শাল পাতার ডায়েরি ঃ ছয়
বুলেট বৃত্তান্ত ২
অমিত মাহাত
মামা বললেন -' মামা'দের আগমনের খবরটি পাওয়া মাত্র সটকে পড়বে। ঘরে থাকবে নাই। অন্যগাঁয়ের লোক হলেই জীবনের বারোটা বাজাতে বাকি রাখবে না। '
মামা বেরিয়ে গেলেন। রাত পাহারায়। …
শাল পাতার ডায়েরি ঃ ছয়
বুলেট বৃত্তান্ত ২
অমিত মাহাত
মামা বললেন -' মামা'দের আগমনের খবরটি পাওয়া মাত্র সটকে পড়বে। ঘরে থাকবে নাই। অন্যগাঁয়ের লোক হলেই জীবনের বারোটা বাজাতে বাকি রাখবে না। '
মামা বেরিয়ে গেলেন। রাত পাহারায়। এখানে মামার মুখের উচ্চারিত মামা টি ইঙ্গিতবহ। মামা বললে বুঝে নিতে হবে পুলিশের লোক। অনুরূপ আরেকটি শব্দ হল দাদা। একমাত্র মাও স্কোয়াড সদস্যদের এই নামে ডাকা হয়। অপরিচিত কেউ যদি দাদার গতিবিধি জানতে চায় বা এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে কথা না বাড়িয়ে এড়িয়ে যাওয়ায় বুদ্ধিমানের পরিচয়। পুলিশের ফেউ ছাড়া হয়েছে প্রচুর। টাকার লোভে কাছের মানুষটি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। আন্দোলনের গতিপথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চরবৃত্তি আন্দোলনের শত্রু।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। এইসব কথা।
ধরমপুর পর্বে খুন হয়ে পড়েছিল শালকু সরেন। প্রথম খুন এটিই। লালগড় পর্বে। আরও বেশ কিছু প্রাণ গিয়েছিল। প্রত্যেকেই সিপিএম কর্মী। পার্টি অফিস ভাঙ্গা। তিনটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষ লম্বা মিছিল সহযোগে ঘিরে ফেলেছিল রাজপ্রাসাদোপম বাড়িটি। চলেছিল গুলি। প্রতিরোধ। কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে এসে যায়। মাওবাদী নেতা বিকাশ। কালো পেটানো চেহারাটিই ছিল বয়ার কাড়ার মতো।
কাঁসাইএর চরে টেনে এনে ফেলা হয়েছিল লাশ গুলো। নিখোঁজ সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিজয় মাহাতোর ঝাড়খন্ডি আন্দোলনের ঝুমুর ফিরে আসে।
--"কৈলকাতার মিছিলে
গেলেক গাঁয়ের সকৈল্যে
মরদ হামার ঘুর্যে আইল্য নাই
হায় গঅ... "
হৈন্না'র পান্ডে যুগল। অর্থাৎ অনুজ ডালিম। একসময় বাপের দেখানো পথেই মাহাতো ঘরগুলোয় মড়াঘরে পুজাপাসায় ছুটে আসত বাঁদরবনীতে। ছেঁড়াবনি ও আশেপাশের মাহাতো গ্রামগুলোর মাথায় ঘোল ঢালানো থেকে গিরিহপব্বেশ অব্দি ঢুকে পড়েছিল। চাল টি। বাড়ির বেগুন টি। গাছের কলাটি গামছায় গিঁট বেঁধে নিয়ে যেত। এতটাই অভাবগ্রস্থ পরিবার ছিল। পরে গরীব মানুষের পার্টি করতে শুরু করে। ধরমপুরের শেষকথা সেই। আড়েবহড়ে বাড়িয়ে ফেলে ভুঁড়ি।প্রাসাদোপম বাড়ি। বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল ইতিহাসের নিয়মে।
"লালগড়ের লাল মাটি
পালায় যত বহুবিটি
আরঅ পালায় বনের অ ভালুক
বাবুর কাকায় ধরেছে বন্দুক।। "
না ঘুম আসছে না। যখন গোটাগ্রামের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোই কী করে। দিনের বেলাও কি শান্তি আছে? হুটহাট পুলিশ ঢুকে পড়ে। বন্দুক উঁচিয়ে গাঁ ঘিরে ফেলে। ভয়ে এতটাই তটস্থ থাকে গোটা গ্রাম। এই বুঝি বাহিনীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে গেলাম। একটি দৃশ্য জন্মায়।
গ্রামের ছোটরা তখন খেলছে। বড়দের অনুকরণ করছে। একটি ছেলে হয়েছে দাদা। একজন মামা। বাকিরা মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে।
মিছিলে প্রথম ছেলেটি বলছে -বন্দেমাতরম।
বাকিরা গলা মেলায় একই সুরে -আলু খাঁয়ে পেট গরম।
একটি সাঁওতাল ছেলে নকল করে। -ড্যা'কে রেতাম দাতরম!
