চন্দ্রগোধূলি
তাপস দত্ত
..............
এমনি ভাবেই দিন গড়িয়ে চলতে থাকে।
জেলেদের প্রতি বছর সুবর্ণরেখায় পূজা হয়, কিন্তু তেমন আড়ম্বর করে হয় না।
জেলে পাড়ার সকলে চন্দ্রকে এসে ধরল,
-আপনি আমাদের অনুষ্ঠানে থাকুন।
-আরে শোনো– শোনো আ…
চন্দ্রগোধূলি
তাপস দত্ত
..............
এমনি ভাবেই দিন গড়িয়ে চলতে থাকে।
জেলেদের প্রতি বছর সুবর্ণরেখায় পূজা হয়, কিন্তু তেমন আড়ম্বর করে হয় না।
জেলে পাড়ার সকলে চন্দ্রকে এসে ধরল,
-আপনি আমাদের অনুষ্ঠানে থাকুন।
-আরে শোনো– শোনো আমি ওসব পারবাে না। তােমরা করাে।
ওদের মধ্যে অনেকে বলে আমরা যাত্রা করব আপনি না থাকলে চলবে না মাস্টার মশাই।
সবাই বলে হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা যাত্রা করব আপনাকে ছাড়ছি না।'
আপনাকে থাকতেই হবে।
চন্দ্র দেখল সুবর্নরেখা এদের মুখে সত্যিই হাসি ফুটিয়েছে। ছােট ছােট
ছেলেমেয়েদের দু'মুঠো অন্ন আর পােশাক তুলে দিয়েছে।
চন্দ্র বলল-জানি না এখানে কতদিন থাকব, আমি রাজি।
গােধূলি খুব খুশি হয়েছে। জেলেদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে চন্দ্র। ওদের
রিহার্সাল শুরু হয়েছে জবর ভাবে। চন্দ্রকে সবদিকে দেখতে হচ্ছে। সব হয়েছে
কিন্তু নায়িকার কথা ভাবতে থাকে চন্দ্র। ওরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। চন্দ্র
ওদেরকে পরামর্শ দিলাে তােমরা তােমাদের গোধূলি দিদিমনিকে বলতে পারে।
ওরা সবাই মিলে গিয়ে গােধূলিকে রাজি করাল। চন্দ্রও ছিলাে, ও খুব দূর থেকে
গােধূলির কথা গুলো শুনেছিল।
যাত্রার দিন ঘনিয়ে এলাে। সুবর্নরেখার ওপারের মােল্লাল গ্রাম থেকে
মানুষ দলে দলে নৌকা করে আসতে লাগল। যাত্রাও হলাে সুন্দরভাবে।
এমনি করেই দিন চলে যেতে লাগল। গোধূলির মনের মধ্যে চন্দ্রের অনুপস্থিতি
ক্রমশ পাগল করে তুলল। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। সারাবাড়ি নিঝুম। চন্দ্র
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আপন মনে বলে চলেছে—
তুমি কোন কাননের ফুল,
তুমি গগনের তারা।
তােমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন স্বপনের পারা.....
গােধূলি রাতের আঁধারে কখন যে চন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, চন্দ্র বুঝতে
পারে নি। হঠাৎ গােধূলিকে সামনে দেখে চমকে ওঠে চন্দ্র।
চন্দ্র প্রশ্ন করে-তুমি এত রাত্রে?
-আমি তােমায় কোথায় দেখেছি মনে নেই। তােমার কি মনে
আছে ? তােমার সাথে কি আমার কোথাও দেখা হয়েছে ?
চন্দ্র ভাবলাে ওকি আমায় চিনতে পেরেছে?না, নিশ্চই পারেনি।
-জানি না তােমায় কেউ ভালবাসে কিনা? কিন্তু আমি তােমায় ভালবাসি।
চন্দ্র তুমি আমায় একবার বলাে আমায় ভালবাসাে।
-আমি জানি না তােমায় দেখলে আমি কষ্ট পাই। কেন জানি না!
