চলছে। গ্যাঁড়াশোল কুশবনীতে  চলছে রাস্তা অবরোধের প্রস্তুতি। রাত ক্রমে গাঢ় হচ্ছে।

লালগড়ে ভয়ঙ্কর রকমের ঘটনাটি ঘটে গেছে মাস কয়েক  আগে। নভেম্বরের একটি রাতে। ছিতামণির চোখ কানা করে দেওয়া হয়েছে। গর্ভস্থ সন্তান জন্মানোর আগেই পুলিশের লাথ খেয়ে মরল।  দু হাজার আট। মাঝি মাডওয়ার পক্ষ থেকে তার পরে পরেই অবরোধের সারজম গিরা বার্তা এসে পড়েছে প্রত্যেকটি আদিবাসী গ্রামে। ওদের নেতা নিত্যানন্দ হেমব্রম। সেই কথা মতো অবরোধ শুরু হয় দহিজুড়িতে। মাঠে পাকা ধান। ধান কাটা ফেলে  মানুষ শামিল হয়েছে আন্দোলনে। গাছ কাটা শুরু। মাঝি মাডওয়ার পক্ষ থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয় পরে। ধান কাটা মিটলে ফের আন্দোলন করা হবে। এমন কথা বলতে শুরু করেন সমাজ নেতারা।

আন্দোলনের এমন আশ্চর্য  ছন্দপতনে  খুশি ছিল না লালগড়। দলিল পুর চক খুশি ছিল না মাঝিদের এমন আচরণে। এগারো দফা দাবি বেড়ে উনিশ দফা। পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়ার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দেন। আন্দোলন তুলে নিতে বলেন। ততক্ষনে কমিটি গঠন পর্ব শেষ। দলিলপুর চকে ঠিক হল নেতৃত্ব কে দেবে।

ছত্রধর মাহাত'র নাম প্রস্তাব করলেন। শিক্ষক ক্ষেমানন্দ মাহাত। ঠিক হল কমিটির মুখপাত্র থাকবেন ছত্রধর। কমিটির খসড়া তৈরি হল। লাল মোহন টুডু।  তরুন তুর্কি সিধু সোরেন।
আরও কয়েকজন যুবা দায়িত্ব পেল। ঘোষিত কর্মসূচি। অবরোধ। এবং প্রতিরোধ।

ভয়ঙ্কর শীতের বিকেল। বড় তাড়াতাড়ি ফুরোবার মতলবে।  শীতের দাপট। হাওয়া এখন উত্তুরে। উত্তরে কাঁসাই নদী। আরও উত্তরে লালগড়। দলিলপুর চক। হাওয়ায় ভেসে এসেছে নির্দেশ নামা। সেই মত আমরা। বালিজুড়ী। কয়মা। আঙ্গার কুড়িয়া। ভাদুই। এবং জামুই। জড়ো হয়েছি। কয়েকজনকে পাঠানো হল খাটকুরা সীমানায়। সেন্ট্রি।
টর্চ জ্বালানো যাবে না। একে অপরের মুখ গামছায় আড়াল।

অন্ধকারে আমরা। প্রত্যেকেই ছায়া।  ফরমান জারি। নিজ গ্রাম নিজেরাকেই পাহারা দিতে হবে। লাল পার্টির গতিবিধি। হার্মাদ। থানা পুলিস। প্রত্যেকের চলনবিলন।
ডি এস পি'র গলা শোনা গেল। এবং আদেশ। - কমিটি এবং দাদাদের নির্দেশ। প্রথমে সেন্ট্রি বাহিনী। সেন্ট্রি দেবে গ্রামের সীমান্তে। সপ্তাহে একদিন করে পাহারা দিতে হবে গ্রাম। যুবাদের হাতে থাকবে তির ধনুক। টাঙ্গি। লাঠি। আগামীতে এরায় যোগ দেবে গন মিলিশিয়ায়। গন মিলিশিয়ার কাজ। হার্মাদের মোকাবিলা। দাদাদের নির্দেশ মতো চলতে হবে।

বিনয় অবতার আজ মদ খায় নি। খেলে অবতার। কমিটির নেতৃত্বে ডি এস পি। ওরফে। থাগ গে। সে প্রসঙ্গ পরে। ডি এস পি'র মুখের কথার সূত্র ধরে অবতার বিনয়ী ভাষায় বলতে শুরু  করল -কোন কোন ঘর আসে নাই লিস্ট টা শোনা তো। বালিজুড়ীর কে কে আসে নাই? হাঁদু আসিছে? সাগর? আঙ্গার কুড়িয়ার কে কে আসে নাই? ডিলার ঘরের কেউ নাই ত? জগদীশ? ভাদুই? নারান মান্ডি? ললিত? খাটকুরা কেউ নাই ত?

