Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

||ভারতবর্ষ||কলমে - দেবাশ্রিতা মজুমদার 
- কি গো ব্যাপার কিছু বুঝলে?- উম্ , হুমম্ ।- এতগুলো বছরে কোনোদিন তো এরকম দেখিনি।- ঠাম্মার কালে হতো। বাবা মা বরাবরই জীবসেবায় বেশি প্রাধান্য দেন, তাই ঠাম্মা চলে যাওয়ার পর  আস্তে আস্তে এসব পুজো প…

 


||ভারতবর্ষ||

কলমে - দেবাশ্রিতা মজুমদার 


- কি গো ব্যাপার কিছু বুঝলে?

- উম্ , হুমম্ ।

- এতগুলো বছরে কোনোদিন তো এরকম দেখিনি।

- ঠাম্মার কালে হতো। বাবা মা বরাবরই জীবসেবায় বেশি প্রাধান্য দেন, তাই ঠাম্মা চলে যাওয়ার পর  আস্তে আস্তে এসব পুজো পাঠ বন্ধ। এবারে হয়তো মা কিছু মনে করেছে । বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তো আরও একা হয়ে গেছে , তাই হয়তো...

- তাই হবে। তবে একটু যেন জোর দিয়েই আসতে বলল আমাদের । সাধারণত বলে না এমনভাবে। 

- কিছু নিশ্চয়ই কারণ আছে, চলো দেখা যাক।

- হুমম্ ।


গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে । আবীরদের বাড়ি । নাম ভারতবর্ষ। মীরা দেবী, মীরা মুখার্জি বর্তমানে এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী । পেশায় শিক্ষক ছিলেন।  মায়া আর আবীর কলকাতায় থাকে, দুজনেই আই টি সেক্টরে কর্মরত। আজ মায়ের জরুরী তলবে এসেছে ভারতবর্ষে।


- মা ! ও মা ! কোথায় গো?

- তোরা এসে গেছিস । আয়।

- হঠাৎ  পুজো? 

- বলব সব। তার আগে কিছু কথা আছে । আমার ঘরে আয় তোরা।


ঘরে ঢুকে – 

- বস। 

- হ্যাঁ বসছি। কি বলবে বলো।

- তোদের বাবা গত হয়েছেন প্রায় এক বছর হল। দুয়েক সপ্তাহ আগে লাইব্রেরি ঘরে তোদের বাবার একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আমি এই চিঠিটা পাই।  এনে পড়।

- কি আছে মা এতে?

- পড় না।


মীরা,

       ডাক্তার এর কথা অনুযায়ী আমি আর বেশিদিন নেই। ইদানিং কিছু কথা প্রায়সই আমাকে বড়ো ব্যথিত করে জানো। আমার বিনিদ্র রাতে ওরা আমায় তাড়া করে। অনেকবার ভেবেছি তোমাকে বলব , কেন জানিনা পারিনি। কিন্তু এগুলো না জানাতে পারলে কোনোদিন শান্তি পাবনা আমি । তাই মুখে বলতে না পারলেও লিখে রাখছি তোমার জন্য । 

         বছর তিরিশ আগে যখন  তুমি প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছো, তখন হাসপাতাল থেকে জানিয়েছিল তোমার অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল । মা বা বাচ্চার মধ্যে যেকোনো একজনকেই বাঁচানো সম্ভব । সন্তানকে সুস্থভাবে বের করতে গেলে তোমার প্রাণনাশের আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল। মীরা , সেদিন আমি পারিনি আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে । তোমাকে হারানো আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে কম কিছু ছিল না । তুমি ছাড়া আমি , না এ হতে পারত না। আমাদের আদর্শ,  আমাদের জীবনদর্শন সবকিছুই যে আমাদের।এই সুদীর্ঘ পথ আমার পক্ষে একা হাঁটা অসম্ভব ছিল না।  কি করব বুঝতে পারছিলাম না । অনেকটা রক্তক্ষরণ হয়েছিল তোমার শরীর থেকে , তোমার জ্ঞান ফেরেনি প্রায় দুদিন। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা । এরই মধ্যে একদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগল সাবিনার। কিছু লম্পট,  দুশ্চরিত্র লোকের কারণে ওর তখন ভরামাস। হাসপাতালে ডেলিভারির পর ও বাচ্চা ফেলে পালিয়ে গেছিল। সেদিন পিতৃপরিচয়হীন মাতৃহারা সদ্যজাতকে আমি তুলে নিয়েছিলাম আমাদের শূন্য কোলে। সরকারী সব আইনকানুন পূর্ণ করেছিলাম হাসপাতালেরই সহযোগিতায়। শুধু তোমাদের বলতে পারিনি মীরা। 

