Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ভ্রমণে মননে : সান্দাকফু

ভ্রমণে মননে : সান্দাকফু
নরেন হালদার
...............…..

মনটা ছিল ক্ষুধার্ত। কেন জানি না আমি যেন প্রায় উন্মাদ হয়েই পড়েছিলাম। যেতেই হবে। কোথায়? না গোণ্ডি ছাড়িয়ে। দূরে, অচেনা পরিবেশে, একা একা। মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকা ইচ্ছেকে অনেকদ…


ভ্রমণে মননে : সান্দাকফু
নরেন হালদার
...............…..

মনটা ছিল ক্ষুধার্ত। কেন জানি না আমি যেন প্রায় উন্মাদ হয়েই পড়েছিলাম। যেতেই হবে। কোথায়? না গোণ্ডি ছাড়িয়ে। দূরে, অচেনা পরিবেশে, একা একা। মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকা ইচ্ছেকে অনেকদিন আগেই প্রকট করে তুলেছিলেন সমরেশ বসু, পরে বুদ্ধদেব গুহ। তাই স্ত্রীকে প্রায় কাঁদিয়েই একা একা বেড়িয়ে পড়লাম।

একা ভ্রমণে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। পুরোপুরি স্বাধীন। তথ্যের ঘাটতি থাকলেও মনের ঘাটতি ছিল না। যেটা নেব, সেটা নতুন করেই নেব, অন্যের দানে বড্ড অরুচি। আমি তো দেখবো না, গ্রহণ করবো। ইন্দ্রিয়র খোলা দ্বার। যেদিক দিয়ে যা আসে। মাথায় সমরেশ বসু ও বুদ্ধদেব গুহ আর বুকে কালকূট ও লালাদা বা ঋজুদা।

গন্তব্য সান্দাকফু। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সীমা। একমাত্র বরফাবৃত ভূমি। আয়োজক ইউথ হোস্টেল। সহযাত্রী ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন ভাষির যুবক-যুবতী। উদ্দেশ্য ট্রেকিং।

ট্রেকিং-এর বিষটি জানা ছিল না। শুধু শব্দটির সাথে পরিচিত। ফলে প্যাকিং আগোছালো। প্রথম দিন রুমমেট ছিল দুই কননড় ভাষি যুবক। বিবাহিত। স্ত্রীদের সঙ্গে এনেছেন। ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী অন্য রুমে তাদের অবস্থান। ভাব আদান-প্রদানে একটু সমস্যা হল। বাংলার গোণ্ডী তো পেরোইনি কোনোদিন! তারপর একে একে পরিচয় হল গুজরাটি, মারাঠী, তেলেগু, তামিল, হিন্দী ভাষিদের সাথে।

প্রথম দিন

প্রথম দিনের যাত্রা দার্জিলিং-এর বেস ক্যাম্প থেকে, গাড়িতে করে মানে-ভঞ্জন, সিংগালিলা ন্যাশানাল ফরেস্টের গা-ঘেঁসে চলে গিয়েছে একটি ছোট্ট গ্রাম ধোত্রে’তে(৮৫০০ফুট)। যেখান থেকে পদে যাত্রা শুরু। ইতিমধ্যে ঊনিশ জন সদস্য চারটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে ভাষার সুবিধা মতো। একা কেবল আমি। চাইছিলামও বা।

