Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকার দৈনিক সেরা লেখনি সম্মাননা

#বিভাগ_ছোটোগল্প#মনভাসি✍🏻 শ্রাবণী দাস       ৩০.৯.২০২০
ইঁট বের করা পোড়ো মন্দিরের মরচে ধরা রেলিং-এর গা জড়িয়ে মাথা বাড়িয়েছে বেনামি কিছু জংলি লতাপাতা। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে সরু একফালি পায়ে চলার পথ।পথটা গিয়ে মিশেছে ফুল্লরা…

 


#বিভাগ_ছোটোগল্প

#মনভাসি

✍🏻 শ্রাবণী দাস

       ৩০.৯.২০২০


ইঁট বের করা পোড়ো মন্দিরের মরচে ধরা রেলিং-এর গা জড়িয়ে মাথা বাড়িয়েছে বেনামি কিছু জংলি লতাপাতা। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে সরু একফালি পায়ে চলার পথ।পথটা গিয়ে মিশেছে ফুল্লরার পাড়ে। ঋতু পরিবর্তনের মতো শরীর বদলায় ফুল্লরা। গ্রীষ্মে শুকনো খটখটে হলেও শ্রাবণে তার সারা শরীর জুড়ে উপচে পরে ভরা যৌবন।আশ্বিনে সে যৌবনে কিছু ঘাটতি দেখা গেলেও , ফুল্লরার শরীর জুড়ে তখন ফুটে ওঠে কাশেদের প্রতিবিম্ব।সাদাটে পালক মাথায় গুঁজে দিনরাত তারা দাঁড়িয়ে থাকে ফুল্লরার পাড়ে ঠিক পাহারাদারের মতো।এই ফুল্লরার পাড়ে গড়ে ওঠা ইঁট ভাঁটার মজদুর দীননাথ কাওরী।মানুষটা দেহাতি। পুরুলিয়া সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডের রাঙামাটি গাঁয়ে মা, ব‌উ আর বাচ্ছা নিয়ে তার পৈতৃক বাস। মরা বাপের রেখে  যাওয়া কিছু জমি নিয়ে ছিল তার অভাবের অথচ সুখের সংসার। মহাজনের মিথ্যে ষড়যন্ত্রে সর্বস্বান্ত হয়ে,  সংসার চালানোর শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে পেটের দায়ে, সবকিছু ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয় ফুল্লরার পাড়ে এই ইঁট ভাঁটায় দিনমজুরের কাজ নিয়ে।


পেটের দায় সত্যিই এক আজব দায়। ইঁট ভাঁটার গনগনে আগুনের তাপে সকাল থেকে শুরু হয় হাড়ভাঙা খাটুনি। মাথায় করে ইঁট বয়ে একটার বুকে আর একটা সাজিয়ে গড়ে ওঠে ইঁটের পাহাড়। দুপুরে সূর্য যখন ফুল্লরার ঠিক মাথার ওপরে নিজের জায়গা করে নেয় তখন মেলে দু'ঘন্টার ছুটি, দু'মুঠো তৃপ্তির ভাত পেটে ফেলে জ্বালা মেটে উদরের‌। এঁটো হাত আঁচিয়ে কাঁধের গামছাটায় মুখ মুছে, কোমরে গোঁজা বিড়িটা ঠোঁটের ডগায় নিয়ে আগুন ধরায় দীননাথ।ইঁট ভাঁটার পাশেই ফুল্লরার কোল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে এক নাম না জানা গাছ। মজদুররা বলে ছাওয়া গাছ। হলুদ চূড়ার মতো দেখতে কিছু মৃত হলুদ ফুলের এই জমিন বিছানায় ইঁট ভাঁটার আগুনে সেঁকা নিজের গরম ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দেয় দীননাথ।

কিছুটা দূরে কয়েক ঘর আদিবাসীদের বাস। হোগলা পাতার দরমার ছাউনি দেওয়া ঘর।

দীননাথ তাকিয়ে দেখে কয়েকটা বাচ্ছা মাটিতে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলছে একমনে। পাশেই খোলা আকাশের নিচে ইঁটের তৈরি উনুনে মাটির হাঁড়িতে ফুটছে ভাত।পোড়া ইঁটের সাথে সাথে বাতাসে ভেসে আসছে ভাত ফোটার গন্ধ। একটি অল্প বয়সী ব‌উ একগলা ঘোমটা টেনে বাসন নিয়ে যাচ্ছে ফুল্লরার দিকে। সেইদিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় দীননাথের।


