ধারাবাহিক উপন্যাস চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
*****
আর আপনি? অতি সুন্দরী, এই রকম সুন্দরী আজ পর্যন্ত দেখেছি বলে মনে হয় না।-থাক থাক, আমার আর প্রশংসা করবেন না।
-আচ্ছা আপনি এখানে কি করে এলেন? সে নাই বা জানালেন। মারিয়া বলতে লাগল
-আমি …
ধারাবাহিক উপন্যাস চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
*****
আর আপনি? অতি সুন্দরী, এই রকম সুন্দরী আজ পর্যন্ত দেখেছি বলে মনে হয় না।-থাক থাক, আমার আর প্রশংসা করবেন না।
-আচ্ছা আপনি এখানে কি করে এলেন? সে নাই বা জানালেন। মারিয়া বলতে লাগল
-আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, আমার গাঁ এর নাম ছিল সােনাপুর। আমি আমার মা ও বাবা তিন জন ছিলাম। আমরা সুখেই ছিলাম। বিঘে দশেক জমির মালিক ছিলেন আমার বাবা। আর আমার রূপের খ্যাতি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। আমি যখন স্কুলে যেতাম তখন ছেলেরা টিটকিরি মারত। অনেকে প্রেম নিবেদন করত। কিন্তু সেই সময় এক জমিদারের এক বদ চরিত্রের ছেলে ছিল। তার নাম ছিল ন্যাপা। কি কদাকার দেখতে কালাে যেন মনে হয় ভয়ঙ্কর দৈত্য। ও আমার প্রায় পিছু নিতাে। সেদিন আমি স্কুল থেকে আসছি, হঠাৎ মাঝ পথে ন্যাপা ও তার সঙ্গীরা আমায় ঘিরে ধরল। ও আমায় বিয়ে করতে চাইলাে। কিন্তু আমি বললাম অসম্ভব। আমি কোনােদিন তা পারব না। ওরা আমায় নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাে। আমি ছুটতে ছুটতে যখন বাড়ি পৌঁছাই দেখি ওই জমিদারের লােকেরা আমার বাবাকে গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে আমার মা এই গির্জাতে চলে আসেন। কিন্তু তাও ওরা আমাদের পিছু ছাড়েনি। ন্যাপা তার দলবল নিয়ে এখানে আবার এসেছে।
কিন্তু ফাদার বাধা দিয়েছেন, ওরা তারপর থেকে আর আসেনি। তার কিছুদিন পর আমার
মা মারা যান। আর তারপর এই.....। চোখের জল দুই হাত দিয়ে মুছতে থাকে মারিয়া।
ধীরে ধীরে সূর্য দিগন্তের মধ্যে ডুবে যায়। কিছুক্ষন নিঃশব্দে চলতে থাকে দুই জনে। পাখির কলরব শুনতে পায়। দুরে মােল্লাল গ্রাম দেখা যাচ্ছে, সবুজ বনানী দিয়ে যেন গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে। চন্দ্র মারিয়ার দিকে মুখ ফেরাল।
সূর্যাস্তের রাঙানো স্বপ্ন নিয়ে সন্যাসিনী মারিযা উদাসভাবে হেঁটে চলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাসের হতাশ সুর মারিয়ার মধ্যে ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ নিরীক্ষণের পর বুঝতে পারল চন্দ্র। তখন মোল্লাল গ্রামটি ঘন আঁধারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
ক্রমে ওরা রজনী বুড়োড় বাড়ি পোঁছাল। ছােট কুঁড়ে ঘরে টিম টিম করে হ্যারিকেনের আলাে জ্বলছে ওদের দেখে রজনী বুড়াে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। উঠানে চাটাই পেতে বসতে দেয়। চন্দ্রকে দেখে বলে ডাক্তারবাবু সেই যে গেলেন আর তো এলেন না। চন্দ্রের লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল মুখখানি। চন্দ্র প্রশ্ন করে-কারাে আবার অসুখ করেছে ?
আমার ছােট ছেলের তিন চারদিন জ্বর কিছুতেই নামছে না, বলে বৃদ্ধ। চন্দ্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সমুকে দেখল। তারপর বলে -নিউমোনিয়া ঠান্ডা লেগে হয়েছে। ঔষধ লিখে দিচ্ছি খাওয়াবেন ঠিক হয়ে যাবে। রজনী বুড়াে বলল -ভয়ের কিছু নেই তো ডাক্তারবাবু?
না ও সেরে যাবে চিন্তা করবেন না। মারিয়া এতক্ষণ নীরব হয়ে একমনে চন্দ্রকে দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশটা দেখল থমথমে। আপনি একা যেতে পারবেন গির্জাতে ?
