Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#গল্পের নকসি কাঁথা।# বর্ণপরিচয়।আত্মশক্তি।অনিতা দাশগুপ্ত।আজ থেকে অনেক বছর আগের ঘটনা। মেঘা ঘটনা টা শুনেছিল ওর দিদার মুখ থেকে । দিদার পিসি ঠাকুমার জীবনের কথা। তখন দেশ স্বাধীনহয় নি। দিদার পিসি ঠাকুমা ছিলেন কলকাতার বাগবাজারের মুখার্…

 


#গল্পের নকসি কাঁথা।

# বর্ণপরিচয়।

আত্মশক্তি।

অনিতা দাশগুপ্ত।

আজ থেকে অনেক বছর আগের ঘটনা। মেঘা ঘটনা টা শুনেছিল ওর দিদার মুখ থেকে । দিদার 

পিসি ঠাকুমার জীবনের কথা। তখন দেশ স্বাধীন

হয় নি। দিদার পিসি ঠাকুমা ছিলেন কলকাতার বাগবাজারের মুখার্জি পরিবারের বৌ। নাম ছিল

সুরবালা।  এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে সুরবালা আসে ডাকসাইটের ঐ পরিবারে। তখনকার দিনে যৌথ পরিবার হত অনেক শাখা প্রশাখা নিয়ে। ছোট্ট সুরবালা সেখানে বৌয়ের থেকে মেয়ে হিসেবেই বেশি সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। স্বামী প্রভাতকুমার তখন কলেজে পড়তো। বৌ এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হত খুব ই কম। সুরবালার সাথী ছিল ঐ তার বড় ভাসুরের ছেলে মেয়েরা। কাকীর থেকে ওরা সই হিসেবে ই বেশী পছন্দ করত সুরবালা কে। ভাসুর ঝি দের সঙ্গে পুতুল খেলে সময় কাটত দিনের অনেক টা

সময়। তবে আর একটা ব্যাপার ও ছিল। তাই হলো

ভাসুর পোর পড়াশোনার প্রতি ওনার আগ্রহ। তাই

যখন বিধুভূষন পড়তে বসত সুরবালা গুটি গুটি পায়ে তার পাশে বসে বিধুর পড়া শুনত। প্রথম প্রথম সেইরকম নজরে না পড়লেও একদিন বিধু 

কাকির মুগ্ধ হয়ে ওর পড়া গুলো শোনা দেখে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, "  পড়াশোনা তোমার খুব ভালো লাগে , তাই না কাকী? '

নোলক পড়া ছোট্ট মুখ টা হাসি তে ভরে গিয়েছিল

সুরবালার। ঘাড় নেড়ে বলেছিল, " খুব ভালো লাগে। তুমি যখন বাংলা পড়ো , আমি তো সেগুলো

বুঝতে পারি। আমারা যেরকম ভাষায় কথা বলি, 

সেই রকম ই তো লাগে। কিন্তু ঐ ইংরিজি টা বুঝতে

পারি না।'

" সেটা বুঝতে পারবে কীভাবে? আমরা ও অতো বুঝি না। পড়তে হয় তাই পড়ি। '

চোখ টা গোলগাল করে সুরবালা বলে, " ও মা তাই 

নাকি? তাহলে পড়ো কেন? '

" ওটার দরকার আছে। না হলে বড়ো হতে পারবো না তো। আচ্ছা কাকী তুমি বাংলা পড়বে ? আমি 

তোমাকে শিখিয়ে দেব। লিখতে ও শিখিয়ে দেবো।'

সেই সময় ওদের পাসে বসে থাকা বিধুর বোন মোহিনী বলে ওঠে," ছি ছি এমন কথা বলিস না দাদা। মেয়েমানুষ দের কী কখনো পড়াশোনা করতে আছে? ঠাকুরে পাপ দেবে তো তার হলে।'

" তুই চুপ কর তো । কিছু ই জানিস না। তুই কী জানিস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  মেয়েদের পড়াশোনা র জন্য কত চেষ্টা করছেন। আমাদের বাড়ির কাছে

কোথায় একটা শুধু মেয়েদের জন্য একটা স্কুল খুলেছেন। ''

" দাদা তুই এতো কথা জানলি কী করে?'

" আমাদের স্কুলের মাষ্টার মশাই তো ওনার কথা কতো বলেন। বলেন উনি অনেক বড়ো বিদ্বান।'

" বিদ্বান মানে কী রে দাদা?'

বোনের কথা তে বিধু হেসে বলে, " আরে তুই এটাও

জানিস না? অবশ্য জানবি কেমন করে , তুই তো

বর্ণপরিচয় বই টা পড়িস নি। শোন বিদ্বান মানে হল

যারা অনেক পড়াশোনা করেন , অনেক পাস দেন।''

ওদের কাকী দুই ভাই বোনের কথা মন দিয়ে শোনার পর বিজ্ঞের মতো বলে মোহিনী কে , " এ

তোমার কেমন ধারা কথা? আমরা যদি একটু লেখা পড়া করি, তাতে ক্ষতি কী? আমার ভাই পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। আমার দাদারা যখন

পড়তো আমি তো শুনতাম । আর সেই দেখে আমার ছোট কাকা আমার লেখা পড়া করার ব্যাবস্থা করেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ই বিয়ে হয়ে গেল। আর হল না কিছু। কিন্তু আমার বড়ো শেখার 

শখ। বিধু তুমি আমাকে শেখাবে তো পড়তে লিখতে?''