বলাে না, তুমি আমায় ভালবাস ? গােধূলির কণ্ঠে কান্নার রেশ!
যেন,চন্দ্রের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়তে চায় গোধূলি।
চন্দ্রের বুক থেকে দুঃখ জড়ানো হাসি বেরিয়ে আসে। অন্তর বলতে চায়, হ্যাঁ আমি
তােমায় চিনি, জানি। আমি সেই চন্দ্র, যাকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছিলে। যে তােমায়
প্রথম ভালবেসে জীবনের পথে চলতে চেয়েছিল। তুমি তার মুখপানেও তাকাওনি।
হঠাৎ নিজেকে সরিয়ে নেয় চন্দ্র।
-না না তােমার সঙ্গে আমার কোনদিনই পরিচয় হয়নি। দেখাও হয়নি। তুমি
এখান থেকে যাও। তুমি চলে যাও। চন্দ্র অনন্ত যন্ত্রনা নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ
করে। আবছা আঁধারে চোখ মােছে গােধূলি। অনেকক্ষন একাই দাঁড়িয়ে থাকে।
এক সময় দোতলার পশ্চিম পাশের ঘরে ফিরে আসে।
মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝাঁক এসে ভিড় করতে লাগল গােধূলির। চন্দ্রদা কেন আজ ওকে ফিরিয়ে দিলো?
কান্নায় ভেঙে পড়ে গোধূলি। এদিকে চন্দ্রের মনেও গোপন ঝড় প্রশ্ন তোলে
-চন্দ্র তুমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতে? তুমি কি কাছে যেতে পারতে না?
আবার ভাবান্তর দেখা গেল চন্দ্রের মনে,
-আজ আমি চাকরের সমান? সেখানে মনিবের সঙ্গে প্রেম আমার মানায় না।
মুনাই-এর স্কুল শুরু হল। মুনাই অনেক দুরের স্কুলে পড়ে। সবে মাত্র ক্লাস ফাইভে
উঠেছে। প্রতিদিন কাজের লােক ওকে স্কুলে পৌঁছে দেয়। আবার স্কুল ছুটি হলো
ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মুনাইকে পড়িয়ে প্রতিদিন বেরিয়ে যায় চন্দ্র। উদ্দেশ্যহীন
পথে ঘুরে বেড়ায়। ক্লান্ত মনে নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে বাতাসের সঙ্গে মনে
মনে কথা কয়। নদীর জল কুল কুল শব্দ করে ওর মনে নতুন সুরে ভরিয়ে তােলে।
ওর যেন আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে।-দেখ তােমাদের মত আমিও
আমার ক চলার পথের সাথী পেয়েছি।
আনন্দেতে গাছের পাতাগুলাে হাওয়াতে মাথা দোলায়। পাখিগুলাে গান করে।
-অনেক দিন পরে ভটচার্য বাড়িতে কলরব-এ যেন ভরপুর হয়ে উঠেছে।
অনেক দিন পর বড় দাদা মহেন্দ্র ফিরে এসেছে। সঙ্গে এসেছে বড় বৌদির বোন তনিমা।
তনিমা এখন ভদ্রাচলম-এ থাকে সম্প্রতি ওর বাবা ভদ্রাচলমে ট্রান্সফার
হয়েছেন। খবর পেয়ে বোন তনিমাকে পাঠিয়েছেন কয়েক মাস থাকবার জন্য।
মহেন্দ্রর ছুটি মাত্র দশ দিনের তারপর আবার কাজে যােগ দিতে হবে।
তনিমার সঙ্গে পরিচয় এখনাে হয়নি চন্দ্রের।
[16/02, 8:10 AM] Kobi Tapas datta2: গােধূলির সঙ্গে কয়েক দিনেই পরিচয় মেলা মেশা শুরু হয়ে যায় তনিনার।
তনিমা গোধূলিকে জিজ্ঞাসা করে ওই হাঁদারাম টি কে?
আমি কি করে জানব বলো?
