Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শর্ট ফিল্মে কি কবিতা লেখা হবে ?

শট ফিল্মে কি কবিতা লেখা হবে ?
অচিন্ত্য নন্দী (কবি, চলচ্চিত্র আলােচক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা)।
-------------------
সাহিত্যের আঙিনায় লিটিল ম্যাগাজিন' - এই শব্দবন্ধের আজ আর কোন বাংলা হয় না। এটা বাংলা কথা হয়ে
একই ভাবে শর্ট ফিল্ম…


শট ফিল্মে কি কবিতা লেখা হবে ?
অচিন্ত্য নন্দী (কবি, চলচ্চিত্র আলােচক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা)।
-------------------
সাহিত্যের আঙিনায় লিটিল ম্যাগাজিন' - এই শব্দবন্ধের আজ আর কোন বাংলা হয় না। এটা বাংলা কথা হয়ে
একই ভাবে শর্ট ফিল্ম কথাটারও কোন বাংলা হয় না। ছােট ছবি’ ‘স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি' কথাগুলিও আজ
গরও মখে সেভাবে উচ্চারিত হতে শােনা যায় না। নাম নিয়েই বা এত কথা কেন ? মহামতি উইলিয়াম।
শেকসপীয়ের সাহেব তাে সেই কবেই বলে গেছেন - ‘গােলাপকে যে নামেই ডাক...'। আমার মনে কিন্তু প্রশ্ন জেগে
থাকে, এই নামের জন্যেই কি বয়স ও মান বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও লিটল ম্যাগাজিন' ছােট পত্রিকাই থেকে গেল ?
অনেকেই আবার মনে করে থাকেন – “লিটল ম্যাগাজিন’ হ’ল বড় পত্রিকার বি-টিম। তাহলে কি চলচ্চিত্রের মতন।
সাহিত্যেরও ‘মেইন স্ট্রীম' আছে ? চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে ‘পূর্ণ দৈর্ঘ্যের’ (!) চলচ্চিত্র নিয়ে হৈ চৈ একটু বেশিই হয়।
সুকুমার রায় তার 'আবােল তাবােল' গ্রন্থে লিখেছিলন ‘গন্ধ শুঁকে মরতে হবে... ?
একই ভাবে,যখন দৈর্ঘ্যের সামান্য হেরফেরে কোন ছবি চলচ্চিত্র উৎসবগুলির প্রতিযােগিতা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত
হতে পারে না, তখন সেই ছবিটির নির্মাতার ব্যথিত হৃদয়ে হয়ত ধ্বনিত হয় - দৈর্ঘ্যে মেপে সরতে হবে ? তবে, শুধু
আমাদের দেশে কেন, সারা বিশ্বজুড়েই পৃথক শর্ট ফিল্ম চলচ্চিত্র উৎসব বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেখানে শর্ট ফিল্ম
মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
রাে কারাে মনে হতেই পারে ‘সিনেমার আলােচনায় সাহিত্যের এত অবতারণা কেন'? বলতে দ্বিধা নেই
সিনেমাকে আজও সেভাবে কবিকথিত ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার’ অধিকার দেওয়া হয়নি। মেইন স্ত্রীম’ সিনেমা
আজও আমাদের দেশে উপন্যাস বা গল্পের বা প্লটের হাত ধরে হাঁটি
হাঁটি পা পা...'। কিন্তু কখনই'...যেখানে খুশি চলে যা’ নয়।
আজ থেকে প্রায় বছর পঁয়তিরিশ ছত্রিশ আগে আমরা যখন
ফিল্ম সােসাইটির ছত্রছায়ায় সিনেমা নিয়ে ভাবনা শুরু করি, তখনই।
কিন্তু ফরাসী কবি, চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালােচক জ ককতাে-র
লেখায় পড়ি - যেদিন ঝর্ণা কলমের দামে ক্যামেরা আর লেখার
কাগজের দামে সেলুলয়েড ফিল্ম রােল পাওয়া যাবে - সেদিনই
সিনেমায় শিল্পসৃষ্টি সম্ভব হবে'। ঐ ককভাের সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ
যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ছিল।
পাঠক জানেন, বাংলা ভাষায় ‘শিল্প’ শব্দটির দুটি পৃথক
ইংরেজী অর্থ হয় - আর্ট’ আর ‘ইন্ড্রাষ্ট্রি'। আজও অনেকে
সিনেমাকে ‘ইন্ডাষ্ট্রি' (Industry) নামে ডাকতে ভালবাসেন, হয়ত
Big House সিনেমার ব্যাপক কারিগরী ও বাণিজ্যিক দিকগুলির
দিকে তাকিয়ে ভেবে দেখলে, ভাস্কর্য বা চিত্রকলারও অল্প হলেও
একটা কারিগরি দিক থাকেই। এগুলিকে অবশ্য Small Industry.