"হাঁ কাকী নিশ্চয়ই শেখাবো। বর্ণপরিচয় থেকে তোমাকে অক্ষর গুলো শিখিয়ে দেব। তাহলে তুমি 

ঠিক শিখে যাবে। ''

" তাহলে তো বেশ হয়। তোমার কাকা কে একেবারে 

চমকে দেব। যদি লিখতে ও শিখে যাই তাহলে তো বড়ো ভালো হয়। ওর ব্ই খাতা গুলো তে বেশ ওর

নাম লিখে দেব, যেমন আমার দাদারা লিখতো। মোহিনী তুমি ও আমার সঙ্গে শিখবে লিখতে পড়তে , তাহলে বিয়ের পর তুমি ও তোমার বরের ব্ই পড়তে পারবে। ''

বিধু খুব খুশী হয়ে বলে, " তাহলে আজ থেকেই তোমাদের দুজনকেই পড়তে শেখাবো আমি।''

মোহিনী ও ততটা খুশি হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ ওর

মুখ টা কালো হয়ে আসে বলে, " হাঁ গো , ঠাকুর আমাদের আবার পাপ দেবে না তো?  আর ঠাকুমা, 

মা, পিসি রা যদি জানতে পারে তাহলে তো খুব বকবে। ওরা তো সবসময় বলে মেয়েদের পড়ালেখা করতে নেই।''

সব শুনে বিধু বলে , " এখন ই কাউকে বলিস না।

চুপিচুপি আমি তোদের শেখাবো। ''

এই লুকোচুরি র ব্যাপার টা তে মজা পেয়ে তিনজনেই মুখ চেপে হাসতে আরম্ভ করে।

সেদিন সন্ধ্যে থেকে বিধু ওদের বর্ণপরিচয় থেকে অ আ শেখাতে শুরু করে। খুব উৎসাহের সঙ্গে শিখতে থাকে দুজনেই।

 বেশ কিছুদিন পর বিধুর পুরোনো স্লেট এ ওরা লিখতে আরম্ভ করে। লিখতে শেখার পর বর কে 

চমকে দেয় একদিন  ব্ই খাতার ওপরে কাঁচা অক্ষরে প্রভাতকুমারের নাম টা লিখে। সেদিন রাতে

সত্যি ই চমকে গিয়েছিল সুরবালা র বর। বলেছিল, 

তুমি লিখতে পড়তে পারো? কৈ আগে তো বলো নি? ''

মাথা টা সজোরে নাড়তে নাড়তে সুরবালা বলেছিল," না গো আমি জানতাম না। বিধু তো আমাকে আর মোহিনী কে শিখিয়েছে। তোমাকে তো চমকে দেবার জন্য ইচ্ছা করে বলি নি। শোনো গো মা, দিদি রা কেউ জানে না গো। ওদের বলি নি।'' 

" সে ঠিক আছে। তবে আমি যদি জানতাম তুমি পড়াশোনা করতে চাও আমি ই তোমাকে দেখাতাম। বিধু অনেক ভালো কাজ করেছে । এই রকম ভাবেই তো বিদ্যাসাগরের ইচ্ছা কে আমরা সবাই মিলে পূর্ণ করতে পারবো।''

সুরবালার তখন মনে হয় এই নাম তো ও শুনেছিল

বিধু র মুখে। তাই জিজ্ঞেস করে," এই মানুষটার লেখা ব্ই বর্ণপরিচয় পড়েই তো অক্ষর জ্ঞান হলো।

কিন্তু উনি কে গো? আর তোমরা সবাই বিদ্যাসাগর 

বলো, ওনার কী ওটাই নাম? ''

" তা নয় সুরবালা। ওনার নাম হলো ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু অনেক পড়াশোনা করেছেন তো তাই সবাই ওনাকে বিদ্যাসাগর বলে। জানো তো বাংলা ভাষা ছাড়া সংস্কৃত ভাষা বলে একটা ভাষা আছে সেই ভাষা ও সাহিত্যের উনি অনেক

বড়ো পন্ডিত। '

সংস্কৃত ভাষা তো বড়ো কঠিন গো।  পুরোহিত মশাইরা তো পুজো করেন ঐ ভাষাতেই। কিন্তু আমরা কিছু ই বুঝি না। তার থেকে বরং বর্ণপরিচয়ের ভাষা অনেক সহজ । আমরা বুঝতে পারি। ''

" সকলে যাতে পড়াশোনা করতে পারে তাই তো উনি বর্ণপরিচয় লিখেছেন। ''

" বিধু বলছিল, এখানে নাকি মেয়েদের স্কুল খুলেছেন বিদ্যাসাগর? '

" খুলেছেন তো। আরও অনেক জায়গায় খুলেছেন। তোমার কী স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে সুরবালা? ''

