#শুরু হল এক নিঃশব্দ বিপ্লব
(জাগো দুর্গা)
#গল্প
#সুস্মিতা
বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার পা রেখেই সুনয়নার মনে হয়েছিল- ও যেন একটা অন্য পৃথিবীতে এসে পৌঁছল।
সবকিছুই কিরকম অন্যরকম।
বাপেরবাড়িতে বাবার হাতে তৈরি বাগানটাই ছিল সুনয়নার …
#শুরু হল এক নিঃশব্দ বিপ্লব
(জাগো দুর্গা)
#গল্প
#সুস্মিতা
বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার পা রেখেই সুনয়নার মনে হয়েছিল- ও যেন একটা অন্য পৃথিবীতে এসে পৌঁছল।
সবকিছুই কিরকম অন্যরকম।
বাপেরবাড়িতে বাবার হাতে তৈরি বাগানটাই ছিল সুনয়নার জগত। গেটের কাছে দাঁড়ানো লম্বা সুপুরি গাছটা আর তাকে জড়িয়ে ধরা মাধবীলতা... তারা তো আত্মীয়স্বজন। বাড়ির পেছনের ইউক্যালিপটাস গাছটার নাম সুনয়না দিয়েছিল নীলু , সে ওর প্রাণের বন্ধু।
এ বাড়িটা একেবারে বড় রাস্তার ওপরে। চারিদিকে কোনো গাছ নেই।বাড়ির সামনে অবিরাম বাস, ট্যাক্সি।
বই পড়ার নেশা ছিল সুনয়নার। বাবা নিজে সেই নেশা ধরিয়েছিলেন মেয়েকে। পাড়ার লাইব্রেরিটা ছিল সুনয়নার মক্কা মদিনা। বাপেরবাড়িতে গল্প আড্ডার বিষয়বস্তুই থাকত পুজোসংখ্যার নতুন লেখা, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া এইসব...
এবাড়িতে বাংলা গল্পের বইয়ের গল্প কেউ করেনা...
আরও কত কি যে অন্যরকম। সুনয়নার বাবা যত্ন করে শেখাতেন- এই পৃথিবীতে সকলের অধিকার সমান, সব মানুষ সমান, সকলকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়" ...
এ বাড়ির গুরুজনরা তাঁদের ক্ষয়াটে বনেদিয়ানা নিয়ে কি নিদারুণ অহংকারী। তাদের পূর্বপুরুষরা কবে কোনকালে লাখ টাকার ঝাড়বাতি কিনে, মুহূর্তের ক্রোধে উত্তেজনায় সেটিকে চুরমার করে ভেঙেছেন,সেই গল্পই এবাড়ির গর্বের ইতিহাস।
এখানে মহিলাদের বিশেষ করে বাড়ির বউদের পুরুষের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হয়। বৌমাদের বাপেরবাড়ি থেকে বাবা মা, আত্মীয়স্বজন এলে, তাঁদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় তীব্র অহংকারের তীর। যাতে তাদের মাথাটা কুণ্ঠায় নত হয়ে থাকে।
বাড়ির কাজের সাহায্যকারীদের সঙ্গে কি মধ্যযুগীয় জমিদারী ব্যবহার।
ওদের জন্য আলাদা চালের ভাত হয়। সুনয়না অবাক হয়ে দেখত বাড়ির মালিকদের আর কাজের লোকদের চা পর্যন্ত একসঙ্গে বানানো হয়না। মালিকের চা বানানোর পরে সেই চা পাতা আবার দ্বিতীয়বার ফুটিয়ে ওদের চা তৈরি হয়।
প্রথমদিকে সুনয়না বোঝার চেষ্টা করত "এই পদ্ধতিতে লাভটা কি হয়? এটা কি অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের জন্য? কিন্ত তাহলে দ্বিতীয়বারের জ্বালানি খরচ?"
ক্রমশ ও বুঝতে পারে এটার আসল উদ্দেশ্য কাজের মানুষটিকে বুঝিয়ে দেওয়া- "ভুলে যেওনা তোমার আর আমার শ্রেণী কিন্তু আলাদা, আমি মালিক আর তুমি..."
সুনয়নাদের ছোট একতলা বাপেরবাড়িটার ছাদে যখন দুটো নতুন ঘর বানানো হচ্ছিল, রাজমিস্ত্রি করিমচাচারা তখন দল বেঁধে এসেছিল মুর্শিদাবাদ থেকে। সারাদিনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বাবা নিজের হাতে তাদের সকলকে চায়ের কাপ তুলে দিতেন। সুনয়না তখন নেহাতই শিশু। করিমচাচার কোলে চেপে উঁচু আমগাছ থেকে আম পাড়া ছিল এক মজার খেলা।
অথচ এ বাড়িতে...
