লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
পর্ব : পাঁচ
পুনর্মুদ্রণ ও ভাষাচর্চা
লিটল ম্যাগাজিন বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী। তার বহুস্বর। তবে ভালো লেখার নির্বাচন চাই। চাই সেই সব লেখার পুনর্মুদ্রণ। ফলে লেখার বৈচিত্র্যও থাকল …
লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
পর্ব : পাঁচ
পুনর্মুদ্রণ ও ভাষাচর্চা
লিটল ম্যাগাজিন বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী। তার বহুস্বর। তবে ভালো লেখার নির্বাচন চাই। চাই সেই সব লেখার পুনর্মুদ্রণ। ফলে লেখার বৈচিত্র্যও থাকল আর আদরণীয় লেখাগুলো পুনর্মুদ্রণের মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছনোর সুযোগও তৈরি হল। সেই সঙ্গে পুনর্মুদ্রণের সংস্কার ও দ্বিধা কাটিয়ে আমরা পাব কালজয়ী লেখকদের লেখা। পুনর্পাঠ। পিছুটান ।
#
দেশ ও জাতির শেকড়ের সন্ধান পেতেও চাই পুনর্মুদ্রণ। শেকড়ের সন্ধান না পেলে বিবর্তনকে ধরব কী ভাবে!
#
নিছক সাহিত্য নয়, ভাষাচর্চাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করছে লিটল ম্যাগাজিন। ভাষা প্রসঙ্গে আমরা আজও কুসংস্কারবদ্ধ। এখনও তাই বিষয় অনুযায়ী ভাষা গড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানের ভাষা রসময় নয়। রোমাঞ্চিত হই না ইতিহাসের ভাষাতে। অঙ্কের অধ্যাপকের ধারণা ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানান ব্যবহারে তাঁর অধিকার আছে। ভাষা চর্চার নামে যে ব্যাকরণ বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, তার বিষয় ও রীতি মধ্যযুগের, রসহীন। এমনই জটিল যে তাকে বুঝতে আরেক ব্যাকরণ চাই।
#
ভাষা মানে আমরা বুঝি, শুধুমাত্র সাহিত্যের বাংলাভাষা, যা একান্তই ব্যাকরণ বই ও সিলেবাস নির্ভর। আসলে চাই ভাষা প্রসঙ্গে নতুন উদার চেতনা। চাই সরস ব্যবহারিক ব্যাকরণ। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান বিষয়গুলোরও ভাষাচর্চা প্রয়োজন। না হলে ইতিহাস পড়ে পুরোনো রহস্যে রোমাঞ্চিত হওয়ায় বদলে মনে হয় সব পুরোনো, মৃত। ভূগোলের ভাষায় ফুটে ওঠে না প্রকৃতির চিত্রকল্প। শুধুমাত্র বাংলা ও ব্যাকরণ চর্চা করলেই বাংলা ভাষা টিকবে না। মাইক বাজিয়ে শহিদবেদিতে ফুল দিলেই ভাষা টিকবে না। সংস্কার করতেই হবে স্কুল কলেজের সিলেবাস। আবশ্যিক করতেই হবে সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের ভাষাচর্চা। যাতে ইতিহাস বই পড়ে তরুণ পাঠক গা ছমছমে অনুভূতি পায়। বিজ্ঞানের ভাষাতে যেন থাকে বিস্ময়। সাধারণ ধারণা, বিজ্ঞানের অধ্যাপকের ভাষাজ্ঞান জরুরি নয়। অথচ, তিনিও তো ভাবই প্রকাশ করতে চান। বিষয়কে এক থেকে বহু করতে চান। কী করে করবেন! নির্দিষ্ট দিশা নেই। তাছাড়া ব্যক্তিত্ব প্রকাশেও প্রয়োজন ভাষাজ্ঞান। শিক্ষক অধ্যাপক যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরতে চান--তার রীতি পদ্ধতি যে ভাষাচর্চা ও জ্ঞানের মধ্যে লুকিয়ে আছে তা আমাদের সরকার কবে বুঝবে!
