Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

#সাড়ে_চুয়াত্তর! #ফিসফাস_ইতিহাস....সুদীপ্তা চক্রবর্ত্তী।১২|০৮|২০২০
এক অজানা ইতিহাসের ইটের পাঁজরের কান্না...
"বিয়ের পরে তখন কতো চিঠি, আবার তার মাথার ওপর লেখা থাকত, 'সাড়ে চুয়াত্তর'! আর এখন কোনমতে একটা পোস্টৌকার্ড, 'কে…

 

#সাড়ে_চুয়াত্তর! #ফিসফাস_ইতিহাস....

সুদীপ্তা চক্রবর্ত্তী।

১২|০৮|২০২০


এক অজানা ইতিহাসের ইটের পাঁজরের কান্না...


"বিয়ের পরে তখন কতো চিঠি, আবার তার মাথার ওপর লেখা থাকত, 'সাড়ে চুয়াত্তর'! আর এখন কোনমতে একটা পোস্টৌকার্ড, 'কেমন আছো, আমরা ভালো আছি,' সবই কপাল!'"


বাংলা সিনেমা 'সাড়ে চুয়াত্তর' এর প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর এই ডায়লগ টা, অনেক ডায়লগের মাঝে হয়তো হারিয়ে গেছে, কিন্তু যারা এই সিনেমাটা দেখেছেন তাদের প্রায় সবার মনে নিশ্চয়ই সেই সময় এই প্রশ্নটা জেগেছিল যে সিনেমার নাম 'সাড়ে চুয়াত্তর' হলো কেন? এই শব্দের সঙ্গে সিনেমার যোগ কোথায়? ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ডায়লগ, 'মাসীমা মালপো খামু' তখন লোকের মুখে মুখে ফিরত। আমি যখন সিনেমাটা প্রথম দেখি স্বভাবতই খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল 'সাড়ে চুয়াত্তর' এর কি কোনো আলাদা অর্থ আছে যেটা ওই সিনেমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু জবাব পাইনি। 


সিনেমাটা থেকে এইটুকুই মাত্র বুঝতে পেরেছিলাম, সাড়ে চুয়াত্তর কথাটা চিঠির মাথায় লেখা হতো। কিন্তু কেন? এতো সংখ্যা থাকতে এই অদ্ভুত সংখ্যাটাকে বেছে নেওয়া হলো কেন চিঠির ওপর লেখার জন্য? নাকি এটা যে যাকে লিখছে তাদের নিজেদের বিশেষ কোন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ! এইটুকু মনে হয়েছিল, একজন মহিলা যখন তার স্বামীকে লিখছেন, তখন ভয়ঙ্কর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা এক্ষেত্রে কম!


এবার আসি সেই কথায়ঃ


শুনলে অবাক হবেন 'সাড়ে চুয়াত্তর' সংখ্যাটির স্রষ্টা ও প্রচারক হলেন, মুঘল সম্রাট আকবর! কিন্তু তার উৎস বড়ো ভয়াবহ! চলুন যাওয়া যাক সেই মুঘল যুগে, দেখা যাক রাজস্থানের ইতিহাস রচয়িতা মহামতি টড কি বলে গেছেন!


মেবারের মহারাণা তখন উদয় সিংহ! মহারাণা সংগ্রাম সিংহ খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের কাছে পরাজিত হওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তার দুই পুত্র বিক্রমাদিত্য এবং উদয় সিংহ। বিক্রমাদিত্য গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলে, সংগ্রাম সিংহের বিধবা রানী কর্ণাবতী হুমায়ুনকে রাখী পাঠান এবং সাহায্য প্রার্থনা করে চিঠি দেন। হুমায়ূন রাখী এবং চিঠি পেয়ে তৎক্ষনাৎ সদলবলে মেবারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু ততক্ষণে রানী কর্ণাবতী আগুনে প্রবেশ করেছেন। হুমায়ূন বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে উদয় সিংহের প্রাণ রক্ষা করেন, এবং তাকে মেবারের সিংহাসনে বসান।


এর খুব অল্পদিনের মধ্যেই হুমায়ূনের মৃত্যু হয়। এরপর আকবরের রাজ্যাভিষেকের কাহিনী আমাদের সকলেরই জানা। আকবর রাজা হয়েই রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর দিকে মন দেন। তিনি মালব আক্রমণ করে সেই রাজ্য অধিকার করলে, মালবরাজ পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। উদয় সিংহ বংশের ঐতিহ্য রক্ষা করতে মালবরাজ কে চিতোরে আশ্রয় দেন, এবং সম্রাট আকবরের বিরাগভাজন হন। কারন অন্য এক রাজপুত রাজার বিপদ তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল।