" করে তো। কিন্তু ‌তা কী আমার হবে গো? বাড়ির সবাই তো তখন বকবে।''

" দেখি আমি কী করতে পারি। বাবা , দাদা দের সঙ্গে কথা বলি। তবে বৌ মানুষ তো তুমি। তোমাকে যেতে দেবে কি না সন্দেহ আছে।''

" তাহলে মোহিনী কে তো যেতে দিতে পারে। তুমি 

বলো না গো। ও যেতে দিলে ও কিন্তু বেশ হয়। আমি না হয় তোমার ও বিধুর কাছে ই শিখবো।'

   পরের দিন ই বাড়ির বড়োদের কাছে কথা টা বলেছিল প্রভাত। প্রথমে সবাই রে রে করে তেড়ে আসলে ও মেজদা রাজী হয়েছিল। কারন উনি 

বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন কে সমর্থন করতেন। তবে বাড়ির বৌ

এর স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি হয় নি কেউ।

কিন্তু মোহিনী কে হিন্দু বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছিল। মোহিনী কে স্কুলে যেতে দেখে সুরবালা র আনন্দের শেষ ছিল না। ওর সঙ্গে স্কুল নিয়ে কত কথা ই হোতো ওর কাকীর। সুরবালা শুনতেন অনেক মেয়ে ওখানে যায় পড়াশোনা করতে। দিদিমণি দের কতো গল্প হত দুজনের। আর হোত 

বিদ্যাসাগরের কথা। মেয়েদের কতো সম্মান করেন

উনি। মোহিনী বলত উনি নাকি সবসময় বলেন মেয়েরা হলো সবচেয়ে বড়ো শক্তি। মেয়েরা শিক্ষিত 

হলে তবেই সমাজ এগিয়ে যেতে পারবে। এমনকি বিধবাদের ও বিয়ে যাতে হয় তারজন্য ও উনি চেষ্টা

করেছেন।

    সব কথা শুনে সুরবালা অবাক হয়ে যেত। ভাবতো মেয়েদের দুঃখ কষ্ট র কথা এমন ভাবে কেউ ভাবতে পারে। এদিকে স্কুলে যাওয়া না হলেও

পড়াশোনা কিন্তু সুরবালার থেমে থাকেনি। পড়াশোনা ভালো বাসতো আর চট করে সব কিছু ধরে নিতে পারতো বলে অল্প দিনের মধ্যেই উনি ছোট ছোট গল্পের বই এবং পরে অনেক ভালো ভালো বই পড়তে শুরু করেছিলেন উনি। শুধু নিজে পড়েন নি বাড়ির সব মেয়েদের ও বৌদের 

বাংলা ভাষা টা শেখাতে পেরেছিলেন উনি। এমনকি তারা নিজেদের নাম টাও সহি করতে শিখেছিল সুরবালার কাছেই। যদিও প্রথমে শাশুড়ি, জা ও ননদের কাছ থেকে কম গঞ্জনা শুনতে হয় নি ওনাকেকে শুধু মাত্র  পড়াশোনা ভালোবাসার দোষে। কিন্তু সেগুলো গায়ে মাখতেন

না তিনি। এই ব্যাপারে অবশ্যই প্রভাতের রাশভারী মেজ কাকা ওনাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন।

------------------------------------------------------------------

এইভাবেই কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। মোহিনী স্কুলের প্রাবেশিক পরীক্ষায় পাস করে গেছে । সেই সময় বাড়ির অভিভাবক রা তার বিয়ের ঠিক করলো নবদ্বীপে এক সম্ভ্রান্ত বাড়িতে। বাড়ির সকলে খুব খুশী।  খুব তোড়জোড় ও শুরু হয়ে

গেছে। কিন্তু মোহিনী ও সুরবালার মুখে হাসি নেই।

সুরবালা  প্রভাতকুমার কে বলেছিল বারবার, " দেখো, " এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। মোহিনী এই বিয়েতে খুশী নয়। বারবার বলছে এতো বয়স্ক ছেলের সঙ্গে ও বিয়ে করতে চায় না। ''

" বয়স্ক তো কী হয়েছে? আমাদের পাল্টি ঘর । ওদের অবস্থা ও তো অনেক ভালো। মোহিনী খুব ভালো থাকবে।''

" কিন্তু ওর বরের তো আগে দুবার বিয়ে হয়ে গেছে।

ছেলে মেয়ে ও আছে। মোহিনী র তো খারাপ লাগতে ই পারে। "

খুব রেগে যায় প্রভাতকুমার। বলে, " এই , তোমাদের সব কিছু তে বাড়াবাড়ি। পুরুষ মানুষ দের দুই চারটে বিয়ে হয়ে থাকতে ই পারে। তাতে দোষ কী। আর মোহিনী র বরের তো আগের পক্ষের বৌ দের মধ্যে একজন বেঁচে নেই।''

" একজন তো আছেই। ও কেন সতীনের সাথে সংসার করবে? এত পড়াশোনা শিখলো। আর সেই 

মানুষ টা ই বা কী? ঘরে বৌ থাকতে আবার বিয়ে? 

