#লাঠি#সোমা_ত্রিবেদী
মেরোনা, মেরোনা আমাকে, প্লিজ মেরোনা....
অনিকেত চেয়ে দেখো, দেখো আমার দিকে, আমি তোমাকে মারবো কেন? এটা ঝুলঝাড়া, ঝুলঝাড়া দিয়ে কেউ মারে? আর তাছাড়া তোমাকে আমার মারার প্রশ্নই বা আসছে কেন?
দুহাতে নিজের মাথাটা আড়াল করে কাঁ…
#লাঠি
#সোমা_ত্রিবেদী
মেরোনা, মেরোনা আমাকে, প্লিজ মেরোনা....
অনিকেত চেয়ে দেখো, দেখো আমার দিকে, আমি তোমাকে মারবো কেন? এটা ঝুলঝাড়া, ঝুলঝাড়া দিয়ে কেউ মারে? আর তাছাড়া তোমাকে আমার মারার প্রশ্নই বা আসছে কেন?
দুহাতে নিজের মাথাটা আড়াল করে কাঁপছে তখনও, ফেলে দাও ওটা, শিগগির ফেলে দাও, আমি জানি তুমি আমাকে মারবে।
আচ্ছা, আচ্ছা, এই নাও ফেলে দিলাম নাও, বলে হাতের ঝুলঝাড়াটা বাগানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো উর্মী। আমি কি তোমাকে মারতে পারি? আমি তোমার বউ, তোমাকে এতো ভালোবাসি, তাও তোমার এমন মনে হলো অনিকেত? স্বামীর কাছে গিয়ে গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো উর্মী। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। স্নান খাওয়া সেরে অফিসে চলে গেল।
অনিকেত অফিসে বেরোতেই উর্মী বাবাকে ফোন করে সকালের সব ঘটনা জানালো। সব শুনেই আশিস বাবু চটে উঠলেন মেয়ের ওপর, তখনই বারণ করেছিলাম, অনাথ আশ্রমে বড়ো হওয়া ছেলেকে বিয়ে করিসনি। ছোটবেলা কার কেমন কেটেছে, কে কোন ফ্যামিলি থেকে এসেছে ঈশ্বরই জানেন। তা নয় ভালো ছেলে, বাবা বিশ্বাস করো, অনিকেত খুব ভালো ছেলে... বলে বলে, নিজের মাথাটাতো তোর গেছিলই আমার মাথাটাও খেলি। আর বিয়েও করলি। নাও ভোগো। এসব ডিসঅর্ডার নাকি কে জানে।
উর্মী বাবার উদ্বেগ অনুভব করতে পারলেও অনিকেতের নামে এসব শুনতে ভালো লাগছিল না। চুপচাপ ফোন কেটে দিল। এটা তো সত্যিই ও খুব ভালো একটা মানুষ, অত্যন্ত ভালো ছিল পড়াশোনাতে। স্কলারশিপ পেয়েছে সারাজীবন লেখাপড়ার জন্য। এখনো আশ্রমে প্রতি সপ্তাহে যায়, সেখানে বাচ্চাদের সুবিধা অসুবিধা দেখে, খরচ করে। একজন অত্যন্ত ভালো যত্নবান স্বামী। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। এই বয়েসেই কোলকাতার বুকে নিজস্ব বাড়ি করেছে, গাড়ি কিনেছে। আর কি চাই।
অফিস থেকে ফিরলে চা জলখাবার পর্ব মিটলে উর্মী শান্ত মনে আবার ঝুলঝাড়ার প্রসঙ্গটা তোলে। অনিকেত এড়িয়ে যেতে চায়। তবুও উর্মী চেপে ধরলে, সে রাগ দেখিয়ে বলে আমি এই নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। শুধু বাড়িতে লাঠি জাতীয় কিছু রেখোনা, আমার খুব ভয় করে।
উর্মী স্বামীকে বোঝাতে না পেরে নিজেকেই বুঝিয়ে শান্ত করে যে, থাকগে যখন বলতে চাইছে না তখন থাক, বিয়ে যখন হয়েছে তখন আজ না হলেও কাল ঠিকই বলবে। আর লাঠি এ আর এমনকি ব্যাপার, নাহয় লুকিয়েই রাখবো, যখন ও বাড়িতে থাকবেনা তখন নাহয় ঝুলটুল ঝাড়বো।
অচিরেই বোঝা যেতে লাগলো সমস্যা শুধু ঝুলঝাড়া নয় আরো আরও বড়ো আকারের। সেদিন বাগানের পেয়ারা গাছ থেকে আঁকশি দিয়ে অনিকেতকে লুকিয়েই ছুটির দুপুরের দিকে পেয়ারা পাড়ছিল, হঠাৎই অনিকেত গল্পের বই হাতে বাগানের চেয়ারে বসতে এসে দেখে উর্মীর হাতে আঁকশি। সেই একই আচরণ বইটই ছুঁড়ে নিজের মাথা আড়াল করে ভয়ার্ত চিৎকার, মেরোনা, আমাকে মেরোনা, আমি কিছু দেখিনি, আমাকে মেরোনা। উর্মী তখন সন্তান সম্ভবা। তাড়াতাড়ি আঁকশি ফেলে স্বামীর কাছে এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ওকে বোঝায়, তবে একটু শান্ত হয়।