-আমায় সারারাত এখানে থাকতে হবে।
মারিয়া জিজ্ঞাসা করে -কঠিন কিছু হয়েছে ?
-বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে দেখছি।
-আপনাকে আমি কিছুটা পৌঁছে দিয়ে আসছি চলুন। ওরা নিঃশব্দে চলতে লাগল। মাঝে মাঝে পাখির প্রহর কলরব -শোনা যেতে লাগল, দু-একটা শেয়ালের আর্তনাদ ভেসে এলাে ওদের কানে।ওকে কিছুটা পৌঁছে দেওয়ার পর ফিরে এল চন্দ্র। সারারাত ধরে চিকিৎসা করার পর, সমুর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে দেখে—
—দেখে বাইরে বেরিয়ে এলাে চন্দ্র। সূর্য উঠেছে ওই আকাশের বুক চিরে। সারারাত চোখে ঘুম ছিলনা। চন্দ্র হঠাৎ ব্যাগটা নিয়েই চলতে শুরু করল। বৃদ্ধ রজনী বুড়া তখন ঘুমে অচেতন। চন্দ্র মনে পড়ল কাল সুজন চাষি এসেছিল মারিয়ার কাছে। মাধব মহাজনের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে আজ সকালে ওদের ওখানে যাওয়ার কথা। মারিয়া ওকে ডেকেছিলো। চন্দ্র তাড়াতাড়ি পা চালাল। ধীরেধীরে সূর্য উপরে উঠতে লাগল। যখন গির্জার কাছে পৌঁছাল তখন চাষিরা মারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের পাশ কাটিয়ে গির্জার ভেতরে প্রবেশ করার সময় বলল -ভাই তােমরা দাঁড়াও আমিও যাব। মারিয়া ওর উপস্থিতি টের পেয়েছে। চন্দ্র যে এসেছে ও বুঝতে পারল। মারিয়া চন্দ্রের সামনে এসে দাড়াল। কিছুক্ষণ ভালাে করে দেখার পর, বলে আপনার গিয়ে কাজ নেই আমি একাই পারব। আপনি বিশ্রাম নিন। আপনি এখন ক্লান্ত সারারাত আপনি ঘুমােননি। কারন চোখগুলাে জবা ফুলের মতাে লাল দেখাচ্ছে। কে শােনে কার কথা। চন্দ্র জামা প্যান্ট পাল্টিয়ে গির্জার বাইরে বেরিয়ে এলাে পিছনে পিছনে মারিয়াও বেরিয়ে এলাে। ওরা চাষিদের নিয়ে মাধব মহাজনের
আড়তে পৌঁছাল। ওদের দলবল দেখে মহাজন ভয় পেয়ে গেল। সামনে মারিয়াকে মাধব দেখে, এই মেয়েটাই তার সব গন্ডগােল করে দেয়। কবে যে ওকে সাবাড় করতে পারবে সেই সুযােগ খুঁজছে এতদিন কিন্তু বাগে পায়নি। মারিয়া বলে-আপনি চাষিদের ফসলের দাম ভাল দিচ্ছেন না। ওদের মুর্খামির সুযােগে ওদের কাছ থেকে ফসলের ওজন কমিয়ে লিখছেন। | মাধব ঝাঁঝিয়ে ওঠে এসব মিথ্যা কথা! এরা সব মিথ্যে বলছে। মারিয়া প্রশ্ন করল আর আপনি সত্য বলছেন?
