ঋত্বিকের ব্যক্তিগত প্রেম প্রসঙ্গ
---------------
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
তুমি যেমন এলে, সম্ভাবনাময়। অথচ
কোনও দিন যদি সে সম্ভাবনা-রহিত।
তবে উড়িয়ে দিই ওই পারে সব কথা
কড়া শাসনের সেই স্কুল হােস্টেল। যেখানে গত তিনমাস কোনও মেয়ের জ্যান্ত …
ঋত্বিকের ব্যক্তিগত প্রেম প্রসঙ্গ
---------------
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
তুমি যেমন এলে, সম্ভাবনাময়। অথচ
কোনও দিন যদি সে সম্ভাবনা-রহিত।
তবে উড়িয়ে দিই ওই পারে সব কথা
কড়া শাসনের সেই স্কুল হােস্টেল। যেখানে গত তিনমাস কোনও মেয়ের জ্যান্ত ছবি দেখিনি।যেহেতু হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি যাওয়া বারণ। যেহেতু স্কুলটি মেয়ে বর্জিত। যেহেতু ভৌগােলিকগত কারণে এলাকায় জনবসতি কম। যেহেতু স্কুল গেটের বাইরে যাওয়া বারণ।
আমি যে অসহায় অপেক্ষাকৃত
প্রকাশ-অক্ষম গুমরে মরি। তােমার কথা শুনে।
বুঝতে পারি শব্দ জন্মান্তর, বুঝতে পারি
আমি - তুমি আছি আর অন্যরা তো অন্য
অন্য পথের খেলা...
ওই বন্দি কিশাের বেলায় যেটুকু জানালা তা শনিবারের বিকেল থেকে রবিবারের রাত্রি। এটুকুই বা কম কোথায়। কৈশোর গড়িয়ে চলেছে যৌবনে। পুরোনাে 'দেশ' পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দাঁড়িয়ে যায় চোখ। জন্মনিরােধক বিজ্ঞাপন। চাঁদমামা'র রানির শাড়িতে, বক্ষস্তূপে...
মধ্যেকার দূরত্ব, যত মগ্নতা সে কতক্ষণ।
ভাবছি আর কটা দিন তারপর তো আত্ম-উন্মোচন
পথ থেকে পথ জন্ম সারাক্ষণ...
কখনওবা অধিক চাহিদায় কৃত্রিম কিছু
আর ভয়, আর আনন্দ, আর ভয়...
আনন্দবাজার পত্রিকার পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখি। গােল দাগ দিই। পনের পয়সার পােস্টকার্ডে ঠিকানা টুকি। পাত্র নয়, পাত্রের বাবা সেজে মেয়ের বাবাকে লিখি : সত্বর মেয়ের ছবি পাঠান। আমার ছেলের জন্য আপনার মেয়েকে আমার একমাত্র পছন্দ। আমি বিভিন্ন কাজে বাইরে থাকি। আমার বন্ধুর ঠিকানায় ছবি পাঠাবেন। ঠিকানা : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বনমালীচট্টা হাইস্কুল হোস্টেল, মেদিনীপুর । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে! কেউ না। সন্ধেতে প্রার্থনাসভাতে নাম ডেকে ডেকে চিঠি বিলি হত। ওই নামে চিঠির মালিক নেই। দু চারদিন বাদে অ্যাটেনডেন্স খাতা থেকে ওই চিঠি সরাতে পারলে কেল্লাফতে। আগামী দু তিনদিন সমস্ত অঙ্কের উত্তর ভুল। রাজ্যজয়ের আনন্দ। বইপােকা বন্ধুটিও গুরুত্ব দিচ্ছে আমাকে। বোধহয় তারও একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে। মানে খামে আসা ছবিকে।
দিন শেষে হয়তোবা হঠাৎ কোনও দিন দেখব
অজানা কেউ বসে আছে।
আর সে আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াবে
শরীর বাঁকিয়ে আমার কানে বলবে :
আজ এক দারুণ খবর আছে।
