Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

শাল পাতার ডায়েরি ঃ পাঁচ

শাল পাতার ডায়েরি  ঃ  পাঁচ

বুলেট বৃত্তান্ত

অমিত মাহাত
.................…..
বুলেট আমাকে টানত। কে এই বুলেট? মন জানতে চাইত। উত্তর পেতাম না। এইসব কথা তো জনে জনে জিজ্ঞেস করা যায় না। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলে আরেক বিপদ। …


শাল পাতার ডায়েরি  ঃ  পাঁচ

বুলেট বৃত্তান্ত

অমিত মাহাত
.................…..
বুলেট আমাকে টানত। কে এই বুলেট? মন জানতে চাইত। উত্তর পেতাম না। এইসব কথা তো জনে জনে জিজ্ঞেস করা যায় না। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলে আরেক বিপদ। সে গ্রামের কমিটি ছেড়ে যে দেবে তা তো আগের থেকে নির্ধারিত বিষয় নয় । প্রথমত উত্তম মধ্যম পেলে পেতেও পারি। প্রাপ্তির তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। এই ভেবে চুপচাপ থাকতাম।

পকেটে ভোটার কার্ড পুরে সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়তাম। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। কাছাকাছি নির্দিষ্ট কিছু গ্রামের নাম। কিছু মানুষের নাম স্মরণে রেখে দিতাম আত্মীয় হিসেবে। তেমন কোনও অভাজন পরিস্থিতিতে পড়লে, প্রশ্নের সম্মুখীন হলে সামাল দেওয়ার জন্য মুখে লেপ্টে থাকত 'আত্মীয়বাড়ি । কুটুমঘর। ' এই কথা দুটো।  রাস্তায় নতুন লোক ঘোরাঘুরি করছে এই সন্দেহে প্রথম প্রশ্ন টি আসে অযাচিত ভাবেই। একজন বয়স্ক গোরু বাগালের প্রশ্নের সম্মুখীন হই।

-'-এদিগে কোথায় আসা হয়েছিল? '
-
--'এইধারেই। '

--'কন ধারে? '

এবার আর ভনিতা না করে বলে দিলাম। -' আত্মীয়বাড়ি। কুটুমঘর। '

--'কোন গাঁয়ে '

--'রথবেড়া '

--'উ গাঁয়ে কে আছে বাবু? '

--'মাসীঘর '

--'কী নাম? কাদের ঘর?

নাম বললাম। নাম বলতে এবার আমার মুখের থেকে তাকাল ভালো করে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এবার। প্রশ্নকর্তার মুখে প্রশ্নচিহ্ন। চিন্তার ভাঁজ। আমি যেন মিথ্যা বলেছি। আমার যাবতীয় পরিচয় মিথ্যা।

--'উ নামে তো কেউ থাকে নাই। রথবেড়ায় আমার চাষজমি। আর চিনব নাই? ডাকনাম কনঅ আছে? '

-'-নাই। রথবেড়া নাই। ধানঘোরী। '

--'সেই বলঅ। অদের তো এই ঝইড়্যামুড়ায় চাষজমি। সুরুবালী'র ঘর গেছলে?

--'হঁঅ। উ নাম টাই আমার মাসীর নাম। '

--'গোপাল কাঁথুয়া'র বেটাদের নাম গা ভুল্যে যায়। বয়সের দউস। '

আমি প্রশ্ন করি -'কাঁথুয়া? অরহা তো মাহাত বটে। '

-- 'কাঁথুয়া মানে বুঝলে নাই?  একসময় কাঁথ দিত। মাটির ঘর বনাত। আমাদের ঘরটা উয়ার হাতের। যে জুইত কাঁথ বনাথ যে বাবু কি বইলব। তারপর কি যে হয়ে গেল। মানুষটা পাগলা হয়ে গেল। একলা রাঁধে। একলা খায়।

আমি সাইকেলের চেন ঠিক করে নিই। বেলা ফুরিয়ে আসছে। সাইকেলের সিটে চাপতেই বয়স্ক মানুষটি হ্যান্ডেলে তাঁর হাতটি রাখে। তারপর বলে -'হঁ আর টেকাব নাই। দিনমানে ঘরে চলে যাবে। কেমন। দিনকাল তো ভালো লহে বাপ। হেঁ বাপ তোদের দিগের খবর কী? মিটিং মিছিল হয়? কমিটি? রাইত্যে কতধূর হাঁটায় লেগে উয়ারা?

