#বাপেরবাড়ি এবং প্রবাসের কালীবাড়ি#গল্প নয়, গল্পগাছা#সুস্মিতা
("মা" এমনভাবেই বারেবারে এসো)
আচ্ছা মা দুর্গা কি বাঙালি ছিলেন? আর মা কালী? উত্তরটা আমার সঠিক জানা নেই। সেসব অনেক গবেষণার ব্যাপার।
তবে প্রবাসের মাটিতে দুর্গা মা…
#বাপেরবাড়ি এবং প্রবাসের কালীবাড়ি
#গল্প নয়, গল্পগাছা
#সুস্মিতা
("মা" এমনভাবেই বারেবারে এসো)
আচ্ছা মা দুর্গা কি বাঙালি ছিলেন? আর মা কালী? উত্তরটা আমার সঠিক জানা নেই। সেসব অনেক গবেষণার ব্যাপার।
তবে প্রবাসের মাটিতে দুর্গা মাকে আবাহন করার জন্য মা কালী বা অন্যভাবে বলতে গেলে প্রবাসের কালীবাড়ি কি ভূমিকা পালন করে সেই গল্প একটু বলি ...
হ্যাঁ,আজকের লেখা নিতান্তই গল্পগাছা ...
স্বামীর এবং নিজের কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো ও বসবাসের সুযোগ আমার হয়েছে। আর এখন তো আমরা পাক্কা প্রবাসী।
প্রবাসে ও বিদেশে বসবাসকারী প্রায় সমস্ত বাঙালির মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমি প্রায় সর্বত্র টের পেয়েছি, সেটি হল- "শরৎকাল এসে গেলেই কলকাতার জন্য, বাংলার জন্য তথা বাঙালিয়ানার জন্য বড্ড মনকেমন করা ও স্মৃতিকাতরতায় ভোগা।"
পুজোর ঠিক আগে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসগুলোতে মনটা যেন কেমন মাতাল, কেমন আকুল হয়ে ওঠে। সারাক্ষণ মনে হয় এই বুঝি দেশে কাশফুল ফুটলো, আকাশের রংটা নিশ্চয় ইতিমধ্যে তরুণ সন্ন্যাসীর দৃষ্টির মতো উজ্জ্বল, রাস্তার ধারের সেই শিউলি গাছগুলো...ওরা আজকাল ভোর হতে না হতেই ফুটপাথের ওপরে কার্পেট বিছিয়ে দিচ্ছে। এই বুঝি মা, দিদি, বৌদি, বন্ধুরা কেনাকাটা শুরু করেছে। শ্রী লেদার্স এর সামনে নিশ্চয় বিশাল লম্বা লাইন, গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, নিউমার্কেটের গন্ধ হাওয়ায় ভেসে এসে পরবাসী মনকে আরও উতলা করে দেয়। আজকাল তো আবার বর্ষা যেতে না যেতেই টেলিভিশন, ফেসবুক ওয়াটসঅ্যাপে ছবি আসতে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে গেল খুঁটিপুজো, মণ্ডপবাঁধার কাজ। কুমোরটুলিতে কেমনভাবে মাটির তাল থেকে তিল তিল করে মৃন্ময়ী রূপ নিচ্ছেন ...
এইসব দেখতে দেখতে প্রবাসে বা বিদেশে মনের মধ্যে যে ঠিক কি হতে থাকে, তা বলে বোঝানো কঠিন।
পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ছিন্নমূল বাঙালির এই মনোবেদনা লাঘব করতে সব থেকে বড় ভূমিকা কে পালন করে জানেন?
প্রবাসের বা বিদেশের কালীমন্দির। কিভাবে?
একটু ব্যাখ্যা করে বলি - সদ্য বিয়ের পরে বাপেরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে একটি মেয়ের বুকের ভেতরটা ঠিক যেমন করে...মা বাবা ভাইবোনকে একটু দেখার জন্য, পুরোনো শৈশব কৈশোরের দিনগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য, ঠিক তেমনই নিজের রাজ্য বা দেশ থেকে দূরে থাকতে থাকতে এক একটা দিন মানুষ বড় এলোমেলো হয়ে যায়।
কোনো কোনো মনকেমনকরা দিনে যখন একটু বাংলাভাষায় কথা বলার জন্য, আড্ডা দেওয়ার জন্য বুকের ভেতরটা ছট্ফাটিয়ে ওঠে, যেদিন খুব দেখতে ইচ্ছে করে শাড়ি বা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত কিছু বাঙালিকে, তখন প্রথমেই খুঁজে বের করতে হয় একটি "প্রবাসীদের কালীবাড়ি"। নতুন বিয়ের পরে বাপেরবাড়ি গিয়ে চেনা মানুষগুলোকে কাছে পেয়ে ঠিক যে অনুভূতি হয়, প্রবাসের কালীবাড়ি ঠিক সেই আনন্দটা ফিরিয়ে দেয়...