দু’জন গাইড প্রথম থেকেই অপেক্ষায়। প্রথম দিন নেপালের একটা গ্রাম টামলিং(১০০০০ফুট) পর্যন্ত। সাত কিমি। চড়াই খুব কম। উত্তরের আকাশে স্লিপিং বুদ্ধাকে প্রনাম করে যাত্রা শুরু করলাম। শেষ সকালের সূর্যের আলো পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায়, শরীরে ও পায়ে। রোডোডেন্ড্রনের বন অসমতল পথের দুধারে, আমাদের স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক স্বপ্নালোকে। পিঠে রুকস্যাক, হাতে দণ্ড। ঊনিশটা মানব-মানবীর জয় করার মনোভাব কোনো এক অগম্য এভারেস্টের। চার কিমি পরেই ঘাসে ঢাকা চড়াই নেমে গিয়েছে বুদ্ধের পায়ের কাছে। নীলাভ বর্ণের পাহাড়ের সামনে দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম। ডানার খুব প্রয়োজন ছিল। পেছনে আকাঙ্খা, সামনে বিস্তৃতি, দিগন্তের ছোটো ছোটো নীলাভ টিলা , যেন মাথা নত করে আছে বুদ্ধের পানে। বৌদ্ধরা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খুব মানে। আরো এক কিমি যাওয়ার পর বয়ে নেওয়া প্যাক লাঞ্চ নেওয়ার পালা। সমতল ভূমি। সেখান থেকে পশ্চিমে পাহাড়ের উপর থেকে হাতছানি দিচ্ছে টমলু, নেপালের সীমা। মাঝে মাঝেই টিম লিডারের উৎসাহ বাণী ‘চড়কে দিখায়েঙ্গে, সান্দাকফু জায়েঙ্গে’ যেন প্রকৃতিকেও সাবধান করে দিচ্ছে।

টমলুতে ছোট্ট একটা ঘর। হোটেল বলা যেতে পারে। নাস্তা ও চা সহযোগে খানিক বিশ্রাম। তারও কিছুটা ওপরে ওটা কী? কৌতূহলী মন ছুটে গেল। নেপালের সীমানা চিহ্নিত তিনটি স্তম্ভ। এছাড়া আর কোনো চিহ্নই নেই যা দেখে নেপাল আর ভারতের ভূমিকে আলাদা করা যায়। কয়েকটি নেপালী ও ভারতীয় যুবক আড্ডায় বসেছে পানীয় সহযোগে। আমাকেও অফার করল। তাদের মধ্য থেকে এক নেপালী যুবককে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করলো। কেন জানি না। ব্যাখ্যা করার সময় নয়। ভাবনা অনুযায়ী কাজও করলাম। তারপর ছেড়ে দিলাম। এখন আমি একা। পূবে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘের আনাগোনা, আর নীল ও ধূসর পাহাড়ের অপূর্ব মিশ্রণে রঙের খেলা। সবই আমার পায়ের নিচে। আমি তাদের উপরে। দলের অনবরত আহ্বাণকে গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করছিল না।

আবার উতরাই। এক কিমি। নেপালের ভূমি মারিয়ে ছোট্ট গ্রাম টামলিং। গ্রামের পাশ দিয়ে ভারত সরকারের তৈরি রাস্তা চোলে গিয়েছ বহুদূর। সিদ্ধার্ত হোটেল গরম স্যুপ সহযোগে আমাদের স্বাগত জানাল। রাতে আরেক ধারা। এখন আমি সম্পূর্ণ বাস্তব। ডিনারের পূর্বে চলা প্রায় দু’ঘন্টার জলসা। ভাষার মিশ্রণ আর অংশগ্রহণের ঐকান্তিকতায় অপূর্ব। খোলসের বাইরে একটা দিন। গোণ্ডীকে উপেক্ষা করার একটা দিন। গানের সূত্রে গান। সুরের সূত্রে কথা। ডিনার শেষে ক্যাম্প ফায়ারের আমেজ নিয়ে হোম ফায়ার। সব কিছুই সাজানো সোনার থালায়। শুধু গ্রহণ করার পালা।


