Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

গুরুদক্ষিণা প্রদীপ সেন তারিখ- ১৯/০৮/২০
আজ রোববার, টিউশন বন্ধ। এই দুপুর-গড়ানো গরমের দিনে কী করা যায় ভাবছিলাম। কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। মনের মতো হয়ে উঠছে না বুঝতে পেরে খাতা-কলম গুটিয়ে নিলাম। অগত্যা মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক ঘাঁটছিলাম…

 

গুরুদক্ষিণা 

প্রদীপ সেন 

তারিখ- ১৯/০৮/২০


আজ রোববার, টিউশন বন্ধ। এই দুপুর-গড়ানো গরমের দিনে কী করা যায় ভাবছিলাম। কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। মনের মতো হয়ে উঠছে না বুঝতে পেরে খাতা-কলম গুটিয়ে নিলাম। অগত্যা মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক ঘাঁটছিলাম। জীবনসঙ্গিনী বার কয়েক উপদেশবাণী শোনালো -সপ্তাহে এই একটাই তো অবসরের দিন। টেপাটেপি ছেড়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে তো পারো। বললাম - মোবাইল টেপাটেপির নেশাটা ঠিক তোমার জর্দাযোগে পান চিবানোর মতো। এটাও একটা নেশা। বিষয়ের অভিমুখ বুঝতে পেরে আমার উনি চুপ করে গেলেন!  

হঠাৎ দরজায় কে-যেন টোকা দিয়ে ডাকলো- স্যার,  ভেতরে আসবো? 

আমি বললাম- চলে এসো। 

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল আমার এক প্রাক্তন ছাত্র ও তার বাবা। ছাত্রের হাতে একটা বড়ো মিষ্টির প্যাকেট। ওদের বসতে বললাম। ছাত্র আমাকে, আমার স্ত্রীকে আর তার বাবাকে প্রণাম করে সোফায় বসল। ওর বাবা করজোড়ে নমস্কার জানালে আমিও প্রতিনমস্কার জানালাম। 

- স্যার,  আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের চাকরি পেয়ে প্রথম বেতনের টাকায় আপনার জন্য সামান্য মিষ্টি এনেছি। 

ছাত্রছাত্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখলে একজন শিক্ষক যে কতটা তৃপ্তি পায়, জীবনে আমার তা উপভোগ করার সুযোগ এসেছে অনেকবার।বললাম- খুব খুশি হলাম। আমরা, শিক্ষকরা এই দিনের অপেক্ষায় থাকি। 

ওর বাবা বলল - স্যার, আপনি কয়েক বছর ওকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়েছেন বলেই দিনমজুরের ছেলে আজ এই জায়গায় আসতে পেয়েছ। বিনা গুরুদক্ষিণায় ওর এতো উচ্চতায় আসতে পারার পেছনে আপনার অবদান সবচেয়ে বেশি। 

আমি বিব্রত বোধ করি। জীবনে অবর্ণনীয় দারিদ্রের মাঝে কেটেছে আমার ছাত্রজীবন। সব কয়টি পাঠ্যপুস্তক কেনার ক্ষমতা ছিল না। বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর মাধ্যমিক পড়ার সময় প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে কোচিং নেওয়া স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। উচ্চশিক্ষাও চরম দারিদ্রের মধ্যেই কেটেছে। তাই কোনো গরীব ছাত্রছাত্রী অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না দেখলে ওদের মধ্যে আমি আমার দারিদ্র্য-পীড়িত ছাত্রজীবনকে যেন দেখতে পাই। ওদের সাহায্য করতে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করি। আমাকে অবলম্বন করে অনেক ছাত্রছাত্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বললাম- আমি তো অবলম্বন মাত্র। তবে চাইলে সে আমাকে আজও গুরুদক্ষিণা দিতে পারে। 

গৃহিণী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি যে কিছু চাইতে পারি তা ওর কল্পনার অতীত। যাকে নিয়ে তার এতোটা গর্ব সে তার প্রাক্তন ছাত্রের কাছে এতো বছর পর গুরুদক্ষিণা চাইছে! 

বাবা ও ছেলে উৎসাহদীপ্ত। বলে-বলুন স্যার, কী গুরুদক্ষিণা চাইছেন?  আজ আমি দিতে পারবো। সে ক্ষমতা আজ ঈশ্বর ও আপনিই করে দিয়েছেন। তাই আপনাকে আমার অদেয় কিছু নেই আজ। 

হেসে ছাত্রটিকে বললাম- আমি আমার জন্যে কিচ্ছু চাইনা। চাইছি তোমার বাবার জন্যে। তোমার বাবাকে এতোটা সুখ দাও যা তাঁর এতোদিনের দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়। এটাই তোমার কাছে আমার গুরুদক্ষিণা। পারবে আমাকে এই গুরুদক্ষিণা দিতে? 

ওর বাবা কেঁদেই ফেললেন। বললেন, স্যার, এমন গুরুদক্ষিণাও চাইতে পারেন এমন মানুষ আমি জীবনে এই প্রথম দেখলাম। ছাত্র উঠে এসে আবারও আমায় প্রণাম করে বলল - স্যার, আশীর্বাদ করুন যেন অমানুষ না হই। তা-ই হবে! আপনাকে এই গুরুদক্ষিণা আমি দিলাম। 

 মনে হলো আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আজ আমি শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা পেলাম। আড়চোখে দেখলাম আমার সহধর্মিণী আঁচলে চোখ মুছছে। আমি ওই অশ্রুর ভাষা জানি।