#
এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম শীর্ষ অভিযান। পৃথিবী জুড়ে। আদিকাল থেকেই, বিজ্ঞান ও কুসংস্কার পাশাপাশি। একইভাবে ভাষাবিজ্ঞান ও ভাষা প্রসঙ্গে ছুৎমার্গ সমান্তরাল। আজও। সুইডিশ ভাষা ঈশ্বরের আর ফরাসি ভাষা শয়তানের, এমন যুক্তিহীন ধারণা আজও আমরা বহন করি অন্য অন্য ভাবে। তাই, বিজ্ঞানের শিক্ষক-অধ্যাপক হওয়া এক, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া আর এক। তাই বিজ্ঞানে স্নাতক নন এমন একজন কৃষকের কাছে মাদুলি কুষ্ঠির গুরুত্ব নাও থাকতে পারে, পাশাপাশি জড়বিজ্ঞানের অধ্যাপকের দশ আঙুলে আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা ভরসা জোগাতে পারে মন্ত্রপূত আংটি। আমাদের সমাজে এই কৃষক ও অধ্যাপক সমান্তরাল। সংস্কার ও না-সংস্কারের এই অনুপাত যখন ভেঙে যায় তখনই সমস্যা হয়। অনুপাতের অঙ্কে আজকের বাংলা ভাষা সংকটময়। আজও, বিজ্ঞানের অন্তর্গত করে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিইনি। তাই, সঠিক সংস্কারের অভাবে সে অন্ধকার ঘরে একা। বিতত বিতংসে পড়ে জটিল। কোনও এক ভাষায় জন্ম নিয়ে সেই ভাষাকে লালন পালন করা যথার্থ সম্ভব হয় তখনই, যখন সেই ভাষাকে সেই সমাজসংস্কৃতির অভিন্ন করে দেখতে পারি। প্রাদেশিক ভাষা ওড়িয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির থেকে আজও ইংরেজি শব্দ প্রয়োগে আমাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়। আত্মা শান্তি পায় কি না সে অন্য বিতর্কের বিষয়। 'আমি দেখছি বাট ঠিক দেখতে পাচ্ছি না।' 'বাট' শব্দের বদলে এখন 'কিন্তু' কিংবা 'অথচ' শব্দকে ফিরিয়ে আনার প্রার্থনা করতে হবে! উঠতি নায়ক নায়িকার জ্ঞানশূন্য সাক্ষাৎকার থেকে কি এই 'বাট' শব্দটি শক্তিশালী হয়ে উঠল! টিভির বহু চ্যানেলের প্রভাব! দেখানেপনায় উচ্চবিত্ত হতে চাইছি! তাই কি সহায়ক হচ্ছে এই ধরনের অংশবিশেষ ইংরেজি ব্যবহার! মন্ত্রতন্ত্রে সংস্কৃত, খিস্তিতে হিন্দি, প্রথম নরম প্রেমে বাংলা সিরিয়ালের বাংলা, বাংলাভাষীদের সেমিনারে ভুল ব্যাকরণে ইংরেজি, পার্টিতে ইয়া-উয়া মিশ্র ভাষা,অলৌকিকত্বে সাধু বঙ্কিমী, ব্যর্থপ্রেমে রবীন্দ্র ভাববাচ্য ইত্যাদিতে আমরা আজ অভ্যস্ত।
#
তবে কি আমাদের সংস্কৃতি আমাদের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না! আমাদের সংস্কৃতি কি আমরা হারিয়েছি! না কি আমরা মিশ্র সংস্কৃতির পায়ে মাথা রাখছি! আর, আশাবাদ তৈরি করছি এই বলে যে, মিশ্র-সংস্কৃতিও তো এক সংস্কৃতি! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান বদলে যায়। যুক্তিনির্ভর সে বদল! ভাষারও বদল আসে। সেই বদলের সঠিক দিকনির্ণয়ের জন্য চাই নিরপেক্ষ সংস্থা। দুর্ভাগ্যের এই, স্বাধীন দেশে আজও তেমন কোনও উদ্যোগ গড়ে উঠল না। বিজ্ঞানে লগ্নি হয়েছে যা, বিজ্ঞানমনস্কতায় সে তুলনায় কিছুই না। ভাষা ব্যবহার আজ একমাত্র। ভাষাসংস্কার মর্যাদা পায়নি। ফলস্বরূপ ভাষাকে শ্লীল-অশ্লীল, রাজধানী-মফসসল, ভাষা-উপভাষা, মানুষ-দেবতা ইত্যাদি ইত্যাদির বিভাজন ও নাক উঁচু-নিচু করতে সময় দিচ্ছি বেশি। অথচ, ইতিহাস ভূগোল সবই যেন রসহীন তত্ত্ব ও তথ্য। শিক্ষক বিষয়কে এক থেকে বহু করতে চান। কীভাবে করবেন! নির্দিষ্ট দিশা নেই। ব্যক্তি উদ্যোগ কিছু আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অথচ, ব্যক্তিত্ব প্রকাশে প্রয়োজন ভাষাজ্ঞান ও প্রকাশ। তাহলে কি আমরা ব্যক্তির জীবনদর্শন, সৃজনশীলতাকে মানতে চাইছি না! গুরুত্ব দিতে চাইছি না আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে! এই কারণেই কি তরুণ পাঠক পাঠিকা বেশি করে এস এম এস-র ভাষাকে আঁকড়ে ধরছে! মিশ্র ভাষাতে অভ্যস্ত হচ্ছে! কিংবা নীরবতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চিহ্ন সংকেতে আসক্ত হচ্ছে! দীর্ঘ চিঠি লেখা উঠে যাচ্ছে--তাও কি এই কারণে!
