প্রাচীর প্রদীপ সেনআগরতলা, ১৭/০৯/২০
হ্যাঁ, দুই ছেলের বাড়ির মধ্যিখানে ছয় ফুট উঁচু পাঁচিলটাকে সুমনা আর সুশোভনের তাই মনে হয়। কত সুখের সংসারই না ছিল দত্ত দম্পতির! দুই ছেলে শুভ আর শুভঙ্কর। দুই ভাইয়ের আদরের ছোটো বোন মিলি। পাঁ…
প্রাচীর
প্রদীপ সেন
আগরতলা, ১৭/০৯/২০
হ্যাঁ, দুই ছেলের বাড়ির মধ্যিখানে ছয় ফুট উঁচু পাঁচিলটাকে সুমনা আর সুশোভনের তাই মনে হয়। কত সুখের সংসারই না ছিল দত্ত দম্পতির! দুই ছেলে শুভ আর শুভঙ্কর। দুই ভাইয়ের আদরের ছোটো বোন মিলি। পাঁচ সদস্যের সংসার। সুশোভনের ফলের দোকান ছিল। বেশ মুনাফা হতো। শহরতলির এই ছয় গন্ডা জমির ওপর হাফ-ওয়াল টিনের ঘর, বাউন্ডারি ওয়াল, যা-কিছু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সুমনা আর সুশোভনের কৃচ্ছ্রসাধনের ফল। দুই ছেলেকে গ্র্যাজুয়েট করানো, মেয়ে মিলিকে পড়াশোনা করিয়ে আর্মি পাত্রের সাথে বিয়ে দেওয়া - কর্তব্যের এতোটুকুও খামতি রাখেনি দত্ত দম্পতি।
কিন্তু ওয়েল-ক্যালকুলেটেড জীবনও অনেক সময় নদীর মতো অহেতুক বাঁক নেয়। সময়ের দাবি মেনে এই গতিপরিবর্তন মেনে নিতেই হয়। দুই ছেলে সরকারি চাকরি পেলো। নিজেদের পছন্দের কলিগদের বিয়ে করলো। দত্ত দম্পতি ভাবলো দুই ছেলে আর দুই ছেলে-বৌ সরকারি চাকুরে। দত্ত পরিবার সত্যিই খুব ভাগ্য নিয়ে এসেছে। সংসারে বর্ষাধারার মতো অর্থ এসে ঢুকবে। তা হয়তো ঢুকছে। তবে অর্থ ঢুকলেও লক্ষ্মী এসেছে ঘরে এমনটা বলা যায় না।
সুশোভন বুড়ো হয়েছে। তিন তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দোকানদারি করার ধকল শরীর নিতে পারছে না। দোকানটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে ছেলে ও ছেলে-বৌরা অবিবেচক নয়। দুই দিন ওরা চারজন বিস্তর শলাপরামর্শ করে সমাধান বের করে। মা সুমনা ছোটো ছেলে অন্তপ্রাণ। তাই মায়ের বাকি জীবনের দায়িত্ব সে নিল। বাবার দায়িত্ব বর্তায় বড়োছেলের কাঁধে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে দুই ভাগ হলো। দুই বাড়ির মাঝখানে ছয় ফুটের পাঁচিল উঠল।
দুই ছেলে মা বাবাকে হয়তো অ-সুখী রাখেনি। কিন্তু সুমনা আর সুশোভনের ঘনিষ্ঠ প্রেমের মধ্যিখানে প্রাচীর ওঠে গেল। দুই উঠোনের মধ্যিখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছয় ফুট উঁচু পাঁচিলটা। মধ্যিখানে চারফুট বাই ছয় ফুটের গ্রিলের গেট আছে। তার দুদিকে ঝুলছে দু-দু'টি তালা। সুমনা আর সুশোভন একে অপরের কাছ থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। তবু যেন মনে হয় ওরা একে অপরের থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছে।
দুপুরে দুই বাড়িতে থাকে শুধু দুই বুড়োবুড়ি। একজন পাঁচিলের এপাশে, অন্য জন ওপাশে। ছেলে আর ছেলে-বৌরা অফিস যাবার আগে দুই গেটের বাইরে দুটি তালা ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। যুক্তি হলো ওদের ও বাড়ির নিরাপত্তা। দুপুরে পাঁচিলের মাঝখানে যে গ্রিলের গেটটা আছে তার দুদিকে দুজন এসে দাঁড়ায়। মনের কথা খুলে বলে দুজনে। চলে কুশল জিজ্ঞাসা।
সেদিন ছোট ছেলের ঘরে ইলিশ এসেছে। ওরা অফিস চলে গেলে সুমনা বাটিতে করে এক টুকরো সরষে-ইলিশ নিয়ে গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকে, শুনছো, একটি বার এদিকটায় এসো।
সুশোভন তড়িঘড়ি এসে গ্রিলের এপাশটায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হলো?
তোমার দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে?
না, এই খেতে যাচ্ছিলাম। তুমি ডাকলে।
সুমনা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাটিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ধরো। সরষে-ইলিশ দিয়ে খেয়ে নাও। আমার পেটটা ভালো না। আমার ভাগেরটাই তোমাকে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমি একটু পরে এসে বাটিটা নিয়ে যাবো।
সুশোভনের দু'চোখের কোণ ভিজে উঠলো। সুমনা মিথ্যে বলেছে। এই মানুষটার সাথে চল্লিশ বছর ধরে ঘর করছে। সুমনা দাঁড়ালো না। একপ্রকার ছুটে চলে গেল পাছে মিথ্যে অভিনয় ধরা পড়ে যায়। সুশোভনের মনে হলো মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচিলটা যদি বার্লিন ওয়ালের মতো ভেঙ্গে ফেলা যেতো। কিন্তু ওটা যে চিনের প্রাচীর। ওটাকে ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব নয়। বাটিটা নিয়ে সুশোভন চলে যায়। তাড়াতাড়ি খেয়ে বাটিটা ধুয়ে এনে দিতে হবে যে।