আগামীকাল হোস্টেলের মাছ কিনে আনার দায়িত্ব। সৌরভের প্রস্তাব : প্রতি কেজিতে ২ টাকা বাড়িয়ে আনন্দলােক কেনার। আনন্দলােক কেন? কারণ তখন মাধ্যমিক পার হয়েছি। ইচ্ছে হচ্ছে বারবার মল্লিকা সিনেমায় গিয়ে বসি। ইচ্ছে হচ্ছে বিশাল হােডিং-এর ওকে চোখ মারি। স্কুলের উদ্যোগে উত্তরপ্রদেশ ভ্রমণ। বন্ধুকে বলি : ছবি তােল, সঙ্গে যেন ওই মেয়েটি আসে। যদি ওর বাবা মা-র ছবিও আসে তাতেও খুব আপত্তি নেই।
ঘুমঘাের অথচ জেগে আছি সারাবেলা
এ কেমন সময়! বৃষ্টিতে ভিজছে শরীর
হাওয়াতে মিশেছে ধুলাে হয়ে বালি হয়ে
উড়েছে নিরাসক্ত
খুব একা লাগে। অনার্সের প্রথম বর্ষ। গ্রামের কলেজে শেষ রোল নম্বরটি আমার। প্রথম চার মাস ক্লাশ করা হয়নি। কলকাতায় দুটি কলেজে বাজে সময় নষ্ট করে দেরীতে ভর্তি হয়েছি যে। কলকাতা থেকে রেশমি আমাকে চিঠি লেখে প্রায়ই। অথচ মুখ মনে নেই তার। মনে হচ্ছে এসব পাপ। অথচ বন্ধুহীন এ পৃথিবীতে বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে না এক মুহূর্তও। ইচ্ছে হচ্ছে বারবার পাপ ঘরে দৌড়ে যাই। আত্মহত্যাও করতে ইচ্ছে করছে।
মাটি হয়ে যাই মাটির মতাে
সম্বিৎ হােক কথকতা
সব পাপ সব ঘৃণায়
জল নাম দিই জল
একান্ত গােপন অথচ ভীষণ প্রাণ
মৃত্যু মিশে যাই ভিড়ে আমৃত্যু
ভীষণ প্রাণের অথচ একান্ত গোপন
হাওয়া নাম দিই হাওয়া...
তা মরে যাওয়ার আগে অন্তত একবার আলােকিত করে তুলি আমার একান্ত বারান্দা কে বলেই ফেলি আমার দুর্বলতাগুলোকে। মায়ার শরীরকে জানালাে সে : ভালো থেকো। আমি না হয় একাই থাকি। হিসেব নিকেশের বাইরে সে। বসন্তের হাওয়া এখনও কি ভেজায়নি ওর রাতের পােশাককে! যে ব্যাখ্যাই হােক না কেন, নিজেকে বললাম মায়ের মৃত্যুশােক ভােলা মায়, অপমান নয়...। কোনও এক দার্শনিকের কথা। অবশ্য এরপর গোপন কোনও গল্প ছিল।
-- তারপর আমি ঘুরে দাঁড়ালাম
--আমি ফিরে তাকিয়েছিলাম
--দূরত্ব গড়েছিল, দৃষ্টি ছিল না
--দূরত্ব নয়, কুয়াশা, মেঘও ছিল আকাশে
--বুঝেছিলে তো -- বৃষ্টি নামলে না কেন!
--আমার বজ্র আমার ছিল না যে!
সেই বজ্রের খোঁজে অনেক আকাশ পার হয়েছি। শেষে ঝড়ের পাখিকে শুনিয়েছি আত্মকথা। অমীমাংসিত কথারা সব প্রণত বিশ্বাস। আগুনের আগুন, এক নিশ্বাসে বলে দেব আজ। আসলে এতােদিনে শব্দের মধ্যে তাকে ধরতে পেরেছি। সুতরাং আমার সংসারে অভাব বলতে কিছু নেই। দুবেলা দুমুঠো জোটে। রান্নাপাতি খেলে আমি ও আমার কবিতা শুতে যাই।
আগুন মিশেছে যেখানে আগুন হয়ে
বাতাসে বাতাস, নিঃস্ব যার নাম
যেখানে সর্বশূন্য অন্ধকার
সেখানে জন্মান্তরবাদ আমার...
আজ বিজ্ঞাপনের মেয়েদের আমি দেখি। তবে তারা আমার কবিতার চেয়ে বুদ্ধিমান নয়। শব্দে, ছন্দে, বর্ণে, গন্ধে, আর্তিতে, অভিমানে, রাগে, ভােগে, যােগে, রোগে, ঘুমে, জেগে, নিয়মে, অনিয়মে, দৌড়ে পালিয়ে, লুকিয়ে, জাগিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, সেই কবিতার মেয়েরা আমাকে একবার ডােবাচ্ছে, একবার ভাসাচ্ছে। আমি চমকিত হচ্ছি প্রতি সকালবেলা। রক্তে, শিরায়,পাপে, আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছি। এক দৃষ্টিতে তৃষ্ণার্ত তাকিয়ে রয়েছি তার দিকে। সে আমাকে বলছে ভাল থেকো, মন্দ
থেকো। অস্তিত্বে থেকো। যন্ত্রণায় থেকো। যা খুশি হােক। তবু থেকো নিজের মধ্যে। কবিতার মধ্যে।...
----------------------