এইকারনে ই বিদ্যাসাগর মশাই ছেলেদের অনেক গুলো বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।''

" সেটা তো জানি সুরো। তাছাড়া জানো তো এইসব ব্যাপারে বাবা আর দাদা রা যা ঠিক করবে তাই হবে। আমার তোমার কথা ওরা কেউ শুনবে না।''

 মোহিনীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে। তবে বর দেখে অনেকেরই মনে খারাপ হয়ে গেছে। সবাই বলছে, " এতো সুন্দর ও পড়াশোনা জানা মেয়ের এইরকম বুড়ো বর?''

সুরবালার মন ও খুব খারাপ। আর মোহিনী র দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না । বর দেখে কেঁদে কেটে ওর চোখ মুখ ফুলে গেছে। 

    মোহিনীর বিয়ে হয়ে গেছে বছর খানেক হলো। এর মধ্যে সুরবালার কোল আলো করে এসেছে ফুটফুটে একটা মেয়ে । মেয়ে হওয়াতে শাশুড়ি একটু ক্ষুন্ন হলেও সুরবালা কে কিছু বলার ক্ষমতা

কারোর নেই। কারন ওনার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাতকুমারের বৌ এর বিরুদ্ধে কোনো কথা না

শোনার অভ্যাস। 

    সেদিন সুরবালা ও ওনার বর মেয়ে কে নিয়ে ওনার বাপের বাড়িতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ঠিক সেই সময় একটা টেলিগ্রাম আসে মোহিনীর শ্বশুড় বাড়ি থেকে মোহিনীর বরের হঠাৎ মৃত্যু র খবর নিয়ে। বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।

সুরবালা র বাপের বাড়ি যেহেতু নবদ্বীপে ছিল সেই কারণে সবার সঙ্গে সেও চলে মোহিনী র শ্বশুড় বাড়িতে। মোহিনী কে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এই বছরে যেহেতু ও একবার ই বাপের বাড়ি তে এসেছিল তাই ওকে সকলেই অনেক দিন পরে ই দেখলো। একবছরের মধ্যে ওর শরীর একদম ভেঙে পড়েছে। সুরবালা কে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে মোহিনী। আর ওর শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা বিশেষ করে ওর সতীন এবং শাশুড়ি ওকে দোষ দিতে থাকে অপয়া অপবাদে। শাশুড়ি এই করূন অবস্থা র মধ্যে ও মোহিনী কে গালিগালাজ করতে থাকে। মোহিনী র প্রতি এই অন্যায় গুলো সহ্য হয় না সুরবালা র। কিন্তু ওখানে কিছু না বললেও সবাই মিলে সুরবালা র বাপের বাড়ি এসে ঠিক করে মোহিনী কে তারা আর শ্বশুড় বাড়ি তে রাখবে না। কাজকর্ম মিটে গেলে তাকে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যাবে। ওনাদের সিদ্ধান্ত যখন মোহিনীর শ্বশুড় বাড়িতে জানানো হয় খুব সহজেই সেটা তারা মেনে নেয়। মোহিনী চলে আসে কলকাতার বাড়িতে। কিন্তু আগের জীবনে তাকে আর কেউ ফিরে যেতে দেয় নি। বৈধব্যের হাজার ও নাগপাশে বাঁধা পড়ে যায় মোহিনী। মোহিনীর এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন সুরবালা ওর বরের মারফত বাড়ির সবাই কে বলে মোহিনীর আবার বিয়ে দিতে। কারন এর মধ্যে ই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির কেউ কেউ সুরবালা র কথায় রাজি হলেও অনেকেই রাজী ছিল না। 

     বাড়ির সব কথা যখন মোহিনীর কানে যায় তখন মোহিনী বলে সুরবালা কে," বিয়ে আর করতে চাই না আমি। তাছাড়া আমাকে বিয়ে করবে কে? ''

" তোমাকে বিয়ে করবার জন্য এখনও একজন অপেক্ষা করছে মোহিনী। আমি সব জানি। বিধু

তোমার বিয়ের আগে আমাকে অপূর্ব র ব্যাপারে সব জানিয়েছিল। আমি তোমার কাকা কে বলতে

গিয়ে ও বলতে পারি নি যখন বুঝেছিলাম তোমার শ্বশুড় বাড়ি আমাদের পাল্টি ঘর বলে তোমার কাকা ও তোমাকে ঐ বয়স্ক লোক টার হাতে তুলে দিতে চাইছে। তাই এবার আমি সব কিছু ব্যাবস্থা করেই এগিয়েছি। এমনকি বিদ্যাসাগর মশাই এর

কাছেও গিয়েছিলাম বিধু কে নিয়ে। উনি কাল আমাদের বাড়ি তে আসবেন। অপূর্ব দের বাড়িতে ও যাবেন। মোহিনী এবার তোমার সত্যি কারের বর

আসবে। তুমি খুশি তে থাকো।''

বন্ধু সম কাকী কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে অনেক ক্ষন কেঁদেছিল মোহিনী। সুরবালার চোখ ও জলে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের জল। 

     ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি তে চার হাত

এক হয়ে গিয়েছিল । তার পর শুরু হয়েছিল মোহিনীর সুখী দাম্পত্য জীবন । আর সুরবালা ও

তার প্রিয় সহচরী কে সুখী হতে দেখে মেয়ে আর বর কে নিয়ে তাদের জীবনের বাকি দিন গুলো আনন্দেই কাটিয়ে ছিল।


সমাপ্ত।

    


 


 

#গল্পের নকসি কাঁথা।

# বর্ণপরিচয়।

আত্মশক্তি।

অনিতা দাশগুপ্ত।

আজ থেকে অনেক বছর আগের ঘটনা। মেঘা ঘটনা টা শুনেছিল ওর দিদার মুখ থেকে । দিদার 

পিসি ঠাকুমার জীবনের কথা। তখন দেশ স্বাধীন

হয় নি। দিদার পিসি ঠাকুমা ছিলেন কলকাতার বাগবাজারের মুখার্জি পরিবারের বৌ। নাম ছিল

সুরবালা।  এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে সুরবালা আসে ডাকসাইটের ঐ পরিবারে। তখনকার দিনে যৌথ পরিবার হত অনেক শাখা প্রশাখা নিয়ে। ছোট্ট সুরবালা সেখানে বৌয়ের থেকে মেয়ে হিসেবেই বেশি সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। স্বামী প্রভাতকুমার তখন কলেজে পড়তো। বৌ এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হত খুব ই কম। সুরবালার সাথী ছিল ঐ তার বড় ভাসুরের ছেলে মেয়েরা। কাকীর থেকে ওরা সই হিসেবে ই বেশী পছন্দ করত সুরবালা কে। ভাসুর ঝি দের সঙ্গে পুতুল খেলে সময় কাটত দিনের অনেক টা

সময়। তবে আর একটা ব্যাপার ও ছিল। তাই হলো

ভাসুর পোর পড়াশোনার প্রতি ওনার আগ্রহ। তাই

যখন বিধুভূষন পড়তে বসত সুরবালা গুটি গুটি পায়ে তার পাশে বসে বিধুর পড়া শুনত। প্রথম প্রথম সেইরকম নজরে না পড়লেও একদিন বিধু 

কাকির মুগ্ধ হয়ে ওর পড়া গুলো শোনা দেখে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, "  পড়াশোনা তোমার খুব ভালো লাগে , তাই না কাকী? '

নোলক পড়া ছোট্ট মুখ টা হাসি তে ভরে গিয়েছিল

সুরবালার। ঘাড় নেড়ে বলেছিল, " খুব ভালো লাগে। তুমি যখন বাংলা পড়ো , আমি তো সেগুলো

বুঝতে পারি। আমারা যেরকম ভাষায় কথা বলি, 

সেই রকম ই তো লাগে। কিন্তু ঐ ইংরিজি টা বুঝতে

পারি না।'

" সেটা বুঝতে পারবে কীভাবে? আমরা ও অতো বুঝি না। পড়তে হয় তাই পড়ি। '

চোখ টা গোলগাল করে সুরবালা বলে, " ও মা তাই 

নাকি? তাহলে পড়ো কেন? '

" ওটার দরকার আছে। না হলে বড়ো হতে পারবো না তো। আচ্ছা কাকী তুমি বাংলা পড়বে ? আমি 

তোমাকে শিখিয়ে দেব। লিখতে ও শিখিয়ে দেবো।'

সেই সময় ওদের পাসে বসে থাকা বিধুর বোন মোহিনী বলে ওঠে," ছি ছি এমন কথা বলিস না দাদা। মেয়েমানুষ দের কী কখনো পড়াশোনা করতে আছে? ঠাকুরে পাপ দেবে তো তার হলে।'

" তুই চুপ কর তো । কিছু ই জানিস না। তুই কী জানিস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  মেয়েদের পড়াশোনা র জন্য কত চেষ্টা করছেন। আমাদের বাড়ির কাছে

কোথায় একটা শুধু মেয়েদের জন্য একটা স্কুল খুলেছেন। ''

" দাদা তুই এতো কথা জানলি কী করে?'

" আমাদের স্কুলের মাষ্টার মশাই তো ওনার কথা কতো বলেন। বলেন উনি অনেক বড়ো বিদ্বান।'

" বিদ্বান মানে কী রে দাদা?'

বোনের কথা তে বিধু হেসে বলে, " আরে তুই এটাও

জানিস না? অবশ্য জানবি কেমন করে , তুই তো

বর্ণপরিচয় বই টা পড়িস নি। শোন বিদ্বান মানে হল

যারা অনেক পড়াশোনা করেন , অনেক পাস দেন।''

ওদের কাকী দুই ভাই বোনের কথা মন দিয়ে শোনার পর বিজ্ঞের মতো বলে মোহিনী কে , " এ

তোমার কেমন ধারা কথা? আমরা যদি একটু লেখা পড়া করি, তাতে ক্ষতি কী? আমার ভাই পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। আমার দাদারা যখন

পড়তো আমি তো শুনতাম । আর সেই দেখে আমার ছোট কাকা আমার লেখা পড়া করার ব্যাবস্থা করেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ই বিয়ে হয়ে গেল। আর হল না কিছু। কিন্তু আমার বড়ো শেখার 

শখ। বিধু তুমি আমাকে শেখাবে তো পড়তে লিখতে?''

