Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

||ভোর||

ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং– দেওয়াল ঘড়িটা জানান দিল ৫ টা  বাজছে।
অবশ্য না জানালেও খুব একটা সমস্যা ছিল না।
কারণ দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুরেই ধ্বনিত হচ্ছে সময়। কি পবিত্র এই সুর।
আচ্ছা, আজানের রাগ কি ভৈরবী?
এত স্নিগ্ধ, এত পবিত্র, এত শ…


||ভোর||

ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং– দেওয়াল ঘড়িটা জানান দিল ৫ টা  বাজছে।
অবশ্য না জানালেও খুব একটা সমস্যা ছিল না।
কারণ দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুরেই ধ্বনিত হচ্ছে সময়। কি পবিত্র এই সুর।
আচ্ছা, আজানের রাগ কি ভৈরবী?
এত স্নিগ্ধ, এত পবিত্র, এত শান্ত, এত নির্মল! আহ্, সংগীত!
তুমি এত শুদ্ধ কেন?
অন্তরের প্রতি ভাঁজে এসে পৌঁছাও বলেই কি তোমার নাম প্রার্থনা?
শেষপর্যন্ত নিমগ্ন হয়ে শুনলাম।
তারপর ধীরে ধীরে আমার বইয়ের তাক থেকে টেনে নামালাম জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
তারই একটা পাতায় সবে মাত্র চোখ রেখেছি, শুনতে পেলাম শালিখ পাখির কিচিরমিচির।
জানালাটা একটু খুলতেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একমুঠো ঠান্ডা বাতাস।
আমি অবাক চোখে বাইরে  তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
মন্ত্র মুগ্ধের মতো দেখলাম  গাছেদের ডালে ডালে, এপাতা থেকে ওপাতায় অবাধ্য ফোটনকনাদের লুকোচুরি খেলা।
পরমুহূর্তেই বইতে চোখ যাওয়ায় আবার বিস্ময় ঘিরে ধরল আমায়।
বাইরের চোখধাঁধানো অপরূপ দৃশ্যই তো অক্ষর হয়ে ফুটে উঠেছে শিল্পীর ইজেলে –

“ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে-মুক্তা আমার নীল মদের
গেলাসে রেখেছিলো
হাজার-হাজার বছর আগে এক রাতে— তেমনি—
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনও।"

সেই মুক্তা রাখা নীল মদের গেলাস এক চুমুকে আস্বাদন করতে,  কিছুটা সম্মোহিতের মতোই, দৌড়ে গেলাম বাড়ির বাগানে।
সারা বাগান জুড়ে তখন ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো সাদা ফুলের কার্পেট বিছানো।
আমি মনে মনে ভাবি ভারি অদ্ভুত এই ফুলগুলো।
সূয্যিমামার সঙ্গে এদের চিরজন্মের আড়ি।
নিজেদের মতো রাতের বেলা ফোটে, আলো ফোটার আগেই ঝরে পড়ে।
খানিক দুরে তাকাতেই দেখি শুরু হয়ে গেছে পাখিদের পাঠশালা।
একটু পরেই বেরিয়ে পড়বে ওরা, বেরিয়ে পড়বে আকাশে, হয়তো বেরোবে মানুষের মতোই জীবনের না পাওয়া প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজার তাগিদে।
আরো একটু এগিয়ে বাগানের ঈশান কোনে গেলাম।
বাগানের এদিকে আমাদের একটা  বকুল গাছ আছে।
বকুলের গন্ধ আমার বড়ো প্রিয়।
বকুলেরই তলায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে ভাঙা পাঁচিলের, ফাঁক দিয়ে বাইরেটা।
ওপাশের ফুটপাথে যারা ঘুমিয়ে আছে ওটাই তাদের ঠিকানা।
তাদের মাথার ওপর  ছাদ বলতে ঐ সুবিস্তৃত আকাশ।
সম্বল ঐ একটুকরো ময়লা কাপড়।
“হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য” তারা রোজ  আগুন জ্বেলে শোয়-
“মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন;
শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনও আগুন জ্বলছে তাদের;
সূর্যের আলোয় তার রং কুঙ্কুমের মতো নেই আর;
হ’য়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।”
তাদের এই কষ্ট আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে।
কিন্তু তাদের দুঃখ ঘোঁচাবার মন্ত্র যে আমার জানা নেই।
ভারাক্রান্ত আমি তাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াই।
ধীর পায়ে এগিয়ে চলি সামনের দিকে, তারা পড়ে থাকে পিছনে।
আঁধারের অভেদ্য বুক চিরে রোদ এসে লুটিয়ে পড়ছে উঠোনে।

"সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের
সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।"

ঘরের ভিতর গিয়ে বিষন্নতা কাটাতে টিভি চালিয়ে বসি।
কিন্তু  কি বলছে এসব টিভিতে?
কি করে হল এমন? কেন ঘুম ভাঙলো না ওদের?
একটা আস্ত মালগাড়ি, “একটা অদ্ভুত শব্দ”, ওদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেল?
কিই বা অপরাধ ছিল ওদের?
একদিকে মারণভাইরাস, অন্যদিকে খিদের জ্বালা; কর্মক্ষেত্র থেকে অপ্রয়োজনীয় আগাছার মতোই ছেঁটে ফেলা  হয়েছে ওদের।
মাথাগোঁজার শেষ ঠাঁইটা থেকেও তো ওরা বঞ্চিত, আর তারপর?
তারপর জুটেছে পরিযায়ীর তকমা। ওদের জীবনের কোনো দায় না নিয়ে,ওদের জীবনের কোনো দাম না দিয়ে, ওদের জীবনের সব রস নিংড়ে, সমাজের অন্ধকার, দুর্গন্ধ জঞ্জালের স্তূপে ফেলে দেওয়া হয়েছে ওদের।
তবুও ওরা আশা ছাড়েনি।
বাচ্চা থেকে বুড়ো, সন্তানসম্ভবা মা, অসুস্থ পিতা সকলে সামিল হয়েছে স্বনির্ভরতার মিছিলে।
পায়ে হেঁটে,  সাইকেল চেপে, খালি পেটে, অনির্দিষ্ট জীবনের পথে  মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছে ওরা।
এত কিছুর সাথে যুদ্ধ করে, হয়তো একটু ক্লান্তিই গ্রাস করেছে ওদের!
প্রয়োজন হয়েছিল একটু বিশ্রামের!
হয়তো আবার একবার নতুন  উদ্যমে ছোটার জন্যই আগের রাতে  পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি মনে করে একটু চোখ বুঝিয়েছিল ওরা!
বিশ্বাস করেছিল নতুন সূর্যোদয় হবে।
কিন্তু কে জানতো ওদের  সেই ঘুম ভাঙবে না আর?
কে জানতো  এতকিছুর  পরেও শেষ হয়ে যাবে সব?
কে জানতো ঐ নৃশংস পরিস্থিতির “শিকার” হবে  ওরা?
যে  নতুন ভোরের সূচনা হবে তা যে আরও বিষাদময়, ক্লান্তিকর তাও কি জানতো কেউ?
গালের ওপর গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।
অসমাপ্ত এই "শিশিরভেজা গল্প" গুলো থেকে যাবে আমার জীবন উপন্যাসের জীবন্মৃত এক একটা  অধ্যায় হয়ে।
এই রক্তিম ভোর মিশে যাচ্ছে  "মচকাফুল" এর  সঙ্গে।
হরিণের মতোই মানুষ গুলো তলিয়ে গেছে "নিঃস্পন্দ, নিরপরাধ ঘুম" এর দেশে।
ভারী বাতাসে শ্বাস রুদ্ধ হচ্ছে ক্রমশ।
একটা প্রবল মন খারাপের নিকষ কালো মেঘ এখন  দ্রুতগতিতে  ঘিরে ধরছে আমায়।
চারপাশের কোমল আলোতেও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে রেললাইনের অব্যক্ত, অস্ফুট অন্ধকার।
 তবু  এত সব কিছুর মাঝেও   একটা সুন্দর ভোরের জন্য  অপেক্ষা করব আমি।
অপেক্ষা করব আবারও।
অপেক্ষা করব–“অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য।"
অপেক্ষা করব – “এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে” ওঠার জন্য।
অপেক্ষা করব– রাতের অন্ধকারের মতো সমস্ত রাগ, কষ্ট,  অভিমানের আড়াল থেকে আনন্দ, স্বপ্ন, বিশ্বাস আর ভালোবাসায় মোড়া লাল রঙে সদ্য সিক্ত একটা নিষ্পাপ ভোরের জন্য।
#শব্দগ্রাফি

কলমে- দেবাশ্রিতা মজুমদার
কবিতা ঋণ - “শিকার”–জীবনানন্দ দাশ
ফটোগ্রাফি- হিয়া