দৈনিক গল্প প্রতিযোগিতামন-যাপনঅণুগল্পগৌতমী ভট্টাচার্য*******************
গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং বারো বার রাত বারোটার ঘন্টা বেজে গভীর রাত প্রহরের অস্তিত্ব ঘোষনা করল। রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শেষ ট্রেনটা চলে গেল।
সারাদিনের …
দৈনিক গল্প প্রতিযোগিতা
মন-যাপন
অণুগল্প
গৌতমী ভট্টাচার্য
*******************
গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং বারো বার রাত বারোটার ঘন্টা বেজে গভীর রাত প্রহরের অস্তিত্ব ঘোষনা করল। রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শেষ ট্রেনটা চলে গেল।
সারাদিনের কর্মব্যস্ত দিনযাপনের পর নিঃঝুম মায়াবীরাতের আলো-আধারি পরিবেশে টেবিল ল্যাম্পের স্নিগ্ধ আলোয় কথাকলি লিখে চলেছে তার গল্পের শেষ পর্ব। গল্পটা কয়েকদিনের মধ্যে পত্রিকার দপ্তরে পাঠানোর তাগাদা এসে গেছে। কিন্তু গল্পের পরিণতি লিখতে গিয়ে কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না আজ, লিখতে লিখতে কথাকলির কলম চলতে চাইছে না কিছুতেই। অবসন্ন হাতে কলমটা খাতার পাতার ওপর রেখে নিঃশব্দে ধীর পায়ে চলল ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। পাশের শোবার ঘরে কথাকলির জীবন সঙ্গী স্বামী শুভময়ের নাসিকা-গর্জনে যাতে বিঘ্ন না ঘটে আরামকেদারাটা আস্তে টেনে বসল কথাকলি---এ তার প্রায় প্রতিদিনের অভ্যাস।
সারাদিনের অজস্র কাজের পর একবার অন্তত কথাকলি নিজের মুখোমুখি হতে ভালোবাসে। রাতের এই নিভৃত সময়টাকেই সে বেছে নিয়েছে। সাক্ষী থাকে আকাশ ভরা রাতের তারারা। প্রতিদিনের মতো আজো উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলল অজস্র প্রশ্ন--- মন, তুমি আমার মধ্যে আছো তো?
একি কথা --কথাকলি আমি তো তোমার হৃদয়ের তরণীতে ই বসে আছি।
তাহলে আমি কেন সারাদিনে তোমার হদিস পাই না।
কথাকলি তোমার অজস্র কাজের তলায় আমি যে চাপা পড়ে আছি, তোমার হাসি কান্না মান অভিমান কর্তব্য দায়দায়িত্বের প্রতি পল প্রতি মুহূর্ত প্রতিটি অণু-পরমাণুর মধ্যে মিশে থাকি। তবুও তুমি আমার অস্তিত্বের টের পাও না।
না না মন, সত্যিই পাই না তোমাকে দেখতে।
কথাকলি, সত্যি ই খুব হাসি পাচ্ছে আমার, সবসময় আমাকে নিয়ে তোমরা টানাটানি করো। কখনো বলছ ভীষণ মন ছোট কখনো আবার টেনে রাবারের মতো মনটাকে বড় করে দিচ্ছ। কখনো বলছ একদম মন ভালো নেই অথচ বলছ দেখতে পাও না। তোমরা বড় স্বার্থপর আশ্চর্য জগতের বাসিন্দা।
আচ্ছা মন, তুমি যে আজ এতো বড় বড় কথা বলছ, আমার ঠিক কোথায় তুমি আছ বলতো
বললাম যে হৃদয় সমুদ্রের তরীতে, তুমি আমার কোন কথা শোন না কথাকলি।
কিন্তু হৃদয়ের তো আকার আছে মন, আর তোমার, তুমি কেমন দেখতে মন ? তোমার আকার কতো বড় ?
আমি, আমি যে অতি ক্ষুদ্র কথাকলি, অজস্র বালুকারাশির একটি অতি ক্ষুদ্র কণা মাত্র, তাই বোধহয় তুমি আমাকে দেখেও পাত্তা দাও না। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে থাকি।
না মন না, তুমি অভিমান করো না, সত্যিই তো তুমি আমার সঙ্গে থাকো, তাই তো তোমাকে সঙ্গী করে নিমেষে বিদ্যুতগতি তে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা আকাশের তারা দের দেখতে পাই। চলে যাই দেশবিদেশে পাহাড় অরণ্য সমুদ্র ভ্রমণে।
আমি বুঝতে পারছি কথাকলি, প্রতিদিনের অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে বারবার ব্যবহার করে নিজেকে আর আমাকে একঘেয়ে করে ফেলেছ, কোন যত্ন করো না তোমার নিজের আর না আমার। আর তাই তো তোমার আর আমার এত ক্লান্তি এত অবসাদ।
না মন না, একদম না--কথাকলি আর্তনাদ করে ওঠে, এভাবে বললে আমি যে বাঁচতে পারব না, আমি যে মরে যাব---'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।'
তাহলে কথাকলি কেন অস্বীকার করছ নিজেকে ? তোমার ভাললাগা গান ছবি আঁকা তুমি সব ভুলে যাও নি? তুমি তোমার ভালবাসাকে কেন লুকিয়ে রেখেছ কথাকলি। তোমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র বালুকা
কণা মন কি কখনো টিকটিক করে মনে পড়িয়ে দেয় না তোমার ভালোবাসাকে। তুমি স্বীকার করো কথাকলি স্বীকার করো, কেন তুমি তাকে মনের গভীর অতল সিন্ধুকে তালাবন্ধ করে রাখতে চাইছ। কেন তাকে তুমি ভুলে থাকতে চাইছ।
কিন্তু মন, আমি যে দায়বদ্ধ, সংসার, স্বামী, সন্তান সেখানে তো কোন ফাঁক নেই। প্রতিদিনের নিখুঁত সংসার- যাপন প্রত্যেকের পারস্পরিক বিশ্বাসের আনুগত্যের উপর যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সেখানে তো কোন অভিযোগ নেই।
তাহলে কথাকলি, রাতের পর রাত আকাশছাদের নিচে বসে তারাদের সাক্ষী রেখে একা নীরবে নিভৃতে কেন কেন নিজেকে অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছ। তুমি কি তোমার ভালোবাসাকে সত্যিই ভুলে গেলে নাকি ভুলে যাবার অভিনয় করছ। কেন তাকে সযত্নে মনের গহনে গোপন করে রেখে দিয়েছ, সে যে তোমার সৎ দিনযাপনের ঘূর্ণিপাকে অসহায় ভাবে মাথা কুটে মরছে।
আমি যে তাকে বাইরে আনতে ভয় পাই মন, সে যদি বাইরের জনঅরণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যায়। আমার ভালোবাসার পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায়। থাক না সে আমার মনের গহন গোপন সঞ্চয়ের বাক্সে। প্রতিদিন রাতে খোলা আকাশের নিচে তারাদের সাক্ষী রেখে আমার ভালোবাসাকে নিয়ে যাপন করব তোমার সাথে মন।
সূর্যের প্রথম নরম আলোকরশ্মির ছোঁয়া ভোরের একঝলক হিমেল হাওয়ার পরশ কথাকলির চোখে মুখে আদর করে গেল। চোখ মেলে মনে পড়ে গেল রাতের মন-যাপনের কথা।
গল্পের শেষ পরিণতিতে কলমের আঁচড় কাটতে আর কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব রইল না কথাকলির মনে।।