#অণুগল্প#চাকার_ব্যথা#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
-- প্রতিদিন সাধু সন্ন্যাসীদের মতো তোমার এই শুধু "ত্যাগ - ত্যাগ" শুনতে শুনতে আমি বোর হয়ে যাচ্ছি এবার।বলতে পারো! এই সংসারের জন্য আর কতো ত্যাগ করবো আমি? প্রথমে তোমার মা বাবার জন্য,…
#অণুগল্প
#চাকার_ব্যথা
#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
-- প্রতিদিন সাধু সন্ন্যাসীদের মতো তোমার এই শুধু "ত্যাগ - ত্যাগ" শুনতে শুনতে আমি বোর হয়ে যাচ্ছি এবার।
বলতে পারো! এই সংসারের জন্য আর কতো ত্যাগ করবো আমি? প্রথমে তোমার মা বাবার জন্য, তারপর তোমার সন্তানদের জন্য, তারপর তোমার জন্য, দিনরাত ত্যাগ তো করেই চলেছি।
নিজেকে তো খুঁজেই পাই না আর, পুরো জীবনটাই দিয়ে দিলাম তোমাদের জন্য।
তারপরও তোমার সেই ত্যাগের মন্ত্র জপ করা বন্ধ হলো না? আর কি চাও তুমি আমার কাছে? ষাটোর্দ্ধ মৃণালিনী অমাবস্যার অন্ধকার রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশের নীচে বহুতল বাড়ির ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে বিকাশের বুকে মাথা রেখে সমানে কেঁদে চলেছে।
বিকাশ তাকে চুপ করাতে ব্যস্ত -- চু-প! চু-প! সবাই শুনতে পাবে তো-- এতো রাতে এইরকম চিৎকার চেঁচামেচি শুনলে, ছেলে বৌমা আমাদের কি ভাববে বলোতো?
আবার চিৎকার করে ওঠে মৃণালিনী -- শুনলে শুনবে-- ভাবলে ভাববে-- সোজা কথায়, আমি ফ্ল্যাট বেচতে দেবো না তোমাকে। সারা জীবন চাকরি-বাকরি করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, অতি সামান্যই তো সঞ্চয় করতে পেরেছি আমরা। আমাদের সেই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের প্রায় সবটা দিয়ে তুমি এই ফ্ল্যাটটা কিনেছো। এখন আমাদের বলতে তো শুধু এইটুকুই।
-- দেখো মৃণাল, তুমি তো জীবনে এতো ত্যাগ করেছো। আমরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করি, যে শুধুমাত্র তোমার ঐ ত্যাগের জন্যই আমাদের দু' সন্তানই আজ বিদেশের মাটিতে পা ফেলেছে। তবে এই শেষ জীবনে এসে কেন সেই পথ থেকে সরে আসা?
-- না। আর নয় বিকাশ। ওদের কিসের অভাব, যে ওরা বাবা মায়ের একমাত্র সম্বল, ফ্ল্যাটটাও বিক্রি করতে চাইছে? যা বুঝতে পারছি, এরপর তো বলবে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকো। তখন? চোখের জলে বুক ভেসে যায় মৃণালিনীর।
মাথার ওপর দিয়ে হুস্স্স্--- করে উড়ে গেলো একটা প্লেন। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে পুরো এয়ারপোর্টটা। চারিদিক আলোয় আলোময়।রানওয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে একটা প্লেন। আর একটা টেক অফের উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করেছে রানওয়ে ধরে।
মৃণালিনীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বিকাশ সেদিকেই তর্জনী নির্দেশ করে বললো --
দেখো মৃণাল, ভালো করে চেয়ে দেখো। একটা প্লেনকে আকাশে উড়তে দেখলে কতো ভালো লাগে বলো! কিন্তু ওর এই ওড়ার পেছনে কত ত্যাগ আছে, তার হিসাব কি কেউ রাখে? টেক অফ করার আগে পর্যন্ত চাকাগুলো একেবারে পিষে যায়। স্থায়ী ঠিকানা বলে কি কিছু আছে ওদের! প্রতিমুহূর্তে একটার পর একটা স্থান ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে দুরন্ত গতিতে। প্লেনকে ওড়ানোর জন্য ওদের সবচেয়ে বড় ত্যাগটা করতে হয় কিন্তু শেষ মুহূর্তে । নিজের আপন ভূমি থেকেই পা তুলে নিতে হয়। চাকাগুলো জানে, ওদের জন্মই হয়েছে প্লেন ওড়ানোর জন্য, ভূমি আঁকড়ে পড়ে থাকার জন্য নয়।
ছেলেমেয়েকে যেমনভাবে বুক দিয়ে আগলে মানুষ করেছো, ঠিক সেইরকমভাবেই এবার তাদেরকে বিশ্বাস করে ভূমিটাও ত্যাগ করে দাও মৃণাল। দেখবে চাকার মতো তুমিও আকাশে উড়ছো। দেখো, তোমার সন্তানেরাই তোমাকে ওড়াবে।
-- তুমি ভুল বললে বিকাশ। চাকারা আসমানে থাকে ঠিকই, কিন্তু ওড়ে না। তারা প্লেনেরই একটা সেলে বন্দী থাকে। আমি আর কিছু ত্যাগ করতে পারবো না। আসমানের বন্দী জীবনের চেয়ে আমার মাটিই ভালো। বন্দী জীবন আমি নিতে পারবো না বিকাশ। তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, এই শেষ জীবনটা অন্ততঃ একটু নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। বিকাশের পা জড়িয়ে ধরে মৃণালিনী।
পাপিয়া অনেকক্ষণ থেকে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বিকাশ আর মৃণালিনীর কথা শুনছিল। এবার আর থাকতে না পেরে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মৃণালিনীকে -- মা, আপনি এভাবে কাঁদবেন না। আপনি না চাইলে এ ফ্ল্যাট কেউ বিক্রি করবে না। আমি আপনার হয়ে বলবো। আসলে আপনার ছেলে আপনাদেরকে খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। তাই আপনাদের নিয়েই একসাথে থাকতে চায়। নিউ জার্সিতে থাকাকালীন ও সবসময় আপনাদের মিস করে। ও শুধু বলে -- আজ আমি যা কিছু, সব আমার বাবা মায়ের ত্যাগের ফসল। ওঁরা সারাটাজীবন আমাদের দু'ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো। আচ্ছা পাপিয়া! আজকের দিনে আমার বাসায় কি এতোটা জায়গা নেই, যেখানে তাঁদের মনের মধ্যে জমে থাকা অজস্র স্মৃতি আর আমাদের নতুন নতুন খুশীগুলোকে নিয়ে এক সাথে কুলিয়ে গুছিয়ে থেকে যেতে পারি আমরা?
মৃণালিনী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পাপিয়ার চোখের দিকে। দু'জনের চোখেই ভালোবাসার তরল টলমল করছে। এয়ারপোর্টের আলোর আভায় অন্ধকারেও পারদের মতো চকচক করছে ওগুলো।
আরো একটা প্লেন মাথার ওপর দিয়ে হুস্স্স্-- করে উড়ে চলে গেল। এবার মৃণালিনী ওপরের দিকে তাকালো। উদাস দৃষ্টিতে সে ভাবতে থাকে -- চাকাগুলো কি প্লেনকে উড়িয়ে দিয়ে ভূমিতে ভালো থাকতে পারতো!!!
প্লেন ল্যান্ড করার সময় যে তাদের আবার দরকার পড়বে। তারা না থাকলে তখন সেই আঘাত, সেই কষ্টের ভার আর কেউ কি নিতে পারবে!!!