তুই জানিস গােধূলি, আসলে তুই বলবি না।
আচ্ছা তুই ওকে ভালবাসিস?
—আমি ? ইমপসেবল!
দেখতে কিন্তু বেশ খাসা আমার মনে যেন, ঝড় বইয়ে দেয়। হৃৎপিন্ডটা কেমন যেন
ধড়ফড় করে উঠে।
তাহলে তুই প্রেম কর তনিমা?
করলে তাে ভাল হয় গােধূলি। কিন্তু ও কি আমায় পচ্ছন্দ করবে? আমার
দেখে কেমন যেন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী মনে হয়।
গােধূলি কিছুনা বলে চুপ করে থাকে। ওরা বেড়াতে যায় সুবর্নরেখা নদীর তীরে।
আচ্ছা গােধূলি ওর বাড়ী কোথায় জানিস?
ওর কে কে আছে জানিস ?
আমি কি করে জানব? তাের যদি জানার ইচ্ছা তাহলে তুই জিজ্ঞাসা করিস।
আচ্ছা গােধূলি আসার সময় উনাকে দেখলাম না তো? উনি কোথায় ?
কোথায় আবার জেলে বস্তিতে। বা কারাে নৌকায় করে মাছ ধরছেন বাবু।
সত্যিই কি সুন্দর লাগছে এই নদীর ওপর সূর্যের অগ্নিময় ছায়া। তাই না তনিমা?
আমার এসব ভালো লাগে না তনিমা বলে ?
ওরা কিছুক্ষণ বসে থাকলে নদীর তীরে। সন্ধ্যের সময় নদীর সুন্দরতা বেড়ে
চলে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে নদী তটের ওপর।
ওরা দুজন ফেয়ার পথে। তাড়াতাড়ি পা চালায়, হঠাৎ তনিনা
চিৎকার করে বলে , ওই যে পাথরের আড়ালে কে যেন বসে আছে। গােধূলী লক্ষ্য
করে সত্যিই তাে ওখানে কে বসে আছে। ওরা এগিয়ে এলাে।
দেখতে পেল চন্দ্রকে। চন্দ্র তন্ময় হয়ে উদীয়মান চন্দ্রের রূপের দিকে চেয়ে আছে।
চাঁদের আলাে নদীর জলে ঝিক্ মিক করছে।
হঠাৎ তনিমা খিল খিল করে হেসে উঠল।চমকে চন্দ্র পিছন ঘুরে ওদেরকে দেখল।
—আপনি কখনও
চাঁদের রূপ থেকে রামধনু রং ঝরে পড়তে দেখেছেন?
রামধনু রং যখন নদীর ওপর পড়ে তখন , এই নদী মাতৃস্বরূপা হয়ে ওঠে।
গােধূলী আনমনে চন্দ্রের মুখমন্ডল অবলােকন করে। সেই উদাসীনতা যেন
চন্দ্রকে গ্রাস করে ফেলেছে। ওকে যেন দুর জগৎ এর ক্লান্ত দেবদূতের মতাে মনে হয়।
ওরা তিন জনেই নিঃশব্দে বাড়ি ফিরে এলাে। বাড়ী ফিরে দেখে শরৎ বাড়ী
ফিরে এসেছে। গােটা বাড়ি টিকে যেন মাথায় তুলেছে।
-এই যে, তনিমা শ্যালিকা এসেছে। আমার আর চিন্তা নেই। বৌদি তােমার
বােনকে এবার আর বাড়ি ফিরতে দেব না।ওকে আমি ছাতনা তলায় সাত পাকে ঘুরিয়ে, হানিমুনে আল্পস পর্বতে চলে যাব।
উষা বৌদি ও শরং এর কান ধরে জিজ্ঞাসা করে
সেখানে কি খাবে?
-বৌদি ইট,পাথর,গাছ আর তারপর তােমার বোন তো আছেই। কী তনিমা
সুন্দরী বলেই তনিমার গালটা খামচে ধরে শরৎ।
- দেখ শরৎদা ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।
-----------------
...............চলবে