--দাতরম পার্টি দুর হটো।
--দুর হটো। দুর হটো।
--আদঅ আলম বাতাওয়া।
-ঝাড়খন লাং হাতাওয়া।
এবার পুলিশ অর্থাৎ মামা হয়েছে যে ছেলেটি -পিন্টু মাহাতকে দেখেছিস?
বাকিরা -নআই ত। দেখি নাই।
--ও এলেই খবর দিবি!
--হঁ হঁ। দিব।
--তোরা মিছিলে যাস?
--হঁ হঁ। যাই সার। হামরাকে জোর করে।
--কে জোর করে? নাম বল। গাঁয়ে কে কে নেতা?
--নাই সার। চিনহি নাই সার। মুখ উয়ার গামছায় লুকানা থাকে। আর রাইত্যে আসে।
যে ছেলেটি দাদা হয়েছে। সে এবার খেলায় ঢুকে পড়ে। বাকিরা ছোট্ট লাঠি বন্দুকের মত করে চারদিকে তাক করে দাঁড়ায়।
দাদার গলা শোনা যায়। - শ্রেণীশত্রু চিনে নিন। সে। আপন ভাই হলেও তার ছাড় নাই। খতম করো আপন ভাই।
প্রত্যেকে মুখে আওয়াজ করে। ঢিঢি ঢাই। ডুম ফটাস।
ফটাস শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের দিকে সামান্য কিছুক্ষণ চোখ লেগেছিল।এমন কেন হল। এমন কেন দেখলাম? স্বপ্ন কী বলে গেল? কোন ইঙ্গিত রেখে গেল এই কাকভোরে। যে মিছিলে পথ হাঁটছে সে তোমার কে হয়? যে লাশ হয়ে পড়ে রইল সেই বা তোমার কে? যারা ভাবতে শেখাল।তারাই বা তোমার কে হয়?
ও তোমাকে শোষন করেছে। ও তোমার শ্রেনীশত্রু। যাও বাড়ি থেকে টেনে এনে তার শাস্তি দাও। তারপর লিখে দাও লাল কালিতে। চরম শত্রু। এই ভাবনা তোমার মাথায় কে ঢুকিয়ে দিল। তখন তোমার ভাবার অবকাশ নেই। ক্ষমতা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। অন্ধ করে রেখেছে।
একটু বেলার দিকে মামা ফিরে আসেন। বিছানায় গড়িয়ে দেয় আপন শরীর । গোটারাত আমি ছটফট করেছিলাম এই বিছানায়। ঘুমোতে পারি নি।
মামা বললেন -কোথাও চলে যাও ভাগ্না। কাজে। গাঁয়ে থাকলে দিনেও সাঁতানি। রাতেও সাঁতানি।
আমি তখন দেখে নিচ্ছিলাম সাইকেলের হাওয়া ঠিকঠাক আছে কি না।