#বিষয়_বন্ধুত্বের অবমাননা
#গল্প_অভাবনীয়
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
এক পাড়ায় পাশাপাশি বাড়ি আর ছোট থেকে বেড়ে ওঠা মানিনী আর তপস্যা এখন ক্লাস নাইন। ইস্কুলে যাওয়া খেলাধুলো, পড়াশোনা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো সব একসাথে। খালি রাত্তির…
#বিষয়_বন্ধুত্বের অবমাননা
#গল্প_অভাবনীয়
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
এক পাড়ায় পাশাপাশি বাড়ি আর ছোট থেকে বেড়ে ওঠা মানিনী আর তপস্যা এখন ক্লাস নাইন। ইস্কুলে যাওয়া খেলাধুলো, পড়াশোনা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো সব একসাথে। খালি রাত্তির টুকু যে যার মায়ের কাছে। দুজনেই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, হরিহর আত্মাও বলে পাড়া প্রতিবেশী থেকে ইস্কুলের বন্ধুরা। সব বিষয়ে দুই বন্ধু, বন্ধুত্ব বজায় রেখে প্রতিদ্বন্দ্বীও। টক্কর চলে দুজনের মধ্যে কিন্তু বন্ধুত্ব অটুট।
ইস্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস। দুজনেই নাম দিয়েছে প্রায় সব ইভেন্টে। এর মধ্যে সাইকেল রেসও আছে।
ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওরা দুজন নিজেদের মধ্যেই রেস প্র্যাক্টিস করছে রোজ কারণ অ্যানুয়াল স্পোর্টসের আর মাত্র তিনদিন বাকি।
সেদিনও যথারীতি দুজনে জোরে সাইকেল চালিয়ে ফিরছে বাড়ি। রাস্তায় হঠাৎ একটা কুকুর ওদের সামনে চলে আসে। তপস্যা কোনও রকমে পাশ কাটালেও মানিনী সাইকেল নিয়ে কুকুরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে রাস্তায়। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। ডানহাত ফুলে ঢোল। ঐ অবস্থায় তপস্যা ওকে তুলে বাড়ি পৌঁছে দেয়। মানিনী কে ওর বাবা মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। হাতের এক্সরে করে জানা যায় কব্জির হাড় ভেঙেছে বাজে ভাবে। প্লাস্টার করে তিন সপ্তাহ থাকতে হবে। ডানহাতে এখন কিছুই করা যাবে না।
এ দুঃসংবাদে প্রচন্ড ভেঙে পড়ে মানিনী।তপস্যারও মন খারাপ।সাইকেল রেসে ওরাই প্রথম আর দ্বিতীয় হয় বরাবর। এবার মনে মনে ভেবেছিল মানিনী কে হারিয়ে প্রথম সেই হবে। কিন্তু মানিনীই যে এবার থাকছে না। কিন্তু কিছুই করার নেই তার।
রাতে ঘুম আসছে না তপস্যার। শুয়ে শুয়ে ভাবছে কেবল, কিছুই কি তার করার নেই? প্রিয় বন্ধুর জন্য?
অনেক ভেবে সে ঠিক করলো, সাইকেল রেস সে তার বন্ধুর সাইকেল নিয়ে করবে। যেই ভাবা সেই মা বাবা কে ডেকে সে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। মা বাবাও সম্মত হয় মেয়ের এই সুন্দর সিদ্ধান্তে। গর্ব বোধ করে মনে মনে যে তাদের মেয়ে এত সুন্দর একটা মনের মানুষ। যে বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার জন্য নিজের প্রিয় সাইকেল না নিয়ে বন্ধুর সাইকেলে রেসে নামবে।
পরদিন সকালে মানিনীর বাড়ি গিয়ে তপস্যা তার সিদ্ধান্ত জানায়। কিছুক্ষণ ভেবে মানিনী তাকে বলে সাইকেল রেসের দিন সকালে অর্থাৎ একদিন পরে যেন সে এসে সাইকেল নিয়ে যায়।
খুব খুশি মনে তপস্যা বাড়ি ফিরে মা বাবা কে জানায় তার বন্ধু তার এই সিদ্ধান্তে খুশি মনে রাজি হয়েছে। সবাই খুব খুশি হন। ব্যস, আর একদিন..... তারপরই এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
মানিনীর সাইকেল নিয়ে মাঠে তপস্যা। মনে খুশির জোয়ার। আজ সে সবাই কে পেছনে ফেলে প্রথম হবে, দ্বিতীয় নয়। মানিনীর সাইকেলে মানিনীর জায়গায়। আর জিতেই এই জয় উৎসর্গ করবে প্রিয় বন্ধু কে।
সাইকেল নিয়ে এগিয়ে চলেছে তপস্যা। প্রথম রাউন্ড.... দ্বিতীয় রাউন্ড... তৃতীয় রাউন্ড.... তপস্যা প্রথমে.... সবার আগে...
সারা ইস্কুল চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে... আরও স্পীড বাড়াতে প্যাডেলে পায়ের চাপ দিচ্ছে তপস্যা। ফাইনাল রাউন্ড.... জয় ছুঁয়ে তপস্যা সীমানা ছাড়িয়ে... দু হাত আকাশে তুলে চিৎকার করে বলে, 'মানিনী, এ জয় তোর বন্ধু.... আমার ভালোবাসার উপহার'
কিকিকিন্তু এএএএকি.... সাইকেল যে থামছে না... একই স্পীডে মাঠ ছাড়িয়ে... খানা খন্দ পেরিয়ে...ব্রেক ধরতে পারছে না কিছুতেই। আছড়ে পড়ে তপস্যা একটা বড় বোল্ডারের উপর.... তারপর সব অন্ধকার...
সারা ইস্কুল, মাস্টার, ছাত্রীরা এবং তাদের বাবা মায়েরা, সবাই ছুটে আসেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তপস্যার মুখ মাথা। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ইমারজেন্সিতেই অজ্ঞান হয়ে যায় সে। ধীরে ধীরে কোমায় চলে যায় তপস্যা।
মা বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে। সব বন্ধুরাও।
কেউ ভেবে পায় না এমন কি করে হোলো?
মানিনী.... যে মেয়ে রেসে প্রথম আসে তার সাইকেলে ব্রেক কেন ধরলো না?
পুলিশ কেস হয় হসপিটাল থেকে। তপস্যার মা বাবা বা ইস্কুলের কেউ চায় নি। কিন্তু নিয়মমতো ডাক্তার বাবু জানাতে বাধ্য হন।
তদন্তের রেজাল্ট সবাই হতবাক।
পুলিশের জেরায় মানিনী স্বীকার করে যে, সে নিজে সাইকেল রেসে নামতে পারবে না এবং তার বন্ধু যে দ্বিতীয় হয়, সে এবার তার সাইকেল নিয়ে প্রথম হবে.... এটা মানতে পারে নি সে। তাই ঈর্ষায়, হিংসায়, তাদের কাজের লোক বেচুদাকে বলে চুপিচুপি ব্রেক সু খুলে রাখে। কেউ জানতে পারেনি। আর পরদিন সেই সাইকেল নিয়েই তপস্যা মাঠে নেমেছিল ভীষণ খুশি মনে।
খসে পড়ছে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার নোংরা মুখোশ... ভরসাও চোখ বুজে কোমায়... তপস্যার মতোই...
বাকরুদ্ধ সারা পাড়া.... ইস্কুল...