Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

গল্প : জীবন্ত লাশ

কল্পদেব চক্রবর্তী

 সুমন প্রতিদিন এ পথেই প্রাতঃভ্রমণে যায়। দুই ক্রোশ বৃত্তাকারে রাউন্ড মেরে এপথেই ফেরে।

 আজ হঠাৎ একটা বিশেষ দৃশ্যে ওর চোখ থমকে যায়। পথের পাশে ডান ফুটপাতে খালপাড়ের ধারটায় মলিন শাড়ি পরিহিতা এক …


গল্প : জীবন্ত লাশ

কল্পদেব চক্রবর্তী

 সুমন প্রতিদিন এ পথেই প্রাতঃভ্রমণে যায়। দুই ক্রোশ বৃত্তাকারে রাউন্ড মেরে এপথেই ফেরে।

 আজ হঠাৎ একটা বিশেষ দৃশ্যে ওর চোখ থমকে যায়। পথের পাশে ডান ফুটপাতে খালপাড়ের ধারটায় মলিন শাড়ি পরিহিতা এক বয়স্কা মহিলা শুকনো ডালপালা জোগাড় করে ইটের উনোন বানিয়ে কালিমাখা টোল পড়া হাঁড়িতে কিছু একটা রন্ধন করছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গী। যেন প্রাত্যহিক কর্ম। অথচ কালকেও তো এখানে ছিল না।  সুমন আজই দেখছে।

 তার ঠিক উল্টো দিকে বাঁদিকের ফুটপাথে ছেঁড়াফাটা ব্যাগে কিছু তল্পিতল্পা। সিমেন্টের খালি বস্তায় কিছু ঘর সংসারের টুকিটাকি।

 সুমনের চোখ যেখানে থমকে যায় সেই প্রশ্ন এখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কেউ গায়ে মাখছেনা। পথচারী তো আরো অনেকে আসা-যাওয়া করছে। একবার আড়চোখে তাকিয়েই  আরও দ্রুত পদযাত্রা।

একটি মেয়ে কত বয়স হবে পনের কি সোলো, তার বেশি নয় মোটেই।সারল্য অনাদর আর অবহেলায় একটা আস্তরন মুখন্ডলে। ঠোটের কোন দিয়ে গ্যাজলা ঝরছে। মলিন জামাটা মনে হয় অনাহুত আক্রমণে জায়গায় জায়গায় ছিন্নভিন্ন। নিম্নাঙ্গের জামাটা রক্ত রাঙ্গা লাল। রক্ত ভেজা শরীরে কিছু মক্ষিকা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। ভনভন করে উড়ছে চারিপাশে।

কি হতে পারে সুমন দাঁড়িয়ে চিন্তান্বিত। বৃদ্ধা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেভাবেই উনুনের পাশে বসে।
 কাল দেখেছিল বটে, বাইপাসে হোটেল লাগোয়া মোড়টায় ঝুঁপরি  গুলো উচ্ছেদ হচ্ছে। রাস্তা সম্প্রসারণ হবে। সৌন্দর্যায়ন হবে।ফুটপাথে  ইট দিয়ে গাঁথা হচ্ছে ফুলের টব। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসছে মনীষীদের মূর্তি।

ঝুপড়ির যত পুরনো বাসিন্দা ওরা  তেপান্তরের মাঠের পাশে জলা জায়গাটায় উচ্ছেদ হওয়া বাস খুটি টিন দরমার বেরা সব বয়ে নিয়ে গিয়ে কোনরকমে দিন গুজরানের একটা ব্যবস্থা করেছে।

ওরা শরণার্থী। যখন তখন লাথি-ঝাটা খাওয়া ওদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

 শরণার্থীদেরও এ গ্রুপ, বি গ্রুপ আছে। একদম নতুন যারা তারা সি এবং ডি গ্রুপের সদস্য। সি এবং ডি গ্রুপের সদস্যরা আবার এ এবং বি গ্রুপের দাদাগিরি দ্বারা অত্যাচারিত হয়। তাদের অবস্থা আরো অবর্ণনীয়। লড়াইয়ে টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়।

সুমনের মনে হলো এই বুড়ি মা এবং তার মেয়ে হয়তো সি বা ডি গ্রুপের সদস্যা। সৌন্দর্যায়নের বলি হয়েছে।

খাল পাড়ের ধারে যে বাঁশবনটা আছে, জায়গাটা খুব নিরিবিলি। মাঝে একটা পুকুর। চারপাশটা আগাছা আর জঙ্গলে ভরা। গাছের পাতা পড়ে পড়ে জমা জলটা কালো হয়ে আছে। এককালে সুন্দর বাঁধানো ঘাট ছিল বোঝা যায়। এখন ইট গুলো প্রেত আত্মার মতো দাঁত বাড় করে হাসছে। ভগ্নদশা,স্থাপত্যে কারুকার্যে বোঝাযায় এটা কোনো বিত্তশালীর পরিত্যক্ত বাড়ি। সন্ধার পরে ওই বাড়ির  পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন যেন গা ছমছম করে।