১৫৬৭ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে আকবর চিতোর আক্রমণ করেন, যদিও উদয় সিংহ পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে তার আগেই রাজধানী চিতোর থেকে উদয়পুরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। চিতোরের বীর সর্দার, শহিদাস, প্রমার, ঝালাপতি সম্রাটকে প্রচণ্ড বাঁধাদান করে বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন! অবশেষে দীর্ঘ চার মাস পর, ১৫৬৮ খৃষ্টাব্দের ২২ শে ফেব্রুয়ারি সম্রাট নিজের হাতে গুলি করে চিতোরের দুই বীর দেশপ্রেমী জয়মল ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র পাট্টা কে হত্যা করে চিতোর দুর্গে প্রবেশ করেন।


তারপর শুরু হয় আকবরের প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা! চিতোরের সমস্ত মন্দির ও প্রাসাদ ধ্বংস করা হয়েছিল। যদিও তার চরিত্রের এই বীভৎসতা তার জীবনকালে খুবই কম প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিক টডের মতে শত্রু কতৃর্ক চিতোর যতবার লুণ্ঠিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে আকবর কতৃর্ক হত্যালীলা ও ধ্বংসই ছিল নৃশংসতম। সারা মেবার থেকে হাজার হাজার দেশপ্রেমী ও বীর যোদ্ধারা এসেছিলেন তাদের মাতৃভূমি রক্ষা করতে, ফলে প্রকৃতপক্ষে কতো লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল তার সঠিক হিসেব কারো কাছেই নেই ।


কিন্তু এই হিসেব বেরিয়ে এসেছিল এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। তখন রাজপুত বীররা প্রত্যেকেই পৈতে ব্যবহার করতেন। চিতোর জয়ের পর সম্রাট আকবরের আদেশে মৃতদেহ থেকে পৈতেগুলো খুলে নেওয়া হয়েছিল, এবং সেগুলো ওজন করা হয়েছিল! পৈতেগুলোর মোট ওজন হয়েছিল সাড়ে চুয়াত্তর মণ! ( টাইপের ভুল নয়) তবে তখন চার সেরে এক মণ ধরা হতো। অতএব কতো রাজপুতকে হত্যা করা হয়েছিল সেই হিসেব থেকে বিরত থাকলাম। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রায় ততজন রাজপুত রমনী, যারা জহরব্রত করে জ্বলন্ত চিতায় প্রাণত্যাগ করেছিলেন।


আকবরের বিশিষ্ট বন্ধু ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতেই নিহত রাজপুতের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। (সরকারী হিসেব)।


এই ইতিহাস আলোচনা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এটা না জানলে যে 'সাড়ে চুয়াত্তর' জানা সম্ভব নয়।


শোনা যায় এই যুদ্ধের ফলাফল আকবরকে সত্যিই মর্মাহত করেছিল! সেই কারনে যুদ্ধের শেষে তিনি চিতোরের দুই বীর যোদ্ধা জয়মল ও পাট্টার মর্মর মূর্তি নির্মাণ করে শ্রদ্ধাসহকারে আগ্রা দুর্গে স্থাপন করেছিলেন।


এরপর তার পাপের এক ভীষণ অন্তরগ্লানি শুরু হয়, তাই তিনি তার পাপের কিছু ভাগ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করেন। তার নির্দেশে তখন রাজকীয় চিঠিপত্রের লেফাফা বা খামের ওপর 'সাড়ে চুয়াত্তর' সংখ্যাটি লিখে দেওয়া শুরু হয়। তখন এই গোপন চিঠির বিষয়বস্তু জেনে সেই খবর বিক্রি করত একদল লোক। চিঠির ওপর 'সাড়ে চুয়াত্তর' লেখা থাকলে ধরা হতো, পত্রের প্রকৃত প্রাপক ভিন্ন অন্য কেউ এই চিঠি খুললে তিনি বা তারা চিতোর হত্যা পাপের ভাগিদার হবেন।


সময়ের পলিতে মানুষ ভুলে গেছে 'সাড়ে চুয়াত্তর' এর ভয়াবহ ঘটনা! তারপর ক্রমশই অজ্ঞানতা গ্রাস করেছে জাতিকে। শুধু রয়ে গেছে অভ্যাস, চিঠির ওপর লেখা 'সাড়ে চুয়াত্তর' আজও মনে করিয়ে দেয়, তুমি এ চিঠির প্রাপক নও, তাই এই চিঠি খোলার অধিকার তোমার নেই !!!!