Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#অন্তরদৃষ্টি#সোমা_ত্রিবেদী
◆( মনে করে নিন আমাদের জীবনে স্মার্টফোন, ফেসবুক, সেলফি ইত্যাদি গত পঞ্চাশ বছর ধরেই আছে।)
আমার সেই কোন ছোটবেলাতেই দুচোখ ঢেকে গেছে ছোট্ট ছোট্ট দুটো কাঁচের আড়ালে। তখন কতই বা হবে বছর দশেক হয়তো। দৃষ্টি শক্তির দূ…

 


#অন্তরদৃষ্টি

#সোমা_ত্রিবেদী


◆( মনে করে নিন আমাদের জীবনে স্মার্টফোন, ফেসবুক, সেলফি ইত্যাদি গত পঞ্চাশ বছর ধরেই আছে।)


আমার সেই কোন ছোটবেলাতেই দুচোখ ঢেকে গেছে ছোট্ট ছোট্ট দুটো কাঁচের আড়ালে। তখন কতই বা হবে বছর দশেক হয়তো। দৃষ্টি শক্তির দূর্বলতা বংশানুক্রমিক কিনা তা জানিনা তবে বংশে অনেকেরই ছোট বয়েসে এমন চশমা যোগ হয়েছে।


প্রথম প্রথম কারো সাথে কথা বলার সময় বেশ একটা কেমন বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে চশমাটা তর্জনীর আলতো চাপে নাকের আর একটু উপরে ঠেলে দিতাম। কখনও বা কায়দা মেরে তাকে কপালে তুলে ধরতাম। কিন্তু কিছু বছরেই ধীরে ধীরে মোহ ভঙ্গ হতে লাগল। মনে হলো যেখানে যতো সাহিত‍্য আছে সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে সুন্দর চোখের মায়াজালে হাবুডুবু খেয়েছেন লেখক কুল, কই কেউতো চশমা আঁটা বিজ্ঞ দৃষ্টির এক কণাও উল্লেখ করেনি কোথাও। তারওপর দিন রাত চোখে চশমা পরে পরে চোখের তলায় দু পোঁচ করে কালি লেপ্টানো যেন। সত্যিই কেমন যেন চশমাটার প্রতি বৈরাগ‍্য জন্মাতে লাগল। যাকে নিজের শরীরের অঙ্গ ভাবতাম তাকে এখন পরতে হয় তাই পরি। কেবল সেটা হারাতে লাগল, কোথায় যে রাখি খুঁজেই পাইনা। কখনও বা চোখে পরেই জম্পেশ খুঁজে চলেছি তো কখনও তাকে পকেটে গুঁজে বাড়ি ময় খুঁজছি আর সকলের ওপর হম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছি।


একটা সময়ের পর আমার বিশেষ মানুষটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো ফলতো কিছু বছরের মধ্যেই শুভদৃষ্টিও হলো। যৌতুকে চশমাখানি ব‍্যাগে ভরে নিয়ে এলাম। আমার তিনি একদিন সখ করে নতুন একটি সুন্দর ফ্রেমের চশমা গড়িয়ে দিলেন। ডেলিভারীর দিন আমি সঙ্গে গেলাম চোখে পরে দেখে আনতে। চোখে দিতেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটলো, আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম দোকানি মনে মনে ভাবছে, 'ওইতো পেঁচির মতোন দেখতে তার চোখে এমন সুন্দর চশমা! চশমাটাই নিজের সৌন্দর্য খোয়ালো।' আমি বারকতক চশমাটা খুলে পরে দেখলাম। যতোবার পরি যার দিকে তাকাই যেন তার মনের গভীর দেখতে পাই। খুব ভয়ে ভয়ে আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বরের দিকে তাকালাম, 'সে ভেতর থেকে একটু বিরক্ত সামান্য চশমা ডেলিভারী নিতে এসে আধঘন্টা হয়ে গেছে।'


আমি চশমাটা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ঠিকই পরতে কিছুতেই সাহস পাচ্ছিনা। বাড়িতে জা ভাসুর শ্বশুর শাশুড়ি ননদ সবাই আছে। আবার যদি আমার অন্তরদৃষ্টি খুলে যায়, না না থাক আমার পুরোন চশমাই ভালো। এদিকে ননদ বলল, কইগো বৌদি তোমার নতুন চশমাটা পরো, সেই পুরোন পরেই ঘুরছো কেন? জাও বলল চশমা কি তুলে রাখার জিনিস ছোট তুই পরতো দেখি তোকে কেমন মানায়। অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে চোখে দিলাম, জা ননদ দুজনেই মুখে কি দারুণ মানিয়েছে বলল বলে আমি সাহসে ভর করে চোখ দুটো স্বচ্ছ কাঁচের পিছনে খুললাম, উফফফফ আবার সেই ঘটনা, আমি স্পষ্ট জায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের কথা শুনতে পেলাম, ও মনে মন বলছে, 'নতুন নতুন এমন অনেক সোহাগ থাকে দেখব কেমন প্রেম থাকে সংসারে নাকানি চোবানি খাওয়ার পর।' ননদ মনে মনে ভাবছে, 'ছোড়দাকে  কলেজে ওঠার পর একটা সানগ্লাস কিনে দিতে বললাম, তখন দিলনা এখন বউকে দামি চশমা কিনে দিল।'