সোমেনের দিদির বাড়ি ওই ভুতুড়ে বাড়ির কিছুটা দূরে।মাঝে খাল। তারপর একটা মাঠ থাকাতে সরাসরি বাড়ি টাকে দেখা যায়। দিদি বলে ওটা নাকি ভুতুড়ে বাড়ি। অনেক রাতেই নারী কন্ঠে আর্তনাদ শোনা যায়। গোঙ্গানির
আওয়াজ, ফিসফিস কথা।  হুট-পাট হুলুস্থুল শব্দ।সে সব গল্প কানে কানে বেশ চাউর হয়ে আছে।

সোমেন পায়ে পায়ে ফিরে যায় বুড়ি মার কাছে। ' ও বুড়ি মা রান্না হল? ' বুড়ি অবাক চোখে চায় সোমেনের দিকে। তারপর হয়তো ভাবে এ উচ্ছেদকারী দলের লোক নয়। প্রথমে হয়ত তেমনই ভেবেছিল। খোলা আকাশের নিচেও থাকতে দিতে চায় না। তাই হয়তো ভগবান পাঠিয়েছে একে। ধীর কণ্ঠে বলে, ' রান্না নয় রে বাবা, কচুর শাক সেদ্ধ করে রাখলাম।মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে ওর খিদে পাবে। তখন কিছু মুখে তো দিতে হবে। '

এতক্ষণে ভালো করে মহিলার মুখটা দেখতে পেল সোমেন। বুড়ি নয় মোটেই। বছর পন্চাশের একজন মহিলা। অভাবে অত্যাচারের মলিন পান্ডুলিপি সর্বাঙ্গে আঁকা। এ তাহলে ওই মেয়েটির মা।

' ও তাহলে তোমার মেয়ে,অমন ভাবে পড়ে আছে কেন,কি হয়েছে ওর?'

 বুড়িমা হাত তুলে বাঁশ বনের দিকে দেখায়,  বলে, ' মেয়েটারে কুমারী থাকতে দিলে না রে।কাল রাতে ওই বাঁশবাগানে তুলে নিয়ে গেলো। কতো হাতে পায়ে ধরলাম।বললাম ওরে ছাড়, আমাকে নিয়া চল। সারা রাত রেখে দিবি, যা খুশি করবি। মেয়েটারে ছাড়। সবে ফুলের কুঁড়ি ফল পাকতে দে। শুনলে না আমার কথা। লাথি মেরে ছিটকে দিলে।'

সোমেন বুঝতে পারল, বাঁশবাগানের প্রেতআত্মা কারা। নিশুতি রাতে নারী কন্ঠে কাদের কান্না শোনা যায়। ফিসফাস কথা, হুটপাট হুলুস্থুলু শব্দ, সব গল্পই পরিষ্কার হয়ে যায় সোমেনের কাছে।

 কিন্তু এখন মেয়েটা কে বাঁচাতে হবে। এখনো কি নিম্নাঙ্গ দিয়ে রক্ত পরছে।সৌমেন আর একবার চেয়ে দেখে মেয়েটিকে। না রক্তের তাজা ভাবটা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। ঠোঁটের ফাঁকে দুঢোক' জল ঢেলে দিতেই মেয়েটি নড়ে ওঠে। বলে, ' ও বুড়িমা ঞ্জান এসেছেগো।'

বুড়িমা তেমনই নির্লিপ্ত। আকাশের দিকে চেয়ে কপালে হাত ঠেকায়।  সোমেন বলে , ' ওকে হাসপাতালে নিতে হবে আমি গাড়ি ডাকছি। তুমি ওকে খেয়াল রাখো।'বুড়িমা হাতের ইশারায় না করে। বলে, ' ও কিছু হবে না আমার পনের বছর টাও এই ভাবেই শুরু হয়েছিল। প্রথম ধকল, তাই নেতিয়ে পড়েছে। সবে তো শুরু হল।'

 সোমেন অবাক চোখে চেয়ে থাকে। কি নিদারুণ নিষ্ঠুর বাস্তব এরা প্রতিদিন জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে। মাথার উপরে ছাদ নেই! আব্রু নেই! লজ্জা থাকতে নেই ! ওদের কিছু নেই। ওরা জীবন্ত লাশ।
লোকে বলে পোড়োবাড়িতে প্রেতাত্মার কান্না প্রতি রাতে শোনা যায় ! রাতের প্রেতাত্মা যে ওরাই কেউ তা জানতে চায় না !!!

        ******** সমাপ্ত ********