--'সে  তো ভালোই। '

--'ই কথা গা কাকেও বলবে নাই। বিপদ বাঢ়্যে যাবেক। আর টুকু বেলা পড়লেই সেন্ট্রি ছানা গুলা বেরাব্যেক। আমি বুড়া লোক। হামদের ছা ছানারাই ইসবের নেতা। '

--'নাই। নাই। লোক কে ক্যানে জানাব! '

--'আর একটা কথা। তুমার তবে বাঁদরবনী এ মামাঘর। আর তুমিএই তবে সে গান টা লিখেছিলে? অই "কি কান্ড ঘটালি লালগড়ে " পুলিশ ছড়াঞ দিলি।আড়ে থাড়ে। '

আমি আর কিছু না বলে সাইকেল ছেড়ে দিলাম। সামান্য কিছু কথা। সিপিএম পার্টি আর পুলিশি এই দ্বৈত সাঁড়াশি থাবার মুখে পড়া অতি সাধারণ মানুষের দাঁড়াতে হলে একটি অস্ত্র দরকার। নিতান্ত সাধারণ ভাবেই কলম তুলে নিই। গান বাঁধি।যাক গে সেসব কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক এখন।

"তুমার তবে বাঁদরবনি গাঁয়ে মামাঘর। " ভাবলাম আজ আর ঘর গিয়ে লাভ নেই।সাইকেল ঘোরালাম। দহিজুড়ির পথে। মাহালাগুড়ি ফুলবেড়িয়া আমার বাঁদিকে রেখে সাইকেল ঘোরালাম ডানদিকে।

মামাবাড়িতে শুনলাম আরও একটি নাম। পিন্টু মাহাত। মধুপুরে ঘর। মাঝেমাঝে নদী পেরিয়ে বাঁদরবনীতে আশ্রয় নেয়। স্কোয়াড সদস্যদের সাথে গোপন বৈঠক সারে। একশ্যান । একদিন পিন্টু মাহাত এখানে এসেই আমার সম্বন্ধে যাবতীয় খোঁজ খবর নেয় মামার কাছ থেকে। -'ভখা দুখা ছানা'টিকে একবার দেখার ইচ্ছা জানিয়ে ত্বরিতগতিতে এলাকা ছাড়ে। এক এলাকায় বেশিক্ষণ থাকলে খবর চলে যেতে পারে পুলিশের কাছে। চরবৃত্তি যেভাবে বাড়ছে কাছের লোকের প্রতিও আর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না।
মামা আমাকে সেসব কথা প্রথমেই উগরে দেন। মামা ঝাড়খণ্ড পার্টি করেন। কমিটির আন্দোলন ছড়ায় ঝাড়খন্ডিদের হাত ধরে। সিপিএম পার্টিটার সাথে একমাত্র জঙ্গল মহলে লড়াইএর ক্ষমতা রাখে এই মামার মতো ঝাড়খন্ডি নেতারাই। যদিও পরে পরে বনপার্টি দাদা, মাওবাদীদের তাত্বিক নেতারা আসতে শুরু করে জঙ্গল মহলে। এদের শেল্টারের ব্যবস্থা নিতে ঝাড়খন্ডি মানসিকতার লোকজন বিশেষ তদ্বির। যাকে বলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রাণপাত সংকল্প।

মধুপুর ছেড়ে পিন্টু মাহাত স্কোয়াডে ঢুকল কেন? সিপিএমের শক্তঘাঁটি মধুপুর। সেখান থেকে ছিটকে পিন্টু আজ কেন মাওবাদী? এই প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে। কেন এই পরিণতি রক্তাক্ত বাতাবরণের  অভিমুখে মোড় নিতে চাইছে। এর উত্তর পেতে আমাকে ফের সাইকেল ঘোরাতে হয়। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। মানুষের ফিসফাস কথা। কানজোড়া আড়ি পেতে শুনতে চায়।  প্রচন্ড রকমের বিপদের দিকে এগোতে আমার সরসরিয়ে ওঠে। সবসময়। মনে হয় সব কিছু এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া দরকার।  এরজন্য শক্তি সঞ্চয় জরুরি। শক্তি জুগিয়ে  চলে কলম।