"হাঁ কাকী নিশ্চয়ই শেখাবো। বর্ণপরিচয় থেকে তোমাকে অক্ষর গুলো শিখিয়ে দেব। তাহলে তুমি 

ঠিক শিখে যাবে। ''

" তাহলে তো বেশ হয়। তোমার কাকা কে একেবারে 

চমকে দেব। যদি লিখতে ও শিখে যাই তাহলে তো বড়ো ভালো হয়। ওর ব্ই খাতা গুলো তে বেশ ওর

নাম লিখে দেব, যেমন আমার দাদারা লিখতো। মোহিনী তুমি ও আমার সঙ্গে শিখবে লিখতে পড়তে , তাহলে বিয়ের পর তুমি ও তোমার বরের ব্ই পড়তে পারবে। ''

বিধু খুব খুশী হয়ে বলে, " তাহলে আজ থেকেই তোমাদের দুজনকেই পড়তে শেখাবো আমি।''

মোহিনী ও ততটা খুশি হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ ওর

মুখ টা কালো হয়ে আসে বলে, " হাঁ গো , ঠাকুর আমাদের আবার পাপ দেবে না তো?  আর ঠাকুমা, 

মা, পিসি রা যদি জানতে পারে তাহলে তো খুব বকবে। ওরা তো সবসময় বলে মেয়েদের পড়ালেখা করতে নেই।''

সব শুনে বিধু বলে , " এখন ই কাউকে বলিস না।

চুপিচুপি আমি তোদের শেখাবো। ''

এই লুকোচুরি র ব্যাপার টা তে মজা পেয়ে তিনজনেই মুখ চেপে হাসতে আরম্ভ করে।

সেদিন সন্ধ্যে থেকে বিধু ওদের বর্ণপরিচয় থেকে অ আ শেখাতে শুরু করে। খুব উৎসাহের সঙ্গে শিখতে থাকে দুজনেই।

 বেশ কিছুদিন পর বিধুর পুরোনো স্লেট এ ওরা লিখতে আরম্ভ করে। লিখতে শেখার পর বর কে 

চমকে দেয় একদিন  ব্ই খাতার ওপরে কাঁচা অক্ষরে প্রভাতকুমারের নাম টা লিখে। সেদিন রাতে

সত্যি ই চমকে গিয়েছিল সুরবালা র বর। বলেছিল, 

তুমি লিখতে পড়তে পারো? কৈ আগে তো বলো নি? ''

মাথা টা সজোরে নাড়তে নাড়তে সুরবালা বলেছিল," না গো আমি জানতাম না। বিধু তো আমাকে আর মোহিনী কে শিখিয়েছে। তোমাকে তো চমকে দেবার জন্য ইচ্ছা করে বলি নি। শোনো গো মা, দিদি রা কেউ জানে না গো। ওদের বলি নি।'' 

" সে ঠিক আছে। তবে আমি যদি জানতাম তুমি পড়াশোনা করতে চাও আমি ই তোমাকে দেখাতাম। বিধু অনেক ভালো কাজ করেছে । এই রকম ভাবেই তো বিদ্যাসাগরের ইচ্ছা কে আমরা সবাই মিলে পূর্ণ করতে পারবো।''

সুরবালার তখন মনে হয় এই নাম তো ও শুনেছিল

বিধু র মুখে। তাই জিজ্ঞেস করে," এই মানুষটার লেখা ব্ই বর্ণপরিচয় পড়েই তো অক্ষর জ্ঞান হলো।

কিন্তু উনি কে গো? আর তোমরা সবাই বিদ্যাসাগর 

বলো, ওনার কী ওটাই নাম? ''

" তা নয় সুরবালা। ওনার নাম হলো ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু অনেক পড়াশোনা করেছেন তো তাই সবাই ওনাকে বিদ্যাসাগর বলে। জানো তো বাংলা ভাষা ছাড়া সংস্কৃত ভাষা বলে একটা ভাষা আছে সেই ভাষা ও সাহিত্যের উনি অনেক

বড়ো পন্ডিত। '

সংস্কৃত ভাষা তো বড়ো কঠিন গো।  পুরোহিত মশাইরা তো পুজো করেন ঐ ভাষাতেই। কিন্তু আমরা কিছু ই বুঝি না। তার থেকে বরং বর্ণপরিচয়ের ভাষা অনেক সহজ । আমরা বুঝতে পারি। ''

" সকলে যাতে পড়াশোনা করতে পারে তাই তো উনি বর্ণপরিচয় লিখেছেন। ''

" বিধু বলছিল, এখানে নাকি মেয়েদের স্কুল খুলেছেন বিদ্যাসাগর? '

" খুলেছেন তো। আরও অনেক জায়গায় খুলেছেন। তোমার কী স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে সুরবালা? ''

" করে তো। কিন্তু ‌তা কী আমার হবে গো? বাড়ির সবাই তো তখন বকবে।''

" দেখি আমি কী করতে পারি। বাবা , দাদা দের সঙ্গে কথা বলি। তবে বৌ মানুষ তো তুমি। তোমাকে যেতে দেবে কি না সন্দেহ আছে।''