(ক্ষুদ্র শিল্প) বলা হয় না।
জঁ ককতাে
| যাই হােক, জ ককতাের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে কখনও বাস্তবে রূপায়িত হবে তা হয়ত তিনি নিজেও স্বপ্নেও
ভাবেন নি। যে সময়ে আমাদের দেশে মাইলের পর মাইল জনবসতি পরিক্রমা করলেও একটা টেলিফোনের দেখা
মিলতাে না, সেখানে কোন দিন যে জনে জনে হাতে হাতে মােবাইল ফোন ধরা থাকবে, তা কিন্তু সেদিন কারাে
কল্পনাতেও আসেনি। আর ভাবা যায়, সেই ফোনে সিনেমা দেখাও সম্ভব হবে। স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হ'ল। এখন প্রশ্ন
একটাই, জঁ ককতাে কথিত সিনেমা কি এবার শিল্প (Art) হয়ে উঠবে ? কিন্তু শর্ট ফিল্মের ক্ষেত্রে পড়ে পাওয়া চোদ্দো
আনা হ’ল - সিনেমায় পরিবেষন (Distribution) নামক প্রতিবন্ধকতার হাত থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি।
| সব সিনেমা যেমন আর্ট ফিল্ম (Art Film) হয়ে ওঠে না, তেমনি সব শর্ট ফিল্মও আর্ট হাউস সিনেমা হয়ে ওঠে
। এখনও পর্যন্ত শর্ট ফিল্মের কোন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। এমনকি শর্ট ফিল্মকে যে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই
থাকতে হবে, তাও কিন্তু নয়। 'কল্পনিৰ্বর ফাউণ্ডেশন’ প্রতি বছর ১লা নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর ম্যাক্সমুলার ভবনের
প্রেক্ষাগৃহে শর্ট ফিকশন ফিল্ম ফেস্টিভাল (Short Fiction Film Festival)-এর আয়ােজন করে থাকেন, গত বছর যা
পনেরাে বৎসরে পদার্পণ করলাে। সেই উৎসবে ভারত, স্পেন, জাপান, ইংল্যাণ্ড, চিন, ইউ.এস.এ., অস্ট্রেলিয়া,
রাশিয়া ইত্যাদি পৃথিবীর বহু দেশের শর্ট ফিল্ম দেখানাে হয়ে থাকে। দেখেছি, এই উৎসবের ছবিগুলি সাধারণত: দুই
মিনিট, সাত, আট, দশ, বারাে, সতেরাে ইত্যাদি মিনিট সময়কালের। আবার কোন কোন ছবি পঁচিশ কি ছাব্বিশ
মিনিটেরও হয়ে থাকে। এই উৎসবে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রদর্শিত ও নির্মিত ছবিগুলি দেখলে শর্ট ফিল্ম সম্বন্ধে দর্শকমনে
একটা ধারণা গড়ে ওঠে। ২০১৪ সালে প্রদর্শিত ভারতীয় ছবি 'চক'-এর কথাই ধরা যাক, যা আমার আজও মনে
আছে। বছর তিনেকের শিশু তার প্রথম দিনের ইস্কুল চত্বরে সবার অলক্ষ্যে অপটু হাতে চক নিয়ে এক নারীর ছবি
এঁকে ফেলে। কিন্তু ইস্কুলের প্রহরীদের তাড়নায় সে কাদতে কাঁদতে ছবিটির ওপরে ঘুমিয়ে পড়ে। আঁকা ছবিটি কি তার
মায়ের, যাকে সে এই প্রথমবার বাড়িতে ছেড়ে এসেছে ? এই ছবিটি দর্শকমন এক অদ্ভুদ বিষাদ অনুভবে ভরিয়ে
তােলে। ছবিটির সময়সীমা দুই মিনিট দশ সেকেণ্ড। এই উৎসবে পরদিন দেখেছিলাম ফরাসী ছবি Disaffection, যে
ছবিটি ভবিষ্যৎ সময়ের। ডাক্তারদের টিম (Team)এর হাতে আসেন এমন এক রােগী, যিনি যে রােগে আক্রান্ত, সেই
রােগটির নাম 'ভালবাসা' (Love)। ব্যাপক হারে টিকা প্রদানের ফলে বহুকাল পূর্বেই রােগটি জনজীবন থেকে নির্মূল
হয়ে গেছে। পুনরায় এই রােগে আক্রান্ত রােগীর সন্ধান পেয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেই চিরতরে রােগটির বিলােপ সাধনে তৎপর
হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন Vaccine (টিকা) রােগীটির ওপরে প্রয়ােগ করে দেখা হয় কোন্ টিকা এই 'ভালবাসা নির্মূলকরণ
কর্মসূচী'তে কার্যকর হবে। এই শর্ট ফিল্মটি সতেরাে মিনিটের। কিন্তু তা অনেক সময় জুড়ে দর্শকের ভাবনার দখল নিয়ে
নেয়। ভাবনার এই সময়টুকুও কি ছবির সতেরাে মিনিট সময়সীমার সঙ্গে জুড়ে যাবে ?
