শাল পাতার ডায়েরি ঃ সাত
কাঁসাই কথা
অমিত মাহাত
কাঁসাই নদীটি বয়ে চলেছে। পশ্চিমের কোনদেশের নামালিয়া বউটির যত অশ্রুপাত এসে মিশেছে এ নদীতে। পশ্চিমের যত কষ্ট যত ব্যথা যত কান্না ঘামগন্ধ। মল বিষ্ঠা। ভেসে আসে। ভেসে যায়। কোথায় যায়। কোথায় …
শাল পাতার ডায়েরি ঃ সাত
কাঁসাই কথা
অমিত মাহাত
কাঁসাই নদীটি বয়ে চলেছে। পশ্চিমের কোনদেশের নামালিয়া বউটির যত অশ্রুপাত এসে মিশেছে এ নদীতে। পশ্চিমের যত কষ্ট যত ব্যথা যত কান্না ঘামগন্ধ। মল বিষ্ঠা। ভেসে আসে। ভেসে যায়। কোথায় যায়। কোথায় গিয়ে জমা হয়। তার খবর কেউ রাখে না। রাখতে পারে না।
নদীটি বয়ে যায়। পশ্চিমের কোন মালভূমি এর জন্মদাত্রী? কী বা নাম তার? কৌতুহল হয়। কবে কোন কালে যখন সভ্যতার বিবর্তন হয় নি। তখনও এই নদী ছিল। ইতিহাসের আদিযুগে এ নদীর নাম ছিল কপিশা। তারও আগে এ নদী ছিল। অন্যকোনও নামে। পশ্চিমের দেশ থেকে এ নদী বয়ে চলেছে পূবের কোন শস্যশ্যামলা লক্ষ্মী পয়মন্ত ভূস্বামীর খোলা খামারে। সারামাস ধরে যেদেশে সবুজের চাষ হয় এ নদী মোহগ্রস্ত নারীর মতো সেদিকেই বয়ে চলেছে।
লালগড়ের পশ্চিমে যখন সূর্যাস্ত হয়। কাঁসাই নদীটি আরক্তিম হয়। সরু লিকলিকে বউটির কাজলকালো চোখের ভেতর এ নদী অনায়াসে পথ করে নিতে জানে। পশ্চিমের সূর্য কপাল থ্যাবড়ানো সিঁদুর টিপ। যার কপালে শোভা পাচ্ছিল। তার কপাল আরও খারাপ। সন্ধ্যের আধো অন্ধকার ডেকে নিয়ে যায় ওর মরদকে। বউটির কপাল থেকে লালটিপ সূর্য ডুবে গেছে তারপর। মরদ আর ফেরে নি।
কাঁসাইএর দক্ষিনে একা নৌকোটি তলদেশ উপুর করে শুয়ে রয়েছে বালিকাতায়। চৈত্রমাস। নদীজল নেমে গেছে মাঝনদীতে। সরু লিকলিকে লাউডগা সাপের মতো এখন এ নদী লাগে। শিশিরে লাউডগা দৌড়ায় খুব। দিনের আলো ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে।
নদীর দক্ষিণে একটি গ্রাম। বাঁদরবনি। আমার মামাবাড়ি। উত্তরে কয়েককিমি বালিভূমি পথ। নদীপাড়। পুব কাতায় ছোট্টো একটি গ্রাম। পলাশি। এখন প্রায় নদীগর্ভে। পলাশি নিয়ে একটি ঝুমুর উদ্ধার করেছিলাম এ গাঁয়ের প্রবীন পুরুষটির কাছে। গানটি এই রকম।
"সাতাত্তরের বইন্যায়
ঘর দুয়ার ভাস্যে যায়
হাই রে পলাশি টা এতই নামো'য় ছিলঅ...