আমরা প্রত্যেকে চুপ।ততোধিক চুপ রাতের প্রকৃতি।   কংসাবতী ক্যালেন ডাহি। জানি না আজ রাতে কী লেখা হচ্ছে? ঘরে ফিরব কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। ফিরলেও কীভাবে ফিরব? তারও ঠিক নেই। কোন অবস্থার দিকে আমরা পা বাড়াচ্ছি সত্যিই জানি না। এটুকু বুঝছি  যেকোনও দিন খেলা থেমে যেতে পারে।

নির্দেশ এল। বুলেট আসছে। দহিজুড়ি অঞ্চল স্কোয়াড। ডি এস পি বলল 'হাঁটা শুরু করো। চলো শঙখহার।  দহিজুড়ি ফরেস্ট অফিস ভেঙে ফেলা হবে। আজ রাতেই। অন্য একটি দল ফুল বেড়িয়া রথবেড়া কুলডিহা থেকে দহিজুড়ি তে অবস্থান করছে। লাল পার্টির পার্টি অফিসের তাল ভাঙা শেষ। -লাল পার্টির কালো হাত ভেঙে দাও। গুঁড়িয়ে দাও।
টর্চ জ্বালানো বারন।

আমরা হাঁটছি। ক্রমে ঢুকে যাচ্ছি বনের গভীরে। জোনাকিও আলো জ্বালাতে চাইছে না। পাছে বকুনি দেয়। কিংবা অস্ত্র তাক করতেও পারে এই ভয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ভুলে গেছে আওয়াজ দিতে। আওয়াজ তো নয়। গলা ছাড়িয়ে গান শোনানো। রাত্রিকে শোনানো। রাত্রিও শুনতে চাইছে না কিছু। -নাই নাই আমি কিছু শুনি নাই। কিছু দেখি নাই। আকাশে চাঁদ একফালি উঠল তারপর। ধারালো শান দেওয়া বাঁকানো রাম দা'র মতো উজ্বল চাঁদ চলেছে। আমাদের সাথে।
হেঁটে চলেছি। শব্দ নেই। কথা বলা নেই। কাশি পেলেও চেপে রাখতে হবে। পেচ্ছাপ পেলেও চেপে রাখতে হবে। মোতা যাবে না। হেঁটে যেতে হবে। পুরো রাত্রি জুড়ে। পাথরে জোর হোঁচট খেয়ে যদি পায়ের নখ উপড়ে যায়। কিংবা যদি কাঁটা ফোটে। কষ্ট যা সবই চেপে রাখো। হেঁটে যাও। হাঁটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও কাজ নেই।

গাঁয়ের পাচজন যেদিকে যাবে। আমি তুমিও সেদিকে। জগদীশের পিঠে ঘা পড়ে যায়। লাল পার্টি ছাড়তে হবে। নারান মান্ডিকে তুলে আনা হয়েছে। মিটিংএর খবর পেয়েও দরজা এঁটে ঘুমিয়ে ছিল।  আসে নি। ঘা কতক তাকেও হজম করতে হয়।

লাঠিয়াল বাহিনী টগবগিয়ে ফুটছে। সব আমাদেরই ভাই দাদা। হাঁটায়  সামান্য দোষ পেলেও লাঠি উঁচিয়ে ঘা কতক পিঠে পড়ে যাবে  তৎক্ষনাৎ। ঘা সহ্য করে যাও। কঁকিয়ে উঠলে পুরো বাহিনী হামলে পড়বে। এমনই নির্দেশ। আমরা হাঁটতে থাকি। যেভাবে হাটের পাইকার খেদিয়ে নিয়ে যায় হাটের গোরু কাড়া। পেছনে পৈনা ডাঙ। ছন্দ কাটলেই ঘা।  এই ঘা টিও লেখা রয়েছে রাতের নির্দেশ নামায়।