দ্বিতীয় দিন

গন্তব্য কালিপোখরি (১০১৯৬ ফুট)। তেরো কিমি। উতরাই এবং চড়াই। পোখরি কথার অর্থ লেক। কালো জলের হ্রদ। যাত্রা শুরু সকাল সারে আটটায়। ছোটো ছোটো পাহাড়ের গা-ঘেঁষে(ছবি ৩ লেক ও লিপি) পথ। এবরো-খেবরো। ইতিমধ্যেই এক হায়দ্রাবাদী তারুণী – বিনুর সান্বিধ্য জুটে গিয়েছে। তাকে পাশে নিয়েই এগিয়ে চলেছি। কেমন করে যেন ও আমার কাছে প্রকৃতির আরেক রূপ নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছে, কিম্বা কনো শুভাকাঙ্খি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে গেল তিব্বতী ভাষার এক শিলালিপিতে। গাইডের কাছেও তা অবোধ্য। এটুকু প্রাপ্তি যে এটা প্রাচীন। আড়াই কিমি পথ যাবার পর পাহাড়ের কোলে দেখা মিলল একটা গ্রামের, জৌবর নাম। কয়েকঘর মাত্র বাস। পাশে নেপালের পুলিশ চৌকি। আর বায়ে ফার্মিং ল্যাণ্ড, সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষিত। একটা দোকানে চা-জলখাবার। তারপর আবার হাঁটা। গুজরাটি দুই বন্ধু দোকানের মালিকের কাছ থেকে কয়েকটা নেপালী টাকা ভারতীয় টাকার সাথে আদান-প্রদান করে নিল। এরপর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়। বাঁয়ে বিস্তৃত টিলাভূমি নীল রঙের ক্যানভাসে ছবির মতো স্থিত। কোথায় আছি আমি? কোথায় চলেছি? একি স্বর্গ? নাকি স্বপ্নের মায়াখেলা। প্রতিমুহূর্তে শরীরে অনুভব করেছি শিহরণ! বারে বারে মনে হয়েছে আমি বেঁচে আছি, আমি বেঁচে আছি। জনকোলাহলে ওষ্ঠাগত প্রাণ মুক্তির স্বাদে দুরন্ত, উন্মত্ত।

 উতরাইয়ে শেষ উপত্যকা – ভারতীয় সেনা ক্যাম্প, নাম গাইরবাস। ফটো তোলা নিষিদ্ধ। ক্যাম্পকে ডাইনে রেখে এগিয়ে চলা। পুরোপুরি চড়াই। এবারে বিনু আমার সম্পূর্ণ সঙ্গী। আমি চাইছিলামও বা। গাড়ি যাওয়া পথ। মাঝে মাঝে ল্যাণ্ড রোভার বাঘের মতো গর্জন করে যাত্রী নিয়ে চলেছে সেই চড়াই পথে। গন্তব্য এক। আমরা সবার আগে। এক পাগলামি ঘিরে ধরেছে। “অরণ্যের দিনরাত্রি”-র চার বন্ধুর মতো আমিও ভুলে গিয়েছি আমার সামাজিক জীবন। সঙ্গে বন্য সঙ্গিনী, আর প্রকৃতি। চড়াইয়ের শেষে লাঞ্চ পয়েন্ট। গ্রামের নাম কইয়াকাটা। মাত্র চারটি ঘর। তারই একটিতে লাঞ্চ। কিছু বিশ্রাম, আবার হাঁটা। কালিপোখরি যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল চারটে। দক্ষিণে সান্দাকফুর চূড়া দেখা যায়। দুটো ইয়াক হাতের কাছেই চড়ছে। ‘হোটেল নমো বুদ্ধ’ হট স্যুপযোগে আমাদের আশ্রয় দিল। পাশের বেডে ট্র্যেকিং-এ অভিজ্ঞ প্রবাসী বাঙালি বন্ধু ঋষি। স্ত্রীসহ তার প্রথম ট্র্যেকিং। রাতে ডিনারের পর আরেকবার আড্ডা। বন্ধুরা সঙ্গবদ্ধ হলে গল্পের উপাদানও জুটে যায়। তাও যদি ব্যাচেলার হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এবং তার বেশির ভাগই যে প্রেম সম্পর্কের বিষয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবরণ দেওয়া হল রাম সীতা আর লক্ষ্মনের বনভ্রমণ। সঙ্গে হনুমান।

