#ছোট_গল্প#তোমার_খোলা_হাওয়ায়#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
হ্যালো... হ্যালো...টেলিফোনের অপর দিক থেকে কারো কন্ঠই শুনতে পাচ্ছে না নবনীতা। এটা আজ প্রথমবার নয়, কয়েকদিন ধরেই কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না ফোনটাতে। আজ মেন্টেন্যান্স অফিসে ফোন করতেই হব…
#ছোট_গল্প
#তোমার_খোলা_হাওয়ায়
#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
হ্যালো... হ্যালো...
টেলিফোনের অপর দিক থেকে কারো কন্ঠই শুনতে পাচ্ছে না নবনীতা। এটা আজ প্রথমবার নয়, কয়েকদিন ধরেই কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না ফোনটাতে। আজ মেন্টেন্যান্স অফিসে ফোন করতেই হবে তাকে।
রিসিভারটা নামিয়েই মোবাইল থেকে সোজা মেন্টেন্যান্স অফিসে ফোন লাগায় সে -- হ্যালো, মেন্টেন্যান্স অফিস? আমি C/13 থেকে নবনীতা ম্যাডাম বলছি। বেশ কয়েক দিন হলো আমার টেলিফোনটায় কিছু একটা প্রব্লেম হচ্ছে, কেউ কল করলে ঐ সাইডের কোনো সাউন্ডই কানে আসছে না।
অপরদিক থেকে জবাব এলো -- ম্যাডাম, রিপোর্টটা নিয়ে নিলাম। তবে অনেক জব একসাথে রিপোর্ট হয়েছে, কম ম্যানপাওয়ারে কাজ হচ্ছে, বুঝতেই পারছেন। তাই আপনারটা আজ হবে না। ওটা অ্যাট লিস্ট দু'দিন পর অ্যাটেন্ড করতে পারবো আমরা।
নবনীতা বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিলো -- ধুৎ! কোনোদিন যদি ঠিকঠাক সার্ভিস পাই।
নবনীতার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি এখনো। বাড়ি থেকে এ ব্যাপারে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেছিলো। কিন্তু নিজের একগুঁয়েমির জন্য, কেরিয়ার কেরিয়ার করে জীবনে একটাও প্রেমতো হলোই না, উল্টে কখন যে বিয়ের বয়সটা পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারেনি নবনীতা। আর এখন বিয়ের কথা ভাবতেও চায় না সে। ভাবে -- একাইতো বেশ ভালো আছি। কোনো ঝুটঝামেলা নেই, নিজের মর্জিমতো জীবনযাপন, খারাপ কি! বর্তমানে একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সে।
আজ রবিবার। ছুটির দিন সকাল সকাল মুডটা খারাপ হয়ে গেল। কতো ইম্পর্টেন্ট ফোন আসে ঐ ফোনে। এক কাপ চা করি যাই -- ভাবতে ভাবতে, চুলগুলো গুটিয়ে একটা ক্লিপ দিয়ে টিকিতে এঁটে নিয়ে কিচেনে চলে যায় সে।
দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ -- ডিং-ডং!
-- এতো সকাল সকাল আবার কে এলো? নিশ্চয় মেন্টেন্যান্সের ঐ ছেলেটা। মাথার কোনো ঠিক নেই ওদের। এইমাত্র বলল হবে না, আবার এখনি দরজায় এসে হাজির। বকতে বকতে দরজা খুললো নবনীতা।
একটা কালো বারমুডা আর ঘিয়ে কালারের টি শার্ট পরে হাসিমুখে ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে অভিষেক। ইয়ং ছেলে, ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। মাস খানেক হলো একটা চাকরিতে জয়েন করেছে ও। তখন থেকেই সে পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়ায়। অবসর সময়ে খুব ভালো গিটার বাজায়। মাঝে মাঝে নবনীতার কানে এসে পৌঁছায় সেই মধুর আওয়াজ। সে মন দিয়ে শোনে। ওকে এভাবে হঠাৎ সামনে দেখে অবাক হয়ে যায় নবনীতা। ওর হাতের ট্রে-র উপর দু'কাপ গরমাগরম চা। ধোঁয়া উঠছে এখনো।
-- আমি কি ভেতরে আসবো? না, বোকার মতো চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়েই থাকবো? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো অভিষেক।
-- অবশ্যই! অবশ্যই! এসো -- কিন্তু তোমার হাতে ওটা কি? কিছু মনে করো না, তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট বলে, তুমি বলে ফেললাম।