#
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেবাসনির্ভর আমাদের জীবন। সামাজিক মর্যাদা অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর একমাত্র নির্ভরশীল। সেই কারণেই ভাষা সংস্কার ও চর্চার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। কার্যকরী করবে নিরপেক্ষ স্বাধীন কোনও সংস্থা। রাষ্ট্রকে বুঝতেই হবে নিয়মিত সংস্কার না করলে প্রাচীন রসহীন ব্যাকরণ-সর্বস্ব ভাষা দুর্বল হবেই। দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই 'কিন্তু' শব্দকে হারিয়ে 'বাট' শব্দ মর্যাদা পাবে। বিদেশী শব্দ স্বাগত চিরকাল। কিন্তু বলপূর্বক আনয়ন স্বাস্থ্যকর নয়। 'মোবাইল' শব্দটির বাংলা না করলেও চলে। চলভাষ কিংবা দূরভাষ কিংবা মুঠোফোন শব্দগুলির থেকেও মোবাইল শব্দটি বেশি প্রায়োজনিক ও প্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে 'মোবাইল' বিদেশি শব্দ হয়েও বাংলা অভিধানে স্বাগত। অন্যদিকে 'কিন্তু' শব্দের জায়গায় 'বাট' শব্দ ব্যবহার বলপূর্বক শুধু নয়, বোকাবোকা। ভাষা একান্তভাবেই বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যনির্ভর। তাই, ভাষাসংস্কারে রাষ্ট্রের একটু বেশিই মনোযোগ প্রয়োজন। আমরা পুষ্পাঞ্জলি দেবার সময় সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করি। সেই দেবীকেই বিপদে পড়ে ডাকি বাংলায়। সংস্কৃত ভাষায় কাউকে খিস্তি মারি না। ইংরেজিতে কোনওদিন স্বপ্ন দেখি না কিন্তু ইংরেজি ভাষার স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করিয়ে আত্মতুষ্টি পাই। যে ভাষায় একজন উকিল ওকালতি চালান, দিনশেষে সেই ভাষায় তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন না, যেহেতু সমাজ বদলে ভাষা বদল হয়। সময় বদলেও ঘটে ভাষা বদল। আত্মমগ্ন যুবকটি ভাষার অভাবে আত্মঘাতী হতে পারে। তৈরী হতে পারে বিষয়ের প্রতি ঘৃণা। ভাষার অভাবে কিভাবে ঘটবে ভাবমোক্ষণ (ক্যাথারসিস)! যে রাগ অভিমান দুঃখ অনুরাগ প্রশংসা রসিকতা ভাষা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে মন শান্ত ও উদার হতে পারতো--তার(ভাষার) অভাবে সে আত্ম-আবিষ্কারের বদলে আত্মঘাতীও হতে পারে। এ কথা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্রকে বুঝতেই হবে। তবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে অভিভাবক।
#
ভাষাও আসলে বিজ্ঞান। তার প্রয়োগ ও পরিবর্তনকে যুক্তিনির্ভরতায় বিশ্লেষণ করা যায়। তাই ভাষাচর্চাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ হওয়া চাই। চাই নানাবিধ পরিকল্পনা। শুধু বাংলা আকাদেমি ও সাহিত্য অকাদেমি যথেষ্ট নয়।
#
নতুন ভাবনাচিন্তার লক্ষ্যে তরুণ, সহৃদয় বন্ধুদের সঙ্গে নিতেই হবে। দীর্ঘ পথচলায় অবশ্যম্ভাবী ক্লান্তি দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে অর্থবলের তুলনায় বন্ধুবলকে গুরুত্ব দিতেই হবে। পাঠকের কাছে কীভাবে পরিবেশন করব, কীভাবে উপস্থাপন করব তা নিয়েও আধুনিক চিন্তা ও পরিকল্পনা চাই। প্রতিবার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ না করে মাঝেমধ্যে অন্যান্য জগতের বিশিষ্টদের আহ্বান জানানোই যায়। জেলাশাসক, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক, প্রবীণ ক্রীড়াবিদ, যাত্রাশিল্পী, চিকিৎসক প্রমুখের কথাও তো ভাবা যায়! এতে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছানোর চেষ্টাটুকু থাকে। তাছাড়া শুধু পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ না করে কিছু সময়, অর্থ ও মেধা বাঁচিয়ে যদি রক্তদান শিবির করা যায়, যদি দুঃস্থ কবি সাহিত্যিক, অক্ষরকর্মীর পাশে দাঁড়ানো যায়, যদি অরণ্য সপ্তাহ পালন করা হয়, যদি কিছু গাছ লাগানো ইত্যাদি সামাজিক কাজ করা হয়, তবে লিটল আর আক্ষরিক অর্থে লিটল থাকে না। অনেকে ভাবেন, এসব আমার কাজ নয়, এসব করবে সমাজকর্মীরা। প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা ভাষা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে যেমন ভাববেন তেমনি ভাববেন সমাজ ও সময় নিয়ে। ভজ
#
জনপ্রিয় কবি নয়, লিটল ম্যাগাজিনের কাছে সামাজিক কবিবন্ধু বেশি প্রিয়।
___________________
..............চলবে