তৃতীয় দিন

প্রভাতে সূর্যোদয়। কংক্রিটের ইয়ারতে ঘেরা নিজের ঘরে বসে দেখার সঙ্গে এর অনেক তফাৎ। তাই লোভ সামলানো মুশকিল। মাইনাস এক ডিগ্রী তাপমাত্রা পরাস্ত করতে পারে না। নীল চাদরের শরীর থেকে প্রথম আলো নিয়ে উঠে আসা ভয়ংকর সুন্দর সূর্যকে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম। একটু পরেই মনে পড়ল লেকের কথা। ছুটে গেলাম প্রায়। লেকের কালো জলে বরফ জমে আছে। পুরো বরফ। উপরে সারিবদ্ধ ভাবে টাঙানো বৌদ্ধদের ধর্মীয় পতাকা।
সকাল ন’টায় পুনরায় যাত্রা শুরু। এবারের পথ একটু বেশিই খাঁড়া। গাড়ির রাস্তা ডাইনে ফেলে দিয়েছি। এখন চূড়ায় চূড়ায়। আজও আমার পাশে জীবন্ত প্রকৃতি বিনু। কেন জানি না আমরা সবার আগেই ছিলাম। আগে যাওয়ার নেশা, নাকি আগে পাওয়ার, নাকি প্রকৃতির হাত ধরে নিরিবিলি প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ করা! পথে বিকাই ভঞ্জন-এ একটু বিশ্রাম। সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর আগে শেষ দম নেওয়া। রাস্তা দূর্গম নয়, সুগমও বলা যায় না। কোমর সমান পাহাড়ী আগাছা মাঝে মাঝে পথ রোধ করেছে। দু’জায়গায় ঝোপে কাটা, পায়ে বরফ। পদক্ষেপে সচেতনতা আর ঝোপকে এড়িয়ে চলা। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে নির্দিধায় প্রবেশ করে গেল অবাধ্য এক কন্টক। রক্তক্ষরণ। কিন্তু তা কি আমাকে বিচলিত করতে পারে? মনে আনন্দ, শরীরটা তো জন্তু। সামনে ঢালু-সমতল, একটু বিশ্রাম। পাশে কিছু জায়গায় ব্ল্যাক বেরির বনে যেন সোফা বিছানো। একটু বসে নিলুম।

আবার চলো। গন্তব্য খুব কাছে। হাত দিয়ে ধরা যায় যেন। আবার একটু আঁকাবাঁকা খাড়াপথ গিয়ে মিশেছে গাড়ি চলার রাস্তায়। এ রাস্তায় কেবল হেঁটেই যাওয়া যায়। গেলাম। মনে যোশ, শরীরে ক্লান্তি। গাড়িপথে হাঁটলাম। নিচে জমাট বাঁধা বরফ, অসাবধানতায় নির্ঘাত পতন। অবশেষে সান্দাকফু। দুপুর আড়াইটা। গরম স্যুপ, সঙ্গে লাঞ্চ। হোটেল নমো বুদ্ধ। তারপর ভিউ পয়েন্ট। হোটেল মালিকের কড়া নির্দেশ, খাওয়ার জলটি শুধু পাবেন। পরিমান মতো। বাজে নষ্ট নয়। বাকি কাজ টলেট পেপার। রাতে মাইনাস চার ডিগ্রী। নষ্ট কি সব তো জমাট!
ভিউ পয়েন্ট, সে তো আরেক মায়া। আসার পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেকবার দেখেছি, আবছা দু’একবার উঁক দিয়েছে এভারেস্ট, থ্রি সিস্টার। এখান থেকে সব স্পষ্ট। মাকালু, এভারেস্ট আর লোৎসে। তিন শৃঙ্গের ত্রিশূল। ডাইনে স্লিপিং বুদ্ধ, সামনে সাগরমাতা। স্বর্গ কি এখানে? কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার শুভ্র আচ্ছাদন ও ধূসুর সাগরমাতা আর পায়ের নিচে পৃথিবী। কে আমি? কি আমার পরিচয়? কিছুই না। শুধু এটুকু জানি সৃষ্টকর্তা আমাকে এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ তার কাছে। আমি ভাগ্যবান। ক্রমে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সাগরমাতার গায়ে সোনালী আলোর ছটা ছড়িয়ে সূর্যের প্রস্থান।
নিয়ম, রাত্রি আটটা পর্যন্ত আলো থাকবে, তার আগে ডিনার। ডিনারে আজ খিচুড়ি। অতি উপাদেয়। রাত ন’টা, যখন চারিদিকে অন্ধকার আমাকে যেন টেনে আবার বাইরে নিয়ে গেল। গেলাম। পাহাড় চূড়ায় রাত্রির নিস্তব্ধতা, শুধু তারারা কথা বলে কানে কানে।