" তাহলে মোহিনী কে তো যেতে দিতে পারে। তুমি 

বলো না গো। ও যেতে দিলে ও কিন্তু বেশ হয়। আমি না হয় তোমার ও বিধুর কাছে ই শিখবো।'

   পরের দিন ই বাড়ির বড়োদের কাছে কথা টা বলেছিল প্রভাত। প্রথমে সবাই রে রে করে তেড়ে আসলে ও মেজদা রাজী হয়েছিল। কারন উনি 

বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন কে সমর্থন করতেন। তবে বাড়ির বৌ

এর স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি হয় নি কেউ।

কিন্তু মোহিনী কে হিন্দু বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছিল। মোহিনী কে স্কুলে যেতে দেখে সুরবালা র আনন্দের শেষ ছিল না। ওর সঙ্গে স্কুল নিয়ে কত কথা ই হোতো ওর কাকীর। সুরবালা শুনতেন অনেক মেয়ে ওখানে যায় পড়াশোনা করতে। দিদিমণি দের কতো গল্প হত দুজনের। আর হোত 

বিদ্যাসাগরের কথা। মেয়েদের কতো সম্মান করেন

উনি। মোহিনী বলত উনি নাকি সবসময় বলেন মেয়েরা হলো সবচেয়ে বড়ো শক্তি। মেয়েরা শিক্ষিত 

হলে তবেই সমাজ এগিয়ে যেতে পারবে। এমনকি বিধবাদের ও বিয়ে যাতে হয় তারজন্য ও উনি চেষ্টা

করেছেন।

    সব কথা শুনে সুরবালা অবাক হয়ে যেত। ভাবতো মেয়েদের দুঃখ কষ্ট র কথা এমন ভাবে কেউ ভাবতে পারে। এদিকে স্কুলে যাওয়া না হলেও

পড়াশোনা কিন্তু সুরবালার থেমে থাকেনি। পড়াশোনা ভালো বাসতো আর চট করে সব কিছু ধরে নিতে পারতো বলে অল্প দিনের মধ্যেই উনি ছোট ছোট গল্পের বই এবং পরে অনেক ভালো ভালো বই পড়তে শুরু করেছিলেন উনি। শুধু নিজে পড়েন নি বাড়ির সব মেয়েদের ও বৌদের 

বাংলা ভাষা টা শেখাতে পেরেছিলেন উনি। এমনকি তারা নিজেদের নাম টাও সহি করতে শিখেছিল সুরবালার কাছেই। যদিও প্রথমে শাশুড়ি, জা ও ননদের কাছ থেকে কম গঞ্জনা শুনতে হয় নি ওনাকেকে শুধু মাত্র  পড়াশোনা ভালোবাসার দোষে। কিন্তু সেগুলো গায়ে মাখতেন

না তিনি। এই ব্যাপারে অবশ্যই প্রভাতের রাশভারী মেজ কাকা ওনাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন।

------------------------------------------------------------------

এইভাবেই কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। মোহিনী স্কুলের প্রাবেশিক পরীক্ষায় পাস করে গেছে । সেই সময় বাড়ির অভিভাবক রা তার বিয়ের ঠিক করলো নবদ্বীপে এক সম্ভ্রান্ত বাড়িতে। বাড়ির সকলে খুব খুশী।  খুব তোড়জোড় ও শুরু হয়ে

গেছে। কিন্তু মোহিনী ও সুরবালার মুখে হাসি নেই।

সুরবালা  প্রভাতকুমার কে বলেছিল বারবার, " দেখো, " এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। মোহিনী এই বিয়েতে খুশী নয়। বারবার বলছে এতো বয়স্ক ছেলের সঙ্গে ও বিয়ে করতে চায় না। ''

" বয়স্ক তো কী হয়েছে? আমাদের পাল্টি ঘর । ওদের অবস্থা ও তো অনেক ভালো। মোহিনী খুব ভালো থাকবে।''

" কিন্তু ওর বরের তো আগে দুবার বিয়ে হয়ে গেছে।

ছেলে মেয়ে ও আছে। মোহিনী র তো খারাপ লাগতে ই পারে। "

খুব রেগে যায় প্রভাতকুমার। বলে, " এই , তোমাদের সব কিছু তে বাড়াবাড়ি। পুরুষ মানুষ দের দুই চারটে বিয়ে হয়ে থাকতে ই পারে। তাতে দোষ কী। আর মোহিনী র বরের তো আগের পক্ষের বৌ দের মধ্যে একজন বেঁচে নেই।''

" একজন তো আছেই। ও কেন সতীনের সাথে সংসার করবে? এত পড়াশোনা শিখলো। আর সেই 

মানুষ টা ই বা কী? ঘরে বৌ থাকতে আবার বিয়ে? 

এইকারনে ই বিদ্যাসাগর মশাই ছেলেদের অনেক গুলো বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।''

" সেটা তো জানি সুরো। তাছাড়া জানো তো এইসব ব্যাপারে বাবা আর দাদা রা যা ঠিক করবে তাই হবে। আমার তোমার কথা ওরা কেউ শুনবে না।''

 মোহিনীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে। তবে বর দেখে অনেকেরই মনে খারাপ হয়ে গেছে। সবাই বলছে, " এতো সুন্দর ও পড়াশোনা জানা মেয়ের এইরকম বুড়ো বর?''