-- আরে না, না। ওসব আমি কিছু মনেই করিনি। আমার ঘরে ব্রেকফাস্টের কিছু নেই, তাই আপনার আর আমার দু'জনের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে চলে এলাম। আপনার ব্রেড, বিস্কুট কিছু থাকলে বের করুন, আজ একসাথে ব্রেকফাস্টটা সারি। অভিষেক ভেতরে ঢুকে টি টেবিলের ওপর চায়ের ট্রে-টা নামিয়ে রাখলো।
-- তুমি নিশ্চয় জানো, আমিও তোমার মতোই একা মানুষ। তাই যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অল্পই হবে কিন্তু। হাসতে হাসতে বললো নবনীতা।
-- আরে! যা আছে, সেটাই তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন তো -- চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা! আচ্ছা! তুমি বসো, আমি এক্ষুণি আসছি --নবনীতা কিচেনে চলে যায়।
অভিষেক গলা উঁচিয়ে বলতে থাকে -- আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আবার কেমন ছেলেরে বাবা। আলাপ নেই পরিচয় নেই, একেবারে সকাল সকাল চা নিয়ে ঘরে চলে এলো! আসলে আমি এরকমই। আপনার ফ্ল্যাট থেকে মাঝে মাঝেই খালি গলায় রবীন্দ্রসংগীতের সুর শুনতে পাই, এবং খুব ভালো লাগে আমার। সেটাই আজ চা খেতে খেতে শিল্পীর মুখ থেকে সোজাসুজি শুনতে চাই।
নবনীতা ব্রেড টোস্ট বানিয়ে নিয়ে একটা গোলাপী রঙের হাউস কোট গায়ে জড়িয়ে হাজির -- আরে! শিল্পী-টিল্পী কিছু নয়, ঐ গাই আর কি। ছোটো বেলায় বাবা মা বিয়ে দেওয়ার জন্য শিখিয়েছিলো। এখন দেখছি ওটাই একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তুমি সত্যিই একজন শিল্পী। কি অসাধারণ গিটার বাজাও তুমি। হাসতে হাসতে বলল নবনীতা।
-- আপনার টেলিফোনটায় কি হয়েছে বলুন তো? প্রশ্ন করলো অভিষেক।
-- আর বোলো না -- কয়েকদিন হলো ফোন আসছে, ধরছি, কিন্তু ওদিকের কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু তুমি জিজ্ঞেস করছো কেনো? তুমি কি করে...
নবনীতার কথা শেষ হতে না হতেই অভিষেকের জবাব -- আমি কিন্তু ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকমতো পারিশ্রমিক পেলে আমিই ওটা সারিয়ে দিতে পারি।
নবনীতা হেসে বলে -- বাঃ! এতো অতি উত্তম প্রস্তাব। তা তোমার ঠিকমতো পারিশ্রমিকটা কতো?
-- আপনি আপনার সুমধুর কন্ঠে ঐ "তোমার খোলা হাওয়ায়" গানটা শোনাবেন, তাহলেই হবে।
-- ঠিক আছে, আমি তাই শুনিয়ে দেবো। আগে ওটা ঠিক করে দাও।
-- না, শুনিয়ে দেবো নয়। এক্ষুণি চা খেতে খেতে শুনবো। আর আমি চায়ের পর ওটাকে সারিয়ে দেব।
-- এরকমভাবে কোনো দিন কাউকে গান শোনাইনি জানো! কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে হবে না আমার দ্বারা।
-- আচ্ছা! আমি চোখ বন্ধ রাখছি। আপনি শুরু করুন। তার আগে, একটা কাজ করতে হবে আপনাকে। ঐ টিকি থেকে চুলটা খুলে দিতে হবে, খোলা চুলে আপনাকে খুব সুন্দর দেখায় কিন্তু।
-- এ বাবা! এ ছেলের দাবীর শেষ নেই দেখছি। নবনীতা হাসতে হাসতে চুল খুলে দেয় -- এবার চোখ বন্ধ করো। আমি গান শুরু করবো।
কয়েক চুমুক চা খেয়ে অভিষেক দাঁড়িয়ে পড়ে -- দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমার গিটারটা নিয়ে এলে মনে হয় আরো জমবে ব্যাপারটা। আমি এক্ষুণি আসছি। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।
নবনীতা স্বভাবতঃ গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা। কিন্তু আজ এই ছেলেটি কি যাদুতে তাকে এতোটা নরম করে দিয়েছে, সেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার নিজের ব্যবহারে সে নিজেই অবাক।
গীটারের তারে তরঙ্গ তুলে মাথা দোলাতে দোলাতে অভিষেক ঘরে ঢোকে। নবনীতা অপেক্ষাই করছিলো। গানে গীটারে গল্পে দু'জনে জমিয়ে আড্ডা দিলো তারা।
ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব বাড়লো দু'জনের। একসাথে খাওয়া, একসাথে গান করা, গল্প করা, উইক এন্ডে একসাথে ঘুরতে যাওয়া চলতে থাকলো। দু'টো ফ্ল্যাটের দর