এতক্ষণ চন্দ্র চুপচাপ ছিল এবার মুখ খুলল-শুনুন মাধববাবু আপনি যদি শান্তিতে বাস করতে চান তাে ওদের পাওনা নিজে না মেরে ওদের দেবেন।
আর যদি অন্যথা করেন, তবে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। সেদিন থেকে মাধব মহাজন আর কোন গণ্ডগোল করেনি। ধীরে ধীরে একটা বছর পার হয়ে যায়। মারিয়ার মনে দুর্বলতা ধীরে ধীরে
জায়গা করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ চন্দ্র না থাকলে মারিয়ার মনে বেদনার সুর বেজে ওঠে।
যিশুর কাছে বারে বারে প্রার্থনা বিফল হয়ে পড়েছে।
সেদিন ওরা দুজনে বেড়াতে গিয়েছে সুবর্নরেখা নদীর ধারে। চন্দ্র আনমনে
উঁচু পাথরের ওপর বসে নদীর জলের জোয়ার ভাটার স্রোতের কলতান লক্ষ
করছিলাে। মারিয়া বালিতে আঁকচিরা কাটতে কাটতে হঠাৎ চন্দ্রের দিকে তাকায়। চন্দ্র তখন তন্ময় হয়ে স্রোতের পানে তাকিয়ে আছে। মারিয়ার মনে হলাে কোনোে দেবতা তার সৃষ্টির ধারা অবলােকন করছেন। মারিয়ার মনে হলাে চন্দ্রের কাছে দুনিয়ার সবকিছু তুচ্ছ। মারিয়া দুর্নিবার আকর্ষনে ছুটে গিয়ে চন্দ্রের মুখে গভীর উষ্ণ চুম্বন বসিয়ে দেয়। চোখের পলকে বলে ফেলে আমি তােমায় ভালবাসি। চন্দ্র ওর মুখ চেপে ধরে শান্তভাবে বলে আপনার মনে নেই আপনি সন্যাসিনী। আপনি এই ধরীত্রির প্রাণ সঞ্চারনের কাজে ব্রতী। এসব জেনেশুনে এসব পাপ করতে দিতে পারি না।
সত্যিই তাে আমি একজন সন্যাসিনী আমায় এসব মানায় না। এ যে আমি ভাবতে গিয়েছিলাম সত্যিই এর কোন ক্ষমা নেই। মারিয়ার শিরা উপশিরায় বসে যেতে লাগল এক অসহনীয় ঘৃনার স্রোত। চন্দ্র লক্ষ করে মারিয়া শান্ত নীল আকাশের মতাে হয়ে গেছে। ওর দুটি চোখে যেন সমুদ্রের অতলান্ত শক্তি ধীরে ধীরে দিকে দিগন্তে গাড় আঁধারে ঢেকে দিলাে। হঠাৎ মধ্যরাত্রিতে পেঁচার ডাকে ঘুম ভেঙে যায় চন্দ্রের। পাশের ঘরে লক্ষ করল, মারিয়া নেই। চন্দ্র এগিয়ে গেল কনকনে হাড় কাঁপুনি শীতে কম্বল ভালাে করে জড়িয়ে নিলাে। গির্জার দরজা খােলা দেখে উঁকি মারল।
শুধু দেখতে পেল, মাঝরাতের আলেতে মারিয়ার মুখখানি। চোখের জল আলােতে চকচক করছে। হঠাৎ একরাশ ঠান্ডা বাতাস যেন চন্দ্রের কান দুটো অবশ করে দিয়ে গেল। চন্দ্র প্রবেশ করল ভিতরে। ভেতরের দৃশ্য দেখে চমকে উঠল মারিয়ার সারা শরীরে মাত্র একফালি কাপড়। সারা অঙ্গ ঠকঠক করে কাঁপছে। তাহলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। কিন্তু ও তো কোনো পাপ করেনি। বিধাতার সৃষ্টির সব কিছুই প্রেম ভালবাসা তারই তাে অঙ্গ।
কিন্তু মারিয়ার বেলায় অন্য রকম ব্যবস্থা কেন বিধাতা! কিন্তু সে নিজে তাে অপরাধী।
আজ হয়তাে মারিয়াকে গ্রহন করতে পারতাে। কিন্তু সে তাে আর একজনের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। চন্দ্র জানে তার অভিমান মরনের পর গােধূলির আত্মার সঙ্গে মিলিত হবে। গােধূলির জায়গা অন্য কারাের হতে পারে না। ধীরে ধীরে এগিয়ে মারিয়ার কাছে কম্বল জড়িয়ে দিলাে তার গায়ে। —এভাবে যদি নিজে নিজেকে শেষ করে দাও তাহলে মানুষের সেবা কি করে করবে?
জানি 'আমিই আপনার দুঃখের একমাত্র কারন। তাই আমি চলে যাচ্ছি। মারিয়া উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রের দিকে।
গােধূলির মন থেকে ধীরে ধীরে চন্দ্র মুছে যেতে লাগল, গােধূলি বারানসী যাওয়ার বায়না ধরতেই শরৎ চিন্তা করতে লাগল ও রোগ থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। তাই তার বায়নায় রাজি হয়ে গেল শরৎ। তাই বারানসী যাওয়ার তিন টি টিকিট নিয়ে এল শরৎ।
-আর কে যাবে রে দাদা ?
-আমার একজন বন্ধু আছে সেও যাবে। খুব বড়লােকের ছেলে।
ওরা বেরিয়ে পড়ল। শরৎ-এর বন্ধুটি খুব স্মার্ট নাম সুলােচন। ওরা তিন জন ট্রেনে ওঠে। আবার গােধুলির মনে প্রেম আসে।
-চলবে