মা গঙ্গায় তাকেও নিয়ে নিলঅ।। "
কাঁসাই তখন মা গঙ্গা। এমনই তেজ। বাঁদরবনি গ্রামটি নিয়েও একটি প্রচলিত কথা পেয়েছিলাম। কাঁসাই যখন কাঁসাই হয়ে ওঠেনি। সংস্কৃত কাব্যে এ নদীর কথা লিখে গেছেন সে যুগের কবিবর। এ নদীর কী সুন্দর একটি নাম। কপিশা।
কপিশার সময়ে রাঢ়বঙ্গের অন্যতম একটি বানিজ্যবন্দর হল তাম্রলিপ্ত বন্দর। বানিজ্য তরী তাম্রলিপ্ত ছাড়িয়ে অরন্যাঞ্চলের দামী শালবৃক্ষ, বনজসম্পদ মধু পশুশিকার। পশুচামড়ার লোভে তরতরিয়ে উঠে আসত কপিশা নদীর বুক চিরে। এসে নোঙ্গর ফেলত বড়কোলার উল্টোঘাটে। একটি বন্দর গড়ে উঠল। ব্যবসা জমে উঠল বন্দরে। এখন।সে বন্দর আর নাই। সে নদীও আর নাই। আছে এই বাঁদরবনি গ্রাম। গ্রামের নামের মধ্যে বন ও বন্দর দুটোরই গন্ধ লেগে। মাঝেমাঝে ডাকাতি হত।
কুমীরকাতা বলে একটি গ্রাম। কাঁসাইএর পারে। ফুলবেড়িয়া মোড় থেকে পূবের একটি রাস্তা। শালপাতড়া। জোলাপাড়া। জোলাপাড়ার ভেতর বরাবর নদীমুখো একটি সরুপথ। পথ ফুরোলে নদী। কুমীরকাতা গ্রাম।শালপাতড়া গ্রামে এখন কোনও শালবন তো দূর একটি শালগাছও দেখা যায় না এখন। তাহলে গ্রামের নাম শালপাতড়া কেন? পাতড়া অর্থে পাতা বোঝায়। অতীতে কী শাল পাতার ডিপো গড়ে উঠেছিল? শালবল্লী এখানে এনে জড়ো করা হত কি তাম্রলিপ্ত সময়ে। ইতিহাসে তো এসব কিছুই লেখা নেই।
কুমীর কাতায় এক সময় কুমীর এসে রোদ পোহাত কাতায়। আর সুযোগ বুঝে হাটুরে মানুষ খুবলে খুবলে খেত নিশ্চয়ই। মুসলমান তাঁতিদের গ্রাম। জোলাপাড়া।
ফুলবেড়িয়া। বসন্তপুর। বহুপুরনো নদী পারাবারের ঘাট। নদী পেরলে নরেন্দ্রপুর। তার আগে ডিংলাগ্রাম। ডিংলা চাষের জন্য এমন গ্রামের নাম? নাও হতে পারে। কিংবা যদি এইরকম হয়। লালগড় ঝিটকা কাঁটাপাহাড়ি ওদিককার যত পুরুষ্টু শালবৃক্ষ। মহুলবৃক্ষ রাতভর গোরুর গাড়ির ক্যাচরকোচর সহযোগে এসে জমা হত। বসন্তপুর ঘাটের উল্টোদিকে। এতপরিমান কাঠ আসত যে যা ডিঙিয়ে রাখতে রাখতে একসময় ডিং হয়ে যায়। সে ডিং থেকে ধরা যাক গ্রামটির নাম হল ডিংলা। লালগড় অভিমুখে এই পথে আরও এগোলে পড়বে আরও একটি গ্রাম। বামাল। নদীবন্দরের যে মাল চুরি যাক। চোর সহ ধরা এই একটি জায়গায়। বমাল সমেত। হয়ত এভাবে একটি গ্রামের নামকরণ হয়ে যায় বামাল।
আরও এগনো যাক। এবার পড়বে চ্যামিটাঁড়া। মানুষ ভালোবেসে ডাকে চামটিআড়া। নদীর মুখে প্রায় এই গ্রাম। অনেক উঁচুতে। কাঁসাইএ যত বান পড়ুক।এ গ্রামে জল উঠবে না। উল্টে যদি কেউ বন্যার কোপে নদীতে পড়ে যায়। নেতাই গ্রামের ওদিকের কেউ। উনি যদি চ্যামিটাঁড়ায় উঠে আসতে চান। শরীরের চাম উঠে যাবে এ আড়ায় উঠতে হলে। অর্থাৎ চাম উঠা আইড়। এভাবেও আরও একটি গ্রামের নাম ইতিহাস তৈরি হয়।
ইতিহাস সব সময় অতীতে ফেরায়। লালগড়ের একটি ইতিহাস এভাবেই লেখা হয়। জনশ্রুতি থেকে। প্রচলিত বিশ্বাস থেকে। অদুর ভবিষ্যতেও এমন জনশ্রুতি শোনা যাবে। একদা লালগড় মাও মুক্তাঞ্চল ছিল। ভবিষ্যতের কোনও এক তরুন ভাববে হয়ত একশ বছর বাদে। এইসব কথা। লালগড় মানে বিকাশ শশধরের দেশ। দাদুর বাবার আমলে মাওবাদীরা বন্দুকের শাসন চালাত লালগড়ে। কতখুন। কত পিছমোড়া সকাল। এইসব আগামীর এক সকালে গল্পকথা হবে। ছেলেভুলানো গল্প হবে। সত্যিই কি হবে? নাও হতে পারে।
বাঁদরবনির ঘাটে কয়েকটি সাইকেল এগিয়ে আসে খুব ভোরে। সাইকেলের পেছনে শুকনো ফালিকাঠ। বোঝাবাঁধা। খুব দ্রুত নদী পেরিয়ে যায় দলটি। দহিজুড়ি হয়ে এ কাঠ চলে যাবে ঝাড়গ্রাম। চায়ের দোকানে। মিষ্টি তেলেভাজার দোকানে। দোকানের খরিদ্দারটি চা খেতে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেবে খবরের কাগজে। মন দ্বিধায় পড়বে তারপর। মাওবাদ জিন্দাবাদ। ঠিক না ভুল। ভুল না ঠিক।
পক্ষে? পক্ষপাতিত্ব রোগ বোধের কত গভীরে? মন তটস্থ হলে হোক। তবু তো পায়ের ছাপ চিনে চিনে পার হতে হবে সময়। বুক চিনচিন হোক। চোখ ছলছলো হোক। আমি তুমি সময়ের দাস। আদেশ শিরোধার্য।