চতুর্থ দিন

এদিনের গন্তব্য গুরুদাম(৭৫২২ ফুট)। বারো কিমি। সকালে সূর্যোদয়। আবার ভিউ পয়েন্ট। এত কাছ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা! টাইগার হিল থেকে একবার চেষ্টা করেছিলাম। সে চেষ্টা মেঘ ঢেকে রেখেছিল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য যে চূড়াকে দেখেছিলাম সেখান থেকে সে তো সুদূরের পিয়াসি। দেখা দিয়েই হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু এখান থেকে এই সকালে স্লিপিং বুদ্ধার মাথা [কয়েকটা শৃঙ্গের সমষ্টি, কাকটাং, কুম্ভকরণ(৭৭১২মি), ফ্রাইস পিক(৫৮৩০মি), রাটোং(৬৬৭৯মি)], ধর [কাবরু সাউথ(৭৩১৭মি), কাবরু নর্থ(৭৩৩৮মি), টালুং(৭৩৪৯মি), কাঞ্চনজঙ্ঘা(৮৫৮৬মি), পাণ্ডিম(৬৬৯১মি), জপুনো(৫৯৬মি), সিমভো(৬৮১১মি)] এবং দুই পা [নারসিং(৫৮২৫মি), সিনোচু(৬৮৮৭মি)]-এর উপর পবিত্র সূর্যালোকের অঞ্জলি দেখার সোভাগ্যে নিজেকে সবচেয়ে স্বার্থক বলে মনে হয়। আর পশ্চিমে সাগর মাতার তিন বোন শুভ্রতার ঔজ্জ্বল্যে মহান। আর পায়ের কাছে সান্দাকফু। বরফে ঢাকা কতকগুলো টেন্ট আর কয়রকটা হোটেল। সাদা বরফের উপর দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রণস্পন্দনের আশ্চর্য বিন্দু।

যাত্রা শুরু সারে ন’টায়। একসাথে গ্রুপ ফটো, সঙ্গে গাইডের নির্দেশ। ফেরা পুরোটাই উতরাই। নিচের দিকে। পুরো বরফের উপর দিয়ে হাঁটা। বনে বরফের চাদর বিছানো। হাঁটা পথে স্পঞ্জের বরফ। জুতো সমেত পা ঢুকে যায় তাতে। চলেছি। পথে কতগুলো বন্য ইয়াক। গাইডের নিষেধ সত্তেও তাদের কাছে যাওয়ার, তাদের গায়ে হাত দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। কোনো বড় বিপদ ঘটতেই পারতো। তারা তো বন্য। কিজানি কেন আমাকে কিছু করলো না! হাত রাখতে দিল পিঠের উপর। ওদের গাঁয়ে হাত দেওয়ার সময় মনে হয়েছে অরা আমাকে কিছু করবে না, ও তো একটা জীব যেমন আমি। মন থেকেও হয়তো এক। এ বিশ্বাস আমার আছে।

এরপরের রাস্তা নলী বাঁশের বনের ভিতর দিয়ে। দীর্ঘ রাস্তা। আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে লাগলাম দলের থেকে। কেউ যেন পিছনে আমাকে ডাকছে। চড়াইয়ের সময় একরকম মনে হয়েছিল, উতরাইয়ের সময় অন্য রকম। এখন আমি বনের মায়ায় মুগ্ধ। প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির ডাক শোনার জন্য কান উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। তাই একা চলতে এত বেশি উৎসাহ। বিনুও হয়তো আমার মতো করেই এই নিসর্গকে দেখছে। দুজনে একই পিপাসায় পিপাসী। তাই দুজনে সঙ্গী। আমিও তাকে গ্রহণ করলাম।
চলার পথে প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম এবং নিজেকে অনুভব করছিলাম। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেয়েছি। হারাতে চাইনা এক মুহূর্ত। প্রকৃতির দুই সত্তা আমার সামনে। একজন কথা বলে, একজন ইশারা করে।
গুরুদাম(৭৫২২ফুট)। বিকেল তিনটে। হট স্যুপ, সঙ্গে লাঞ্চ। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় হোটেল। একই রুমে দশজন ছেলে, অন্য রুমে চারজন ছেলে, আরেক রুমে পাঁচজন মেয়ে। ইংরেজি বর্ষ শেষের রাত। ডিনারের পর পুরানো বছর শেষ করলাম ভৌতিক গল্পে।(ছবি ৯)

