অভাবনবনীতা সই 21.8.20
সকাল থেইক্যে রাত অবধি খেঁইট্যে অভাব যায়নি গো৷ পাঁচ ছডা প্যাট৷ চারডি বাড়ি কাম করি৷ আর ভাতারের সামান্যি আয়৷ বুড়ি শাশুড়ি আর তিনটে বাচ্চা নিয়া ছডা মানষের মুখ ৷ নুন আনতি পান্তা ফুরোয় যায়৷ কুন ছুড্ডো থাকতি গাঁয়ে…
অভাব
নবনীতা সই
21.8.20
সকাল থেইক্যে রাত অবধি খেঁইট্যে অভাব যায়নি গো৷ পাঁচ ছডা প্যাট৷ চারডি বাড়ি কাম করি৷ আর ভাতারের সামান্যি আয়৷ বুড়ি শাশুড়ি আর তিনটে বাচ্চা নিয়া ছডা মানষের মুখ ৷ নুন আনতি পান্তা ফুরোয় যায়৷
কুন ছুড্ডো থাকতি গাঁয়ের থেইক্যে বরের হাত ধইরে আসছিলাম এই দমদুমের বস্তিতে৷ তখুন শহুরের রাস্তা আর গাড়িঘোড়া দেইখ্যে তাক লেগে গিছিলো৷ গাঁয়ে ভাগচাষী বাপের ঘরে দিইনরাত কাম কইরাও দুবেলা প্যাট ভরে খাইতি পাইনি৷ বাপ দিয়া দিলা বিয়া৷
পুনারো বছুর বয়সে কত স্বপ্ন নিয়া আইছিলাম গো৷ তয় কেইটে গ্যাছে কতডি বছুর ৷ বুড়া শউড় তো আমাগো গাঁয়ের মানষ ,হেই তো পছন্দ কইরা আনছিলেন ৷
ডাগর ডোগর মেয়ে, কাজকাম ভালা পারে, পোলার সাথি খাঁটতি পারবে, আবার পোলার মুনেও ধরবে৷
তয় তো হেই সমুয়ে সাত পাক ঘুরোয়ে নিয়া আইলেন৷ গরিব বাপ আমার , তিনডা মাইয়া দুডো পোলা৷ বিয়া দিয়া গলার ত্যান নাবালো৷ মায়ে তো নবার বাপের বয়স দেইখ্যা কাঁদছিলো ৷ তয় গরিবের ঘরে বিনা ট্যাকায় বিয়া অর লটারি এক৷
শহুরে আইয়া ছোড্ডো ঘরে দমে খিল লাগতো, তয় দুই বেলা প্যাট ভইরা খাতি পাতাম ৷ তহন শউড় কাম করতেন ৷ শাউড়ি কাম করতো ৷ ননদ দুয়োডা বিয়া হইয়া গেছিলা ৷ ব্যাটা কামে যাতো ৷ অভাব তেমন ছিলা না৷ তয় মুনডা বড় কানতো হেই ঘাট বাঁধানে পুহুর, গাঁয়ের আম বাগানির মিডা আম৷ পরাণ ডা পুড়তো ছোড্ডো ভাইডার জন্যি৷ আহারে মায়ে তো মাডে যায়, মেজ বোনটা পারহেন রাখতি? খুব মুনডা ক্যামন করতো৷ কতুদিন বিলি গিয়া কাঁকড়া আর গুগলি তুলসি, বিলির কাঁকড়ার কি সোয়াদ কি সোয়াদ৷
গাঁয়ের মাড, ঘাড , চন্ডির মুন্ডব , বড় পরাণ পোড়ছে গো৷ বাপের লগে যাইতাম মনসাতলির হাটে৷ ভাইডা বাপের কান্ধে কইরা যাইতো৷ ব্যাশ ছালাম তয় ঐ যে ভাতির অভাব৷
আস্তি আস্তি শহুরের জল প্যাটে পড়লো ৷ বুলি শিখলাম কুতো৷ শউড় যেন মরলো তহন দুটো পোলা জন্মায়সে৷
রোজগার কুমলো পেট বাড়লো৷ মেইয়ে হবার পর আমি জোর কইরা পেট কাডাইলাম ৷ হেই পেথমবার বাপেরবাড়ি গিছিলাম বিয়ার পর ৷ সে কি ইখানে গো মাঠান? হেই নদীয়া জিলায় ৷ মেজ বুনটার বিয়া ছিলো , বাপ পেথম আমারে নিতে আইছিলো৷ পেট কাটাইয়া আমিও হুস্ত হিলাম না৷ পোলা মাইয়া নিয়া গিছিলাম ৷ ছুডো ভাইডা আর গা ঘিঁসে না , চিনতে পারেনাই হুইতো৷ বড় ভাইডা কত ডাগর হইয়া গিছিলো৷ বাপের তনে মাডে খাঁটে৷ আর মায়ের য্যান কত বয়য় হইসে৷ হেই পেথম , হেই শ্যাষ৷
তারপুর তো শাউড়ি রে রোগে ধরলো, আমি ধরলাম , হেই র কাজ গুলান৷ পোলাপান গুলা নিয়া শাউড়ি ঘরে থাকে৷
গাঁয়ে দ্যাখসি ভাতের অভাব৷ শহুরে দ্যাখলাম মানষের অভাব৷ কতক য্যান দেহনের বাকি আছে গো৷ অহন আই মাঠান৷ কাইল ফ্যার আসবান৷
বসোনা একটু গোলাপী৷ তোমার মুখে তোমার গ্রাম , তোমার ছেলেমেয়ের কথা শুনতে খুব ভালো লাগে৷ সারাদিন তো একা থাকি৷
বুঝি মাঠান৷ এত্তবড় ঘরডায় পুরা একলা মানষ৷ তয় কাইল আইবো৷ পোলাপান গুলার জন্যি চাড্ডি রানতি তো হবো৷
হ্যাঁ সেই ৷ গিয়ে রান্না করবে , তোমার ছেলে মেয়ে গুলো দরজায় দাড়িয়ে আছে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি ৷
কি কন মাঠান? দাঁড়ায় থাকবো ক্যান? পড়ে দুইডা পোলা ৷ মাইয়াডা ও ইস্কুল যাইতাসে ৷ পড়ুগ৷ অহন ঘরে যেই যাম সবকডা মা মা কইরা চিল্লাপাল্লা করবো৷ সবকডার খাবারের লুভ ৷ হেইয়ার পর রান্ধুম৷ ভাতার আইবো , মাইয়াডা অর হের ঠাম্মায় পেথম খাইয়া হুয়া পড়ে৷ নবার বাপ , পোলারা পরে খাইতে বহে৷
আচ্ছা কাল আবার এসো৷ বুলি ও বুলি
কি বলো?