এতোকিছুর পরেও অনিকেতের মুখ থেকে কোনও কথা বার হয় না। কি কারণে এই ভয়। যথা সময় উর্মীও অনিকেতের একটি সুস্থ শিশু পুত্রের জন্ম হয়। ছেলের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবসময় অনিকেতের একটা অতিরিক্ত আগলে রাখার প্রবণতা চোখে পড়তো। উর্মী মনে করতো, নিজে অনাথ জীবন কাটিয়েছে তাই হয়তো এমন করে। প্রতি মুহূর্তে স্ত্রীকে বলতে থাকে ছেলেকে মারবেনা। ও যতোই দোষ করুক।
স্ত্রী সন্তানকে সব সময় অনিকেত চাইতো সুখের চাদরে মুড়ে রাখতে। সময় সুযোগ মতো ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, ছেলের সঙ্গে খেলা করা সর্বপরি ছেলেকে সব সময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করতো। উর্মী এমনিই একদিন আব্দার করে চলো ছেলেকে নিয়ে পুরী ঘুরে আসি। অনিকেতও রাজি হয়ে যায়।
তিনজন হৈহৈ করে পুরী ঘুরতে যায়। বালি, সমুদ্র, নোনাজল, চিল্কা মন্দির, খাজা ইত্যাদি মিলে বেশ ভালোই কাটছিল। তাল কাটল কেনাকাটা করতে গিয়ে। আশ্রমের সকলের জন্য টুকটাক উপহার উর্মী ও ওর মায়ের শাড়ী আশিস বাবু ও অনিকেতের পাঞ্জাবী অবধিও ঠিক ছিল। ছেলের জন্য কাঠের খেলনা কিনতে গিয়েই যতো গোল বাঁধলো। ছেলের খুব ইচ্ছে ওই রঙিন লাঠি কেনে। অনেক বুঝিয়ে সেই মুহূর্তে ছেলেকে পরাস্ত্র করা গেলেও সারাক্ষণ গোঁজ মেরে রইল। কিছু খেতেই চায়না ছেলে। শেষে ছেলের জেদে বাধ্য হয়ে উর্মী অনিকেতকে লুকিয়ে একটা লাঠি কিনে দেয়। আর ছেলেকে বারবার বোঝায় যাতে বাবা কিছুতেই যেনো দেখতে বা জানতে না পারে লাঠির কথা। ছেলেও মেনে নেয় মায়ের এইটুকু চাহিদা।
পুরীতে দিন সাতেক হুল্লোড় করে কাটিয়ে, লাঠিটিকে ব্যাগের সবচেয়ে নিচে লুকিয়ে বাড়িতে আনে মা ছেলে। ফিরে আসার পর আশ্রমে গিয়ে তিনজন মিলে আবাসিকদের জন্য আনা উপহার সামগ্রী তুলে দেয়। উর্মীর মা বাবার জন্য আনা উপহারও একদিন গিয়ে দিয়ে আসে ওরা। ধীরে ধীরে ব্যাগ ফাঁকা করে পরিচ্ছন্ন করতে থাকে উর্মী। তখনই বেরিয়ে আসে ছেলের সেই লাঠি। লাঠি হাতে পেয়ে সারাদিন খুব খেলে। কখনও নানচাকুর কায়দায় হাত ঘোরানো তো কখনও তলোয়ারের মতো চালানো। উর্মী ছেলেকে বারবার সাবধান করেছে, বাবা যেন লাঠি না দেখতে পায়। মনে আছে তো বাবা লাঠি কিনতে বারণ করেছিল। বাবা অফিস থেকে ফিরলেই লাঠি লুকিয়ে রাখবে কিন্তু। ছেলেও প্রতি মুহূর্তে হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছে। প্রাপ্তির আনন্দ হয়তো শিশুর ক্ষেত্রে সবকিছু ভুলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
বাবা অফিস থেকে ফেরার পর বাবার সঙ্গে খানিকটা ফুটবল খেলা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাবা ক্রিকেট পছন্দ করেনা সেটা ছেলে জানে। কিন্তু আজ কিছুতেই ফুটবলে মন লাগছেনা। আজ যে একটা নতুন খেলা আছে। ব্রুসলীর মতোন খেলা, আজ যে সেটাই খেলতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎই সব ভুলে দরজার ফাঁকে লুকিয়ে রাখা লাঠিটা নিয়ে বাবার সামনে তলোয়ার ঘোরানোর কায়দায় চালাতে লাগলো ছেলেমানুষী খেয়ালে।
অনিকেত অার্ত চিৎকার জুড়লো মেরোনা, মেরোনা আমাকে, আমি সত্যি বলছি কাউকে কিচ্ছু বলবোনা। আমাকে মেরোনা। মেরোনা মেরোনা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল যতোক্ষণে উর্মী রান্না ঘর থেকে বিপদ টের পেয়ে ছুটে এলো।
উর্মী আশিস বাবুর তৎপরতায় নার্সিংহোমে ভর্তি করা হলো অনিকেতকে। সেখানে সবটা উর্মী জানাতেই একজন মনোচিকিৎসাবিদ এসে দেখলেন অনিকেতকে। ওনার অনেক বোঝানোর পর সাহস করে ধীরে ধীরে মুখ খুলল অনিকেত!
- আমি বললে, ওরা আমাকেও মেরে ফেলবে
- না তোমাকে কেউ মারব