এই কালীবাড়িতে শনিমঙ্গলবারের সন্ধ্যায় পাওয়া যাবেই বেশ কয়েকজন মনকেমনকরা নির্বাসিত বাঙালিকে। তাদের মধ্যে যারা নতুন তাদের চোখের কিছুটা ভীতু, কিছুটা লাজুক দৃষ্টির মধ্যে থাকবেই গভীর বন্ধুত্বের হাতছানি...সবাই মনে মনে বন্ধু খুঁজছে যে।
এমনকি পুরনো প্রতিষ্ঠিতরাও প্রবাসে সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাগুরু হওয়ার আনন্দে দুবাহু বাড়িয়ে নতুনদের আপন করে নেবেন।
এইসব পুরনো প্রবাসী দাদাবৌদিদের কাছেই খোঁজ পাওয়া যাবে "শহরের শ্রেষ্ঠ মাছের বাজারটির।" কোথায় গেলেই বা পাওয়া যাবে পোস্ত, কালোজিরে অথবা ডালের বড়ি? কিম্বা এই শহরে আছে কি কোনও "বিজলী গ্রীলের" শাখা?অথবা "ওহ্ ক্যলকাটা"?
সবথেকে বড় কথা হল- এই কালীমন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে এই সমস্ত নতুন বন্ধুদের সাথে যে টেলিফোন নম্বরগুলি আদানপ্রদান হয়, প্রবাসের যে কোনো বিপদের দিনে সেই নম্বরগুলিই কোনও প্রবাসীকে একা অসহায় হতে দেয়না।
অর্থাৎ, এইভাবে সত্যিসত্যিই জীবনে পাওয়া যায় কিছু বন্ধু। গোটা জীবন শুধু কলকাতায় পড়ে থাকলে যা হয়ত কোনোদিনই পাওয়া সম্ভব হতনা ....
ধীরে ধীরে এই কালীমন্দির প্রাঙ্গণে শুরু হয় বাংলার শিল্পসংস্কৃতি তথা বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখার যাবতীয় কর্মকাণ্ড। জন্ম নেয় বাঙালির নিজস্ব সাহিত্যসংগঠন, নাটকের দল...থিয়েটার গ্রুপ।
আর সব থেকে বড় ব্যাপার- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা মিলে এক হয়ে এই মন্দির প্রাঙ্গণ থেকেই শুরু করে তাদের সব থেকে বড় উৎসব দুর্গা পুজো, প্রবাসের মাটিতে...
তারপর, দু এক বছরের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখতে হয়, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা প্রবাসী ছেলেমেয়েরা কি উৎসাহভরে পালন করছে বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী আর দুর্গা পুজোর জলসা। দেশে থাকলে শহুরে জীবনে ওদের পয়লা বৈশাখ হয়ত বা "একলা বৈশাখ" হয়েই কেটে যেত। আর দূর্গা পুজো হত শুধুই বারোয়ারী মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন, যে যার মতো একা একা...কে জানে ...
এইভাবেই প্রবাসের কালীবাড়ি এবং মা কালী প্রতি বছর মা দুর্গাকে বরণ করে ঘরে নিয়ে আসেন...তখন আমরা পরবাসের সব দুঃখ ভুলে যাই। কালীবাড়িই তখন আমাদের সকলের এবং স্বয়ং মা দুর্গার বাপেরবাড়ি।
এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়।
"মা আসছেন"- সকল অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে মানুষের মঙ্গল, পৃথিবীর মঙ্গল, প্রকৃতির মঙ্গল সাধন করতে মা আসছেন...আর মাত্র কয়েকটা দিন...
যদিও এই বছরটা সবদিক থেকেই বড্ড আলাদা। অতিমারী পুরো পৃথিবীর সব উৎসবের ছবিই অন্যরকম করে দিয়েছে। তবুও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে- "মা এই বছরও আসছেন, আবার পৃথিবীর মঙ্গল সাধন করতে মা ঠিক আসছেন। এই বছর পুজোর উৎসব নাই বা হোক, পুজো হোক অন্তরে, মানুষের মনের ভিতরে। যদি উৎসব করতেই হয়, তবে সেই উৎসব হোক সঠিক চিকিৎসার উৎসব, মানবসেবার উৎসব, প্রকৃত শিক্ষার এবং সর্বোপরি অহিংসার উৎসব।"
*********