#সেই_চোখ#সোমা_ত্রিবেদী
ভোরবেলা ধড়ফড় করে উঠে বসে হাঁপাতে লাগল ছোট্ট মৌরী। ও ঘামছে, রাতে পরে থাকা জামাটা ঘামে ভিজে গেছে একদম। ওর মা তাড়াতাড়ি উঠে ওর বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আতঙ্কিত চোখ দুটো ধিরে ধিরে স্বাভাবিক হলো।
এটাই প্রথম…
#সেই_চোখ
#সোমা_ত্রিবেদী
ভোরবেলা ধড়ফড় করে উঠে বসে হাঁপাতে লাগল ছোট্ট মৌরী। ও ঘামছে, রাতে পরে থাকা জামাটা ঘামে ভিজে গেছে একদম। ওর মা তাড়াতাড়ি উঠে ওর বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আতঙ্কিত চোখ দুটো ধিরে ধিরে স্বাভাবিক হলো।
এটাই প্রথমবার নয়। এমন স্বপ্ন মেয়েটা আদো আদো কথা বলতে শিখেছে সেই তখন থেকে দেখছে। এই আতঙ্ক তাকে যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর আশ্চর্য ভাবে ভোর বেলাই দেখে। আগে শিশু মনের অজানা ভয় ভেবে উড়িয়ে দিতো মৌরীর মা বাবা নিপা ও রণো। মাসে একবার দুবার তো এই স্বপ্নটা মৌরী দেখেই, তবে কখনই পুরোটা দেখেনা। আতঙ্কে ওর ঘুম ভেঙে যায়।
মৌরী তলিয়ে যাচ্ছে, সাংঘাতিক স্রোতে, হাঁকপাক করছে প্রাণটা বাঁচানোর জন্য, কিন্তু কিছুতেই ওই খর স্রোত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেনা। আর সেই সঙ্গে দুটো অসহায় চোখ কাতর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সেও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওর হাতটা ধরার কিন্তু পারছেনা। এই একটাই স্বপ্ন, বলা ভালো দুঃস্বপ্ন, আসে ঘুরে ফিরে। অথচ শেষে নিজে বাঁচল কিনা তা বোঝা যায় না। এই আধখেচড়া স্বপ্নই সে দেখে। মৌরী যখন বাচ্চা মেয়ে তখনও স্বপ্নের মৌরী পরিণত যুবতি। তাও সে নিজেকে চিনতে পারে।
নিপা ও রণো মনোবিদের সাহায্য নিয়েছে লাভ বিশেষ হয়নি। ডাক্তার পালটেও সুবিধা হয়নি। নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিচিত জনের কথায় হাত দেখাতে গিয়েছে। তাতে ছোট্ট মৌরীর আঙুলে পাথরের সংখ্যা বাড়লেও সুরাহা কিছুই হয়নি। নিপা দিনরাত মেয়েকে চোখে চোখে রাখত। পারতপক্ষে জলের কাছে ঘেঁষতে দিতনা। কখনও সমুদ্রে বেড়াতে নিয়ে যায়নি। সাঁতার শিখতে দেয়নি। যদি সাঁতার শিখতে গিয়ে কিছু বিপদ হয়, সেই আশঙ্কায়।
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট মৌরী বড়ো হয় তবুও সেই দুঃস্বপ্ন তার পিছু ছাড়েনা। মৌরী যেন স্বপ্নটার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে। আর অতোটাও আতঙ্ক লাগেনা। এ যেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা যার রেশ তার মনে থেকে গেছে।
স্কুল কলেজ চাকরি বিয়ে সবকিছুই জীবনে পরপর ঘটে গেলেও মৌরীর আজও সমুদ্র দর্শন তো অনেক দুর নদীতে নৌকা চড়া পযর্ন্ত হয়নি কোনদিন। মৌরী যতই বড় হয়ে যাক ওর বেড়াতে যাবার নাম শুনলেই নিপা আজও বিষদে জানতে চায় সে কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে কে কে যাবে, প্রতিদিনের প্ল্যান কি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবারে ঠিক হলো বড়োদিনের ছুটিতে মৌরী ওর স্বামী ঋত্বিক ও ওদের বেশকিছু বন্ধুরা মিলে দিল্লি, হৃষিকেশ, লক্ষ্মণ ঝুলা যাবে। নিপা বারংবার সাবধান করেছে মেয়েকে খবরদার জলের কাছে যাবিনা। ছবি তুলতেও জলের কাছে যাসনা। মেয়ে হ্যা হ্যা বলে, দুগ্গা দুগ্গা করে বেরিয়ে পড়েছে।
মহানন্দে দিল্লি দুদিন ঘুরে এগিয়েছে হৃষিকেশের পথে। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আজন্ম দেখে আসা দুঃস্বপ্ন ও মাকে দিয়ে আসা কথা বেমালুম ভুলে যায় মৌরী। ঠিক হয় চারজন চারজন করে দুটোদলে ভাগ হয়ে রিভার রাফটিং করবে তারা। ওদের দলে ছোট বাচ্চা বা বয়স্কও কেউ নেই। মৌরী ছাড়া দলের বাকি সাত জনই সাঁতার জানে সবাই ওকে সাহস দিলে ওও সোৎসাহে মেতে উঠল।
সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে যে যার ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল কাউন্টারের সামনে টাকা জমা করে। হঠাৎই কোথা থেকে এই ঠাণ্ডায় এক কৌপিন সার সাধু এসে মৌরীর সামনে হাজির হলো। চেয়ে রইল ওর চোখের দিকে, সে এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। মৌরীও পারলনা চোখ সরাতে সেই চোখ থেকে। বড়ো চেনা সে চোখ। কোথায় যেন সে দেখেছে এমন চোখ। এবার সেই সাধু গমগমে গলায় আদেশের সুরে বলে উঠলেন, 'যাবিনা তুই।' 'সেদিনও বারণ করেছিলাম শুনিসনি আজও বারণ করছি, তুই যাবিনা।' কেঁপে উঠল মৌরীর অন্তরাত্মা। অথচ কে এই সাধু মনে করতে পারলোনা কিছুতেই। তার মনে প্রবল ইচ্ছা রিভার রাফটিংএ যাওয়ার। ততক্ষণে সাধুবাবা অনেক দুর চলে গেছেন। কাউন্টারের কেউ এর আগে এই সাধুকে কখনও দেখেনি। ওরা বলল, এখানে কতো সাধু সন্যাসী সারা বছর আসেন দু চারদিন থাকেন আবার কে কোথায় চলে যান। কেউ কেউ বছর বছর আসেন, তাদের দু একজন মুখচেনা হয়ে যান। ইনি তেমন নন, এই প্রথম দেখলাম এনাকে।
মনে দোলাচল সৃষ্টি হলেও মৌরী ও তার সঙ্গী সাথীরা দুটো বোটে সওয়ার হলো সঙ্গে দুই বোটে একজন করে দুজন এক্সপার্ট। অসাধারণ, অসাধারণ অনুভূতি। মৌরী ঋত্বিকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে বসে আছে, দুপাস থেকে খরস্রোতা নদীর জলের ঝাপটার দাপটে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে। আজ না এলে এই সবকিছু থেকে ও বঞ্চিত হতো। জীবনে কিছু কুসংস্কার ত্যাগ করে মনে সাহস রেখে এগোলে সত্যিই অনেক কিছু পাওয়া যায়। হঠাৎই মৌরীর এক অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়লো, যে সাধুবাবা তাকে একটু আগে সাবধান করে গেলেন সেই সাধুই যেন তার বোটের পাশে তীর বেগে সাঁতার কাটছেন। মৌরী ঋত্বিককে দেখানোর চেষ্টা করলো ও কিছুই দেখতে পেলোনা। মৌরীর কেমন একটা অস্বস্তি করতে লাগল। ঋত্বিক বুঝতে পেরে মৌরীর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলে উঠল, এমন প্রকৃতিক সৌন্দর্য জীবনে আর দ্বিতীয়বার পাবেনা মনটা মা গঙ্গায় সমর্পন করো। মৌরী এখনো দেখতে পাচ্ছে সাধুবাবা বোটের পাশে সাঁতার কাটছেন, ও কিছুতেই আর স্বাভাবিক হতে পারলনা।
আরও দশ পনেরো মিনিট হৈহৈ করে বোট এগোনোর পর এক ছোট্ট পাথরে ধাক্কা লেগে মৌরীদের বোট গেল উল্টে। লাইভ জ্যাকেট থাকায় ও এক্সপার্টের তৎপরতায় তিনজনই বোটে কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়লেও মৌরী অসম্ভব স্রোতে এগিয়ে যেতে লাগল। কোন একটা পাথরে লেগে ওর লাইভ জ্যাকেটটাও খুলে গেল। ওর পুরো নিয়ন্ত্রণ তখন স্রোতের। দুই এক্সপার্টই বোট ডাঙায় তুলে জলে ঝাঁপ মারলো। ঋত্বিক পাড়ে তখন উন্মাদপ্রায়। খানিকক্ষণ পরে হঠাৎই সেই সাধুবাবা নেতিয়ে পড়া মৌরীকে কোলে করে উঠে এলেন জল থেকে। ঋত্বিক স্ত্রীকে ফেরত পেয়ে, সাধুবাবাকে নুন্যতম ধন্যবাদ টুকুও দিতে ভুলে গেল ঘটনার আকস্মিকতায়। এক্সপার্টরাও একে একে উঠে এলো মৌরীর প্রাথমিক শুশ্রূষা হলে ও একটু সুস্থ হলো। সাধুবাবা তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন, মৌরী চোখ খুলতে তিনি বলে উঠলেন, 'বারণ করেছিলাম তোকে, আর জন্মে পারিনি তোকে রক্ষা করতে, এবার করে গেলাম এবার আমার মুক্তি, আহঃ মুক্তি, আহঃ মুক্তি....' বলতে বলতে কোথায় চলে গেলেন তিনি বোঝা গেলনা।
গাড়ি করে দিল্লি ফেরার পথে নির্জন গাছের তলায় সেই সাধুবাবাই বসে আছেন দেখে সবাই গাড়ি থেকে নেমে ওনার কাছে ছুটে গেলো। ততক্ষণে ওনার নস্বর শরীর থেকে প্রাণের স্পন্দন হারিয়ে গেছে। কালকের ঘটনার পর থেকে মৌরী একটা কথাও কারো সঙ্গে বলেনি। আজ গাছ তলায় মৃত সাধুবাবাকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল, গুমরে গুমরে বলতে লাগল, 'আমি এনাকে চিনি, বহু জন্ম ধরে চিনি।'
মৌরী বাড়ি ফিরে সব ঘটনা মাকে বলল। মা আতঙ্কিত হলেও তাঁর সন্তান অবশেষে সুরক্ষিত আছে তাতেই স্বস্তি বোধ করেছেন। মৌরী এই ঘটনার পর সেই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন আর দেখেনি। ধিরে ধিরে মন থেকে মুছে গেছে ভোরের দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার স্মৃতি। তার বদলে মৌরীর দুচোখে চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে গেছে সেই চিরচেনা দুটি চোখ।
__________________