শৈশবের প্রানের বান্ধবী নাগমা যেদিন ওর দুই ছেলেকে নিয়ে সুনয়নার নতুন শ্বশুরবাড়ি দেখতে এল...ভয়ে, সংকোচে বুক কাঁপছিল সেদিন সুনয়নার।
কোথায় বসতে দেবে, কোন প্লেটে খেতে দেবে ওদের। নাগমার ছোট বাচ্চারা যদি ভুল করে শাশুড়ির ঠাকুরঘরে ঢুকে যায়, ঠাকুর ছুঁয়ে দেয়... কি হবে তাহলে? সে যে এক সাংঘাতিক কান্ড হবে বাড়িতে।
সুনয়নার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল জাহিরাচাচীর সেই আদর করে লাচ্ছা পরোটা আর সেমাই খাওয়ানোর কথা।
সত্যি এই বাড়িটা সুনয়নার জন্য এক অন্য জগত। ওর বাপেরবাড়ির জগত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইদের জগত থেকে একেবারে আলাদা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকের উদাও কণ্ঠ গাওয়া "পল রোবসনের গান" সুনয়নাকে মাঝেমাঝেই আনমনা করে দিতো।
এখানে সবাই কিরকম অপরিচিত।
একেক সময় খুব কান্না পেত সুনয়নার। আবার মাঝেমাঝেই মনের মধ্যে জ্বলে উঠত আগুন। গভীর রাতে চোখের জলেই সেই আগুন নিভিয়ে দিত সুনয়না...
কিন্তু একটা দিনের ঘটনার পর থেকে সুনয়না কিরকম পাল্টে গেল, ওর সব ভয় কেটে গেল।
সতেরো আঠারো বছরের একটি হরিজন কিশোর মাঝেমধ্যে এসে সুনয়নার শ্বশুরবাড়ির বাথরুম ধুয়ে দিত। তারপরে কোনো এক সময় সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসত তার প্রাপ্য টাকাটা নিতে।
সেরকমই একদিন ছেলেটি এসেছে টাকা নিতে। বাড়িতে তখন শুধু সুনয়না এবং তার শাশুড়ি। তাঁর স্নান সারা হয়ে গিয়েছে, তিনি পুজোয় বসেছেন। অতএব সুনয়নাকে তিনি হুকুম দিলেন ছেলেটির টাকাটি দিয়ে দিতে।
ছোঁয়া বাঁচিয়ে শাশুড়ি অবশ্য পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন,কারণ নতুন বৌমার রকমসকমের ওপরে তিনি ভরসা করতে পারেনা। ছোঁয়াছুঁয়ি, জাতপাত, এঁটোকাটা ইত্যাদির বিচার বিবেচনায় বৌমা শ্বশুরবাড়িতে ঠিক পাশ করতে পারছেনা।
না, একহাত ওপর থেকে ছুঁড়ে নয়, আর সকলকে ঠিক যেভাবে টাকা দিতে হয়, যা সুনয়না আজন্ম শিখেছে, ঠিক সেভাবেই ছেলেটির হাতে তারই প্রাপ্য সামান্য অর্থ তুলে দিলো সুনয়না...
টাকা দেওয়ার সময় হরিজন কিশোরটির হাতের সঙ্গে সুনয়নার হাতের ছোঁয়া লাগতেই চিল চিৎকার করে উঠলেন শাশুড়ি। সেই চিৎকারকে মরাকান্নাও বলা যায় কিম্বা গালাগালি...
সুনয়না হতবাক।
বনেদি বাড়ি...তাই মারধোর করাটা বাকি ছিল...
স্তব্ধ হয়ে যায় সুনয়না। নিজের অপমান, ব্যথার থেকেও সে বেশি লজ্জিতবোধ করেছিল আঠারো বছরের তাজা কিশোরটির মুখের অবস্থা দেখে...
আঠারো বছরের এক তাজা প্রাণ, নিষ্পাপ কিশোর। তার মুখের প্রতিটি রেখায় লেখা বহুযুগের সামাজিক অপমান, বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস...
নতুন তরুণী বধূটির মাথার মধ্যে তখন বেজে চলেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টারমশাইয়ের গমগমে কন্ঠস্বর- "এই পৃথিবীর ইতিহাস শুধুই শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।"....
কিন্তু কি যে হল...কি যে দেখতে পেল সুনয়না সেদিন সেই কিশোরের দৃষ্টিতে...
কোথায় যেন বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। সুনয়না টের পেল "নাহ এবার সময় এগিয়ে আসছে, প্রান্তিক মানুষরা এক এক করে এগিয়ে আসছে...তারা হাতে তুলে নিচ্ছে তীর,ধনুক, টাঙ্গি...
ওই যে জ্বলছে মশাল...জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন"...
সেদিনের পর থেকে সুনয়না আর কখনও ভয় পায়নি। তার মনের মধ্যে শুরু হল এক নিঃশব্দ বিপ্লব...
চরাচর জুড়ে তখন শোনা যাচ্ছে
মহামেঘ প্রভাং ঘোরাং
মুক্তকেশী চতুর্ভূজাং
কালিকাং দক্ষিণাং
মুণ্ডমালা বিভূষিতাং
*******
(কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যয়কে জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন।)
ছবি: সংগৃহীত