অতঃ শ্রীপণ্ডিত কথামনসিজ (দিব্বান গুহ)(একটি শ্লেষ্মাত্মক নিবন্ধ)
জগতে পণ্ডিতের অভাব নেই। তাঁদের পাণ্ডিত্যের পরিধিও বহুদূর বিস্তৃত। এই পণ্ডিতেরা তাঁদের মহান কীর্তি দিয়ে নানাভাবে জগতের হিত সাধন করেছেন, সমাজকে সম্বৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু …
অতঃ শ্রীপণ্ডিত কথা
মনসিজ (দিব্বান গুহ)
(একটি শ্লেষ্মাত্মক নিবন্ধ)
জগতে পণ্ডিতের অভাব নেই। তাঁদের পাণ্ডিত্যের পরিধিও বহুদূর বিস্তৃত। এই পণ্ডিতেরা তাঁদের মহান কীর্তি দিয়ে নানাভাবে জগতের হিত সাধন করেছেন, সমাজকে সম্বৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সমান্তরাল একটি শ্রেণী আছে। এরা কারা? এই শ্রেণীটির নাম হলো "শিয়াল পণ্ডিত শ্রেণী"। আসুন, এদের গল্প শোনা যাক।
প্রথমে আমরা দেখি এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি। তারপর দেখবো এদেরকে চেনার উপায়গুলিকে।
এই শিয়াল পণ্ডিত শ্রেণীভুক্ত যারা, তাদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো -- পরের বিষয়ে অকারণ নাক গলিয়ে তাদের ভুল ধরার এক মরিয়া চেষ্টা করা। এদের নিজেদের মাথার চুল থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত আদ্যন্ত ভুল ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ না আছে সেদিকে নজর, না আছে সে বিষয়ে জ্ঞান, না লজ্জা। পাণ্ডিত্যের কি সুন্দর নমুনা না এটি?!
এদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে -- উপযাচক হয়ে জ্ঞান দেওয়া। শুধু ভুল ধরেই এদের পেট ভাত হজম হয় না! নিজেদের "অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার"কে এরা একটা ঝোলার মতো নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরছে। ফুসফুসের ছবি দেখেছেন? মানুষের ফুসফুসের? সেই রকম এক ঝোলা। কিন্তু ফুসফুসে অনেক ছিদ্র থাকে যা দিয়ে অক্সিজেন, মানে প্রাণবায়ু, যাওয়া-আসা করে। এদের সেই জ্ঞান-ঝোলাও তেমনি অসংখ্য "ছিদ্র" যুক্ত। এরা সেই ঝোলা নিয়ে যখন-তখন আপনার মাথায় চাপিয়ে দেবে বা দেওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ এদের বিশ্বাস, এদের সেই বইসর্বস্ব স্থূল, ভোগবাদী জ্ঞান, যা মানুষকে ধ্বংসের অতলে তলিয়ে নিয়ে যায়, সেই অকিঞ্চিতকর জ্ঞান, ওই ঝোলার ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টিধারা মতো আপনার মাথায় ঝরে পড়বে, আর আপনি সেই জ্ঞানধারায় সিঞ্চিত হবেন এবং অন্য সবকিছু ভুলে সেই শিয়াল পণ্ডিতের মহিমা কীর্তনে নিজের অমূল্য সময় অকারণে ব্যয় করবে। আপনি "অতি-বোধে" সেই পবিত্র কাজটি করতে শুরু করলেই এদের হাবভাব এমন হয়ে যাবে – যেন এইসব মহান কাজ করার জন্যেই এদের জন্ম হয়েছে, যেন এইভাবে এরা জগৎকে "উদ্ধার" করে দিচ্ছে!
কিন্তু যদি আপনি এদের পাত্তা না দেন, তাহলে এদের ফানুস ফেটে যাওয়ার ভয়ে দেখবেন অযৌতিক যুক্তির অবতারণা করে অবান্তর তর্ক বাধাবে। আপনি বিরক্ত হবেন। হয়তো সেটা বুঝিয়েও দেবেন। তবুও হাল ছাড়বে না। এরাই হলো শিয়াল পণ্ডিত।
এদের বিপরীতে রয়েছেন প্রকৃত জ্ঞানীরা। তাঁরা ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকেন। সহজে সাধারণের চোখে পড়েন না। যথার্থ জ্ঞান পিপাসু কেউ নিবিড়ভাবে যদি এঁদের খোঁজ করেন, তবেই এঁদের খোঁজ পাবেন। এঁরা নিজের থেকে গলা বাড়িয়ে কাউকে জ্ঞান দিতে আসেন না। কিন্তু জিজ্ঞাসু কেউ শেখার উদ্দেশ্যে জানতে চাইলে, তার কাছে উজার করে দেন নিজের জ্ঞানের ঝুলি। কিন্তু আমরা আজকাল সত্যিকারের জ্ঞান সন্ধান করি কি? করলে কি শিয়াল পণ্ডিতদের দাপট এতো বাড়তে পারতো?
কিন্তু বাস্তব অবস্থা এটাই যে শিয়াল পণ্ডিতদের নির্লজ্জ তাণ্ডবে সমাজে-সংসারে সুস্থভাবে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। তাই সময় হয়েছে শিয়াল পণ্ডিতদের বিশেষভাবে চিনে নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বর্জন করা, যাকে বলে -- একেবারে একঘরে করে দেওয়া।
মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে অনেক কথা বলা হয় সব জায়গায়। কিন্তু সেই অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ যে এই শিয়াল পণ্ডিতদের মূঢ় পাণ্ডিত্যের প্রদর্শন -- সেই সত্যিটা বুঝে নিয়ে এদের কোণঠাসা করতে না পারলে সমাজকে রক্ষা করা অদূর ভবিষ্যতে সত্যিই অসাধ্য হয়ে উঠবে।
(নিবন্ধটি বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়নি। কেউ ব্যক্তিগত ভাবে নিলে, তার দায় লেখকের নয়।)