সুরবালার মন ও খুব খারাপ। আর মোহিনী র দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না । বর দেখে কেঁদে কেটে ওর চোখ মুখ ফুলে গেছে। 

    মোহিনীর বিয়ে হয়ে গেছে বছর খানেক হলো। এর মধ্যে সুরবালার কোল আলো করে এসেছে ফুটফুটে একটা মেয়ে । মেয়ে হওয়াতে শাশুড়ি একটু ক্ষুন্ন হলেও সুরবালা কে কিছু বলার ক্ষমতা

কারোর নেই। কারন ওনার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাতকুমারের বৌ এর বিরুদ্ধে কোনো কথা না

শোনার অভ্যাস। 

    সেদিন সুরবালা ও ওনার বর মেয়ে কে নিয়ে ওনার বাপের বাড়িতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ঠিক সেই সময় একটা টেলিগ্রাম আসে মোহিনীর শ্বশুড় বাড়ি থেকে মোহিনীর বরের হঠাৎ মৃত্যু র খবর নিয়ে। বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।

সুরবালা র বাপের বাড়ি যেহেতু নবদ্বীপে ছিল সেই কারণে সবার সঙ্গে সেও চলে মোহিনী র শ্বশুড় বাড়িতে। মোহিনী কে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এই বছরে যেহেতু ও একবার ই বাপের বাড়ি তে এসেছিল তাই ওকে সকলেই অনেক দিন পরে ই দেখলো। একবছরের মধ্যে ওর শরীর একদম ভেঙে পড়েছে। সুরবালা কে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে মোহিনী। আর ওর শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা বিশেষ করে ওর সতীন এবং শাশুড়ি ওকে দোষ দিতে থাকে অপয়া অপবাদে। শাশুড়ি এই করূন অবস্থা র মধ্যে ও মোহিনী কে গালিগালাজ করতে থাকে। মোহিনী র প্রতি এই অন্যায় গুলো সহ্য হয় না সুরবালা র। কিন্তু ওখানে কিছু না বললেও সবাই মিলে সুরবালা র বাপের বাড়ি এসে ঠিক করে মোহিনী কে তারা আর শ্বশুড় বাড়ি তে রাখবে না। কাজকর্ম মিটে গেলে তাকে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যাবে। ওনাদের সিদ্ধান্ত যখন মোহিনীর শ্বশুড় বাড়িতে জানানো হয় খুব সহজেই সেটা তারা মেনে নেয়। মোহিনী চলে আসে কলকাতার বাড়িতে। কিন্তু আগের জীবনে তাকে আর কেউ ফিরে যেতে দেয় নি। বৈধব্যের হাজার ও নাগপাশে বাঁধা পড়ে যায় মোহিনী। মোহিনীর এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন সুরবালা ওর বরের মারফত বাড়ির সবাই কে বলে মোহিনীর আবার বিয়ে দিতে। কারন এর মধ্যে ই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির কেউ কেউ সুরবালা র কথায় রাজি হলেও অনেকেই রাজী ছিল না। 

     বাড়ির সব কথা যখন মোহিনীর কানে যায় তখন মোহিনী বলে সুরবালা কে," বিয়ে আর করতে চাই না আমি। তাছাড়া আমাকে বিয়ে করবে কে? ''

" তোমাকে বিয়ে করবার জন্য এখনও একজন অপেক্ষা করছে মোহিনী। আমি সব জানি। বিধু

তোমার বিয়ের আগে আমাকে অপূর্ব র ব্যাপারে সব জানিয়েছিল। আমি তোমার কাকা কে বলতে

গিয়ে ও বলতে পারি নি যখন বুঝেছিলাম তোমার শ্বশুড় বাড়ি আমাদের পাল্টি ঘর বলে তোমার কাকা ও তোমাকে ঐ বয়স্ক লোক টার হাতে তুলে দিতে চাইছে। তাই এবার আমি সব কিছু ব্যাবস্থা করেই এগিয়েছি। এমনকি বিদ্যাসাগর মশাই এর

কাছেও গিয়েছিলাম বিধু কে নিয়ে। উনি কাল আমাদের বাড়ি তে আসবেন। অপূর্ব দের বাড়িতে ও যাবেন। মোহিনী এবার তোমার সত্যি কারের বর

আসবে। তুমি খুশি তে থাকো।''

বন্ধু সম কাকী কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে অনেক ক্ষন কেঁদেছিল মোহিনী। সুরবালার চোখ ও জলে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের জল। 

     ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি তে চার হাত

এক হয়ে গিয়েছিল । তার পর শুরু হয়েছিল মোহিনীর সুখী দাম্পত্য জীবন । আর সুরবালা ও

তার প্রিয় সহচরী কে সুখী হতে দেখে মেয়ে আর বর কে নিয়ে তাদের জীবনের বাকি দিন গুলো আনন্দেই কাটিয়ে ছিল "


সমাপ্ত