দর্শকের সময় কমে গেছে আর সময়ের দাম বেড়ে গেছে। আজকাল খুব কম পাঠকই উপন্যাস, ছােট গল্প পড়ে
উঠতে পারেন। পাঠ শুরু করলেও শেষ করা যায় না। তুলনায়, কবিতা অনেক পাঠকই পড়ে ফেলেন যেহেতু সময়
কম লাগে। কবিতা যেন ভাবনার ক্যাপসুল। খুব অনায়াসেই গিলে ফেলা যায়। তারপর ভাবনারা ভেতরে ভেতরে
কাজ করে যায়। এখনকার দর্শকদের মধ্যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি দেখার সময় বা ধৈৰ্য্যও খুব কমে গেছে। একের পর এক
সিনেমা গৃহের অবলুপ্তি, যা এক সময় ছিল সামাজিক মিলন ক্ষেত্র - এটাও শর্ট ফিল্মের উঠে আসার একটা কারণ
হিসেবে ধরা যেতে পারে।
গত বৎসর নন্দনের প্রেক্ষাগৃহে ফেডারেশন অব ফিল্ম সােসাইটিজ (পূর্বাঞ্চল) আয়ােজিত শর্ট ফিল্মের প্রদর্শন
অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি উন্নতমানের চলচ্চিত্র। বেশিরভাগ ছবিই সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিসন
ইনস্টিটিউটের (SRFTI) এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের তৈরী। ছবিগুলির কারিগরি নির্মাণ
কৌশল যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে, যা শর্ট ফিল্ম নির্মাণে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। এই অনুষ্ঠানে দেখা ‘সি.সি.টি.ভি
নামের ছবিটির কথা এখনও মনে আছে। একজন বয়স্ক মানুষ কঠিন রােগে আক্রান্ত হয়ে হারিয়েছেন তার শারীরিক
ক্ষমতা এবং বাকশক্তি। কিন্তু তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি অটুট রয়েছে। তারই চোখের সামনে তার পরিবারের
সদস্যরা, স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ যেসব কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, তা তার সহ্যের সীমার অতীত। কিন্তু নীরব দর্শক হয়ে
থাকাটাই তার পক্ষে বাধ্যতামূলক। আর কোন উপায়ান্তর নেই।
| বেশিরভাগ শর্ট ফিল্মে দেখেছি, এক একটা বিশেষ বার্তা ছবিটিকে ছাড়িয়ে চলে যায়। চলচ্চিত্রটির দর্শকের।
কাছে এই বার্তা গ্রহণযােগ্য হতেই পারে, আবার একই সঙ্গে তা শিল্পের (Art) পরিপন্থীও হয়ে উঠতে পারে। দেখা
যাচ্ছে, কম খরচে কম সময়ে কম আয়াসে তৈরী করা গেলেও শর্ট ফিল্ম নির্মাণ কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। শর্ট ফিল্ম
নির্মাণের সময় পরিচালককে সচেতন থাকতে হয় ছবিটি যেন মেইন স্ট্রীম’ সিনেমার পকেট সংস্করণ না হয়ে উঠে।