        যেদিন আবীরকে নিয়ে প্রথম বাড়ি ফিরি সেদিন জন্মাষ্টমী। মা গোঁড়া ব্রাহ্মণ । বংশপ্রদীপকে হাতে নিয়ে গোপাল পুজো করছেন এক মনে। সেদিন ঐ ছোট্ট পুঁচকেটাকে দেখে বারবার আমার মনে হচ্ছিল দেবশিশু । তোমার মাতৃত্বের ওম, বাড়ির বাকিদের আদর-চাদরে সবসময় মুড়ে থাকত ও  । আমার ভয় ছিল ও সাবিনার ছেলে জানলে সবাই যদি ওর অনাদর করে ফেলে তাই বলতে পারিনি। তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমার সেদিন সত্যিই কিছু করার ছিল না । দীর্ঘদিনের জীবনযাত্রায় এই অতীত প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু  কিছুদিন আগে কাকতালীয়ভাবেই সাবিনার সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকেই মনটা কেমন হু হু করছে এক চরম অপরাধবোধ গ্রাস করছে আমায় । আমায় তুমি কি চোখে দেখছ জানি না। তবে আবীর সবটা জানুক , এটাই আমার শেষ ইচ্ছা । তবে তুমি চাইলে তবেই। পারলে সাবিনার সাথে যোগাযোগ করো , ও ও বড্ড একা। হাজার হোক  ওর জন্যই তো আমরা আবীরকে পেয়েছিলাম। আর যদি জানাও-ই , সবটা কোরো কোনো এক জন্মাষ্টমীতে। মায়ের গোপালঠাকুর ঐ দিনেই সব জানুক এটাই আমি চাই।

   ইতি,

তোমার অমিত।


ঘরের মধ্যে এক আনমনা নিস্তব্ধতা । তিন জোড়া চোখ থেকে কিছু অবাধ্য,  অবিশ্রান্ত মুক্তোদানা ঝরে পড়ছে। একটা চিঠি,  শেষ চিঠি , এলোমেলো করে দিচ্ছে কিছু হৃদয় ।


- এসব কি মা?

- এগুলোই বাস্তব। আমারও একটু সময় লেগেছিল। তবে আর দেরি করিনি। সাবিনা, ভিতরে এসো। ও তোর জন্মদাত্রী মা আবীর , এখন থেকে উনিও এখানে, এই ভারতবর্ষেই থাকবেন। ওর দায়িত্বও আমি তোদের দিলাম। 

- এটা তোমার বাড়ি মা। তুমি যাকে চাও রাখো। কিন্তু আমি কিছুতেই...

- তোর ঠাম্মা সবসময় চাইতেন তাঁর বংশে যেন গোপালঠাকুর আসেন, তুই তো সত্যিই গোপাল , তোর তো দুটো মা হবেই।

- কিন্তু মা...

- আর কোনো কিন্তু নয়। সাবিনা, চল আজ আমরা দুই মায়ে মিলে ছেলেমেয়ের মঙ্গলকামনায়  পুজো করি।

একটু চমকে উঠে সাবিনা বলে – আমি যে মুসলমান। 

- তাতে কি ! তুমি মা আর সর্বোপরি তুমি মানুষ।  চলো।

নীচে যাওয়ার আগে মীরাদেবী বলেন - 

এই যে মায়াবতী (মায়াকে ভালোবেসে মীরাদেবী এই নামেই ডাকেন)আজ কিন্তু গোপালপুজোর সাথে সাথে যোগমায়ার আরাধনাও হবে। 

তাড়াতাড়ি নীচে আয় দুজনে। আমাদের গ্রামের মন্দির, মসজিদ আর গির্জায় আমি যাদের পড়াই তারা আজ ভারতবর্ষে নিমন্ত্রিত । তাদের পেট ভরে খিচুড়ি,  তালবড়া,  পাটিসাপটা , পায়েস খাইয়ে তবেই আমাদের চারজনের ছুটি।


- মায়ের মনটা কি করে এত বড় মায়া ?

- যাই বলো আমার শাশুমা ইজ্ দ্য বেস্ট । (মুচকি হেসে) উপস্। শাশুড়ি নম্বর ওয়ান। 

- তুমি আবার শুরু করলে।

- আচ্ছা নন্দদুলাল চলো। মায়েদের হাতে হাতে কাজ সারতে হবে তো।


আদতে এটাই সত্যি যিনি কৃষ্ণ, তিনিই কালী। হিন্দু-মুসলিমের তো কোনো শীলমোহর হয়না। আর প্রকৃত ভগবান?  তাঁর কাছে তো সবাই সমান ।  না হলে সাবিনার ছেলে পৈতেধারী ব্রাহ্মণ সন্তান হিসেবে বড়ো হয়?  সন্তানহারার কোল ভরায় অনাহূত সন্তান? একই সাথে গোপাল যোগমায়ার পুজো হয়? একই ভারতবর্ষে ঠাঁই পায় সকলে? সত্য সেলুকাস! বড়ো বিচিত্র এই দেশ। বড়ো বিচিত্র আমাদের মানবজাত। বড়ো বিচিত্র , অনেক প্রসারিত তাদের হৃদয়প্রাঙ্গন । আসলে আমাদের একটাই পরিচয় আমরা ভারতীয়, আমরা মানুষ,  আমাদের ধর্ম মনুষ্যত্ব, গোত্র মানবতা। হাজারহোক “সবার উপরে মানুষ সত্য,  তাহার উপরে নাই”।