পঞ্চম দিন

যাত্রার শেষ সময় যত এগিয়ে আসছে, মনটা তত বিচলিত হয়ে হয়ে পড়ছে। এই নিসর্গ তো আজই শেষ! তারপর আবার সেই ইট কাঠ জঞ্জাল। আবার সেই নিয়মবদ্ধতা। আবার সেই মেকি ভদ্রতায় নিজেকে ঠেলে দেওয়া।
যাত্রা শুরু সারে ন’টায়। প্রথমে সিরিখোলা তারপর রিমবিক, শেষ। এবারও পুরোটাই উতরাই। পাহাড়ের পথ বেয়ে বনের মধ্যদিয়ে। আজই শেষ। আর কয়েকটা ঘন্টা মাত্র। দশ কিমি পথ মাত্র। তাই নারী আর প্রকৃতিকে যতক্ষন পারা যায় একসাথে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করার দৃঢ়-সংকল্প।
প্রায় দু’কিমি যাওয়ার পরেই একটা পাহাড়ী নদী। নাম সিরি। ছলাৎ ছলাৎ নৃত্যের তালে আমাদের আহ্বান জানিয়ে চলেছে। ব্রীজ থেকে নেমে সরাসরি তার কোলে গিয়ে আশ্রয় নিনাল ক্ষণিকের জন্য। আমার আনন্দকে মিশিয়ে দিলাম তার ধারায়। তারপর আবার বনপথ। রাস্তার ধারে ধারে দু’একটা বাড়ি। কোথাও নিচের উপত্যকায় পাঁচ-ছ’টা বাড়ি নিয়ে গ্রাম। সিরিখোলা যখন, তখন দুপুর একটা। লাঞ্চের ঘরটা সেই নদীর পাশেই। ব্যাগপত্র রেখে প্রায় সবাই বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল নদীর বুকে পাথরের উপর। পাথরগুলোকে পাক খেয়ে কেমন জলগুলো বয়ে চলেছে। (ছবি ১০)
সিরিখোলাকে বিদায় জানিয়ে শেষ যাত্রা। ঝুলন্ত ব্রীজে নদী পেরিয়ে চলা। প্রায় সমতল পথ। পথের পাশে পাশে দু’একটা বাড়ি আর জঙ্গল। আর প্রকৃতির আহ্বান। আমার পাশে বিনু। দু’একটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা নেই। চলেছি একই সাথে। দু’জনেই বিভোর। যে পাহাড়ের গা ধরে হেঁটেছি তার উপত্যকার ওপাড়ে সিকিম রাজ্য। এপাড়ের আহ্বানে সে প্রতিনিয়ত সারা দিয়ে চলেছে। আমরাও চলেছি। অন্যেরা আমাদের থেকে অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে। আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটা। পিছিয়ে থাকতে চেয়েছি। আর গোছা ভরে ব্যাগে তুলে নিতে চেয়েছি নিসর্গ ভূমিকে। শেষে গিয়ে যখন পৌঁছুলাম, তখন সবাই আমাদের অপেক্ষায়। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন, চড়াইয়ের কঠিন পথে যারা সবার আগে আর উতরাইয়ের সরল পথে তারাই সবার পিছনে? আমি বলি তোমরা কি করে জানবে আমার মনের এই বৈপরিত্য? আর আমার মনে মনে একটা বাক্যই মন্ত্রের মতো ধ্বনিত হয়ে চলেছে “কে বলে, স্বর্গ বহুদূর?”

--------------------------