বিয়ের সময় ষোলো বছরের ছিল শিবানী।

গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও চোখ দুটো বেশ টানা টানা আর মুখটা ছিল ঠিক লক্ষ্মী প্রতিমার ছাঁচে গড়া। শিবানীও সারাদিন মাথায় কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতো, হাজার চেষ্টা করেও দীননাথ সকালে তার মুখ দেখতে পেত না।সে বাজার থেকে নিয়ে আসতো রকমারি টিপ, সারাদিন অপেক্ষা করতো কখন রাত নামবে। রাত নামলে মাথার কাপড় সরিয়ে দীননাথ, শিবানীর কপালে পরিয়ে দিত সেই টিপ। ধীরে ধীরে খুলে যেত শরীরের সমস্ত আবরণ ‌।সে তার ঠোঁট দিয়ে  শিবানীর নগ্ন দেহ জুড়ে ভালবেসে এঁকে দিত আদরের টিপ। মাটির কুঁড়ে ঘরটার ঠিক পেছনে সারি সারি ধানের জমি। রাত্রি হলেই চাঁদটা যেন নেমে আসতো জমিতে। চারিদিক ঝলমল করতো রূপোলি চাঁদের আলোয়।সেখান থেকে একফালি আলো খড়ের চাল চুঁইয়ে, বাঁশের জানলা ডিঙিয়ে ছড়িয়ে পড়তো মাটির ঘরে ,কাঠের   তক্তাপোষ জড়িয়ে থাকা প্রেমের শরীরে।

ঘন ঘন আগুন জ্বলে ওঠে বিড়ির মাথায়।অসাবধানে ছ্যাঁকা লাগে  দীননাথের হাতে। কেটে যায় স্বপ্নের ঘোর।


পড়ন্ত সূর্যের শেষ আলোটুকু মুছে নিঃশব্দে অন্ধকার নেমে আসে ফুল্লরার পাড়ে ।জ্বলন্ত ইঁট ভাঁটার বুকে জ্বলে ওঠে হ্যারিকেন। তার মৃদু আলোতে চলতে থাকে তাস আর দেশী মদের আড্ডা। দীননাথের এইসব ভালো লাগে না। রাতের ডাল, রুটি শেষ করে সে বিছানা পাতে খোলা আকাশের নিচে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে আকাশের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ টাকে। ছেড়া ছেড়া মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে আসা মরা জ্যোৎস্নায় চারপাশের প্রকৃতিকে বড় অচেনা লাগে তার। একসময় শেষ হয় মদের আসর, থেমে যায় সমস্ত কোলাহল, শুধু দূর থেকে ভেসে আসে পাড়ে আছড়ে পরা ফুল্লরার ছলাৎ ছল শব্দ।

দীননাথ তেলচিটে বালিশটার নীচ থেকে ধীরে ধীরে  বার করে স্নেহ, আদর, মায়া আর ভালোবাসা মাখানো একটি চিঠি। দু'চোখ বন্ধ করে নিজের বুকের ওপরে সে জড়িয়ে ধরে চিঠিখানা। চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে ছেড়ে আসা মানুষগুলোর  প্রতিচ্ছবি।


মমতাময়ী মায়ের স্নেহের স্পর্শ, ছেঁড়া গেঞ্জির ভাঁজে ভাঁজে, জোরে জোরে শ্বাস টেনে মা গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে তার সন্তানের গায়ের। দুচোখ উপচে বয়ে যায় জলের ধারা।ওদিকে তিন বছরের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটা ভরা চোখে খুঁজে চলে তার ঘোড়া ঘোড়া খেলার সাথীকে।একজোড়া অভিমানী চোখ নীরবে সরে যায় কুঁড়েঘরের পশ্চিমে কদম গাছের নিচে, কাপড়ের খুঁটে মুছতে থাকে ভিজে যাওয়া চোখের পাতা। পিছন থেকে  ডাক আসে --"বৌমা"। ঘোমটা বেড়ে যায় আর

বিরহ ঢাকা পরে তার নীচে।


ভাবনার অন্তরালে বয়ে যায় রাত।পূব আকাশের কালোর মাঝে ফুটে ওঠে এক চিলতে আলোর রেখা, ফুল্লরার বুকে নেমে আসে নতুন ভোর। কেটে যায় একটা দীর্ঘ রাত। অনেক ভাবনা আসে, দানা বাঁধে আবার ভেঙেও যায়। নাম না জানা গাছের ডালে ডেকে ওঠে ভোরের পাখি। উঠে পরে দীননাথ, বালিশের নিচে চিঠি রেখে গামছায় চোখ মোছে।তারপর হাঁটা দেয় ফুল্লরার পাড় ধরে ইঁট ভাঁটার দিকে।

পেটের দায়ে আবদ্ধ জীবন এভাবেই বয়ে নিয়ে চলে  প্রতি রাতের বহু অসামপ্ত স্বপ্নগুলোকে।


       সমাপ্ত