শোন কি রান্না করেছিস?
চিকেন কষা, রুটি, পনির৷ কেন আর কিছু করবো?
কতদিন বলেছি রাতে মাংস করবি না৷ ভালো লাগেনা৷ কাল যে মাংস করেছিলি সেটা কি হলো?
কি হবে ? রয়েছে৷
কতটুকু?
দুজনের হবে৷
আচ্ছা ৷ কালকের মাংসটা গরম করে তুই খেয়ে নে৷ আর আমাকে একটু বেগুন ভেজে দে৷ আর আজ যে চিকেন রান্না করেছিস , তার থেকে একটু রেখে গোলাপী কে দিয়ে দে৷ আর হ্যাঁ কটা বিস্কুট দিয়ে দিস৷
আজকের রান্না দিয়ে দেবো? তুমি খাবেনা?
যা বলছি কর৷
দাবাবু কিন্তু রাগ করবে৷
তোর দাদা বাবুর আমি মা৷ আর ফোন করলে তো জানবে৷
গোলাপী বাটি ভরতি করে মাংস নিয়ে বাড়ি ফেরে৷ মনটা খুব ভালো লাগছে তার৷ বোস গিন্নী খুব ভালো ৷ গোলাপী কে বসিয়ে রাখে কিন্তু রোজ কিছু না কিছু খাবার দেয়৷ বুলি সারাক্ষণ থাকে, রান্না করে৷ আর গোলাপী ঠিকে কাজ করে৷ গোলাপীর বর রাগ করে অত সময় বসে থাকার জন্য৷ কিন্তু কি করবে৷ বোস গিন্নীর ছেলে বিদেশে থাকে৷ পুরো ফ্ল্যাটে একা থাকে বুড়ি৷ রোজ গোলাপী কে বসিয়ে তার গাঁয়ের গল্প , সংসারের গল্প শোনে৷ আসার সময় খাবার দেয় যা কোনদিন গোলাপী কিনে খেতে পারেনা৷
কতকিছু তো গোলাপী দ্যাখে , সকালে গগন রায়ের বাড়ি যায়৷ গগন রায়ের বাড়িতে ছেলের বৌটাকে কাঁদতে দ্যাখে৷ কত বড় বাড়ি , কার্তিকের মতন বর তবুও বৌ টা কাঁদে৷
গোলাপী বোঝেনা অত আরামে থেকেও কিসের অভাব৷
তারপর যায় ঘোষ বাড়ি৷সেখানের বৌদি বড় বদ৷ অত ভালো ঘোষ দাদা অফিসে গেলেই পরপুরুষ আসে৷ গোলাপী বোঝেনা অত ভালো বর থাকতে তার কিসের অভাব৷
তারপর যায় বিশ্বাস বাড়ি , সেখানে বুড়িটা রোজ বৌয়ের নামে নিন্দা করে৷ বৌটা চাকরী করে, বুড়িকে সামলায় তবুও ৷ বোঝেনা বিশ্বাস বুড়ির কিসের অভাব৷
তারপর বাড়ি যায়৷ দুপুরে খেয়ে দেয়ে তারপর আসে এই বোস গিন্নীর কাছে৷ বাসন কোসন মেজে, ঘর মুছে, ঝেড়ে, সবকাজ করে একেবারে সন্ধ্যায় ফেরে৷ একা মানুষ বেশী তো কাজ না৷ আর দুবেলা কাজ কারোর বাড়িতে করেনা৷ আজকাল কাজের লোক পাওয়া মুস্কিল৷ আর গোলাপীর কাজ ভালো৷ সবাই খাতির করে৷ কামাই কম , চুরির হাত নাই ৷
গোলাপী বোঝেনা এদের অভাব৷ গোলাপী শুধু বোঝে পেটের অভাব৷ হয়ত ছোটো থেকে যারা ভাতের জন্য লড়াই করে তাদের বাকি কোনো অভাব সম্পর্কে ভাবার সময় ই হয়না৷ গোলাপী চায় ও না ভাবতে৷ সে শুধু বোঝে সন্তানের ক্ষিদের থেকে বড় অভাব আর কিছু নাই ৷ বড়লোক দের পেট ভরতি ভাত তাই তাদের অন্য অভাব নিয়ে ভাবার সময় আছে৷ গোলাপীদের নাই ৷ তাদের শুধু গরম ভাত চাই ৷ দুবেলা পেট ভরে ভাত৷ মনে মনে ভাবে ভাগ্য ভালো গোলাপী বেশী বোঝেনা৷ খাবার গুলো নিয়ে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে গোলাপী৷
সমাপ্ত