জা ননদ জোর করে চশমা পরা আমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলল ফেসবুকে দেবে বলে। ওরা দুজনে কি সুন্দর মিষ্টি হেসে ছবি তুললেও আমার মুখের হাসি যেন একদম মুছে গেছে। ননদ ফেসবুকে আপলোড করে ক‍্যাপসান দিল, 'মা ভিন্ন ভিন্ন হলেও আমরা তিন বোন' হ‍্যাসট‍্যাগ স্বচ্ছ দৃষ্টি। কি যে বলি, ওপর ওপর সবকিছুই বেশ ভালো লাগলেও সামান্য চশমাকে কেন্দ্র করে ওদের মনের কথা গুলো শুধুই আমি জানি।


রাতে আমার বর বাড়ি ফিরলে তাকে সবটা বলেই ফেলি ভয়ে ভয়ে। তখনও চোখে আমার সেই চশমা। ও অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, আর মনে মনে ভাবছে, 'এই রে দু চার বছর প্রেম করে সত্যিই মানুষ চেনা যায় না এর সংসারের চাপে নির্ঘাত মাথাটা বিগড়ে গেছে।' আমার দুটো চোখ জ্বালা দিয়ে কান্না পেল। মুখে কিছু না বলে নিজের চোখের চশমাটা খুলে ওর চোখে পরিয়ে দিলাম। এবার ও আমার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলে উঠল, 'আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি এই কথা তোমাকে কে বলল?' আমি দু চোখ ভরা জল নিয়ে বললাম, আমি একটা কথাও বলিনি, তাও তুমি শুনতে পেয়েছ আমার মনের কথা ওই চশমাটার জন্য। ও চশমাটা খুলে বাক্সয় রেখে বলল এটা আর পোরোনা এটা পরলে সম্পর্ক নষ্ট হবে যা বুঝছি। কদিন পুরনোটাই পরে কাজ চালাও, সামনের মাসে অন্য একটা কিনে দেবো।


সেই থেকে চশমাটা আমার আলমারিতে পড়েই ছিল। দরকারি জিনিস সামনের সারি দখল করতে থাকে দিন বদলের সঙ্গী হয়ে, আর চশমাটা পিছতে পিছতে আলমারির সবথেকে নিচের তাকের একদম কোণায় গিয়ে ঠাঁই নেয়। বছর বছর অদরকারি জিনিস বাতিল করা আমার স্বভাব। তবুও প্রাণে ধরে চল্লিশ বছর আগের সেই চশমা খানা আজও বাতিলও করতে পারিনি, আবার চোখে পরে দেখার সাহসও সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি।


 পরিবারের অনেক সদস্য এখন নেই এর তালিকাভুক্ত। আমার ছেলেও এবার এই বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকায় ফ্ল‍্যাট কিনে বৌমা নাতি ও আমাকে নিয়ে চলে যেতে চাইছে। তাই আলমারি থেকে আমার প্রয়োজনের জিনিস গোছানো চলছে, হঠাৎই হাতে এলো সেই চশমাটা। কি মন হতে বহু বছর পর বাক্স খুলে তাকে নিজের চোখে পোরলাম, একি এ আমি কি বুঝতে পারছি, ছেলে আমার দায় থেকে মুক্তি পেতে চেয়ে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে দেওয়ার পাকা ব‍্যবস্থা করেছে। আমাকে ভুল বুঝিয়ে বাড়ির কাগজে সই করাতে চলেছে। নাহ, আর এ চশমা চোখ থেকে খোলা যাবে না। আমি চুপিচুপি জা ননদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, অনেক অশান্তি শেষে বাড়িটা বিক্রি হলো ঠিকই ফ্ল‍্যাট ও কেনা হলো বাকি হাতে থাকা টাকা নিয়ে আমিও উঠলাম বৃদ্ধাশ্রমে নিজের ইচ্ছায়।


 আমার জাও আমার পাশের ঘরের বাসিন্দা ঠিক বিয়ের পরের মতই। ওর একটিই মেয়ে যে প্রবাসী। সেদিনের সেই ছোট্ট ননদ আজকের ঘোর সংসারী। সংসার সামলে মাঝে মাঝেই আসে দেখা করে যায়। খুব আড্ডা জমে আমাদের। আমরা যে সত্যি সত্যিই তিন বোন তিন ভিন্ন মায়ের গর্ভের। আমার চশমাটার কথা ওদেরকে বলেছি। আমার জা ওটা ভেঙে ফেলে দিয়েছে। আজ যে আমার অন্তরদৃষ্টির প্রয়োজনিয়তা শেষ।

                 ___________________