Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#ডিঙ্কু সেপাই********************#চিত্রাভানু সেনগুপ্ত
দেখতে দেখতে বর্ধমানের চক্রবর্তী বাড়ির পুজোটা এবছর আড়াইশো বছরে পড়লো। কথিত আছে তখনকার জমিদার নন্দদুলাল চক্রবর্তী প্রথম এই পুজোটা সূচনা করেছিলেন। কালচক্রে জমিদারি প্রথা, তা…


 #ডিঙ্কু সেপাই

********************

#চিত্রাভানু সেনগুপ্ত


দেখতে দেখতে বর্ধমানের চক্রবর্তী বাড়ির পুজোটা এবছর আড়াইশো বছরে পড়লো। কথিত আছে তখনকার জমিদার নন্দদুলাল চক্রবর্তী প্রথম এই পুজোটা সূচনা করেছিলেন। কালচক্রে জমিদারি প্রথা, তার অস্তিত্ব কিছুই যদিও এখন আর অবশিষ্ট নেই, তবে বনেদি পরিবারের ঐতিহ্য আর রীতি রেওয়াজ মেনে খুব ঘটা করে প্রতিবছর দুর্গা পূজার আয়োজন আজও রয়ে গেছে। বাড়ির উত্তরসূরিরা হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই প্রায় দেশে বিদেশে কর্মসূত্রে স্থানান্তরিত। এই পুজোর কটা দিন পরিবারে সকলে যে যেখানেই থাকুন ছুটে চলে আসেন বাড়ির পুজোতে সপরিবারে একসাথে মজা করতে। শোনা যায় প্রতি বছর রথের দিনেই নাকি দুর্গা মুর্তির কাঠামোতে প্রথম মাটি পড়ে, কাজেই রথের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পূজার প্রস্তুতি। বর্তমান ওই বিশাল জমিদার বাড়ি, ঠাকুর দালান, ভোগের জন্য আলাদা রন্ধনশালা, সকলে একসাথে বসে খাবার বিরাট হলঘর আর এই সুবিশাল বাড়ির প্রতিটি কোনায় তার আভিজাত্যপূর্ণ বনেদিয়ানার ছাপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন পরিবারের এক উত্তরসূরি শ্রীযুক্ত পঙ্কজ চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী আশালতা দেবী।পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ হিসাবে তাঁদের কথা ও সম্মানকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেন পরিবারের সকলেই। 


      আশালতা দেবী সাক্ষাৎ অন্নপুর্ণার মত তাঁর স্নেহের ছত্রছায়ায় একই সুত্রে বেঁধে রেখেছেন পরিবারের সকলকে। পরাম্পরা ও তার আচার অনুষ্ঠান সম্বন্ধে সদা সর্বদা তার সজাগ দৃষ্টি । তাই তিনি রথের সময় থেকে পরিবারের সকলকে চিঠি পাঠিয়ে পুজো প্রস্তুতির খুঁটিনাটি জানিয়ে মতামত নেন , কাকে কখন কোথায় উপস্থিত থাকতে হবে সেই বিষয়ে সকলকে জানিয়ে আগে থেকে সতর্ক করে রাখেন। এবছরে কলকাতাবাসী বড় ভাসুরপো সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তীর হাতে যখন চিঠিটা এসে পৌঁছালো,ছোট্ট রিভুর তখন সেই চিঠি পড়ার আর তর সয়না। বলল.....


__"বাপি!! ইয়েএএ ইয়েএএ দেখো ছোট্ ঠাম্মির চিঠি। পড়না বাপি পড়ওও। আর ঠাম্মিকে জানিয়ে দাও আমার এবার ডিঙ্কুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।"


__"ডিঙ্কুকে? সে কি করে হয়? ওরা কেউ ডিঙ্কুর ব্যপারে জানে না। তারপর কারো কোন অসুবিধা হলে?? না, না!! পুজোর কটা দিন বরঞ্চ আমরা ওকে একটা ক্রেসে রেখে যাবো।"


__"উফ্ বাপি, ওকে রেখে গেলে ও খুব কষ্ট পাবেনা? তুমি তো বল ও আমাদেরই একজন, তাহলে? তাহলে ও কেন যেতে পারবে না?"


এমন অনেক বাকবিতণ্ডার পর স্থির হল, ছোট্ ঠাম্মিকে রিভু নিজের ফোন করে সম্মতি নেবে, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। কথামত রিভু তক্ষনি ফোনটা নিয়ে বসলো, ওইযে কথায় আছে, উঠলো বাই তো কটক যাই আর কি!! ধৈর্য্যের বড় অভাব। এরপর দীর্ঘক্ষণ চলল ছোট ঠাম্মির সাথে তার খোশগল্প। ছোট ঠাম্মি জানালেন, এবছর তিনি বেশ চিন্তান্বিত, কোথা থেকে যেন এই এলাকায় চোরের উপদ্রব হয়েছে বেশ। পুজোর সময় 'মা' সোনার আভূষণে সুসজ্জিতা থাকেন , সকলকে তখন খুব সতর্ক থাকতে হয়। এবছর এই এতো উপদ্রবে মায়ের গায়ের গয়না কিভাবে আগলে রাখবে সে নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।  

       

      ছোট ঠাম্মি রিভুর দারুণ ফেভারিট, কত গল্প জানে!! কত মজা করে, আর সব থেকে বড় কথা ঠাম্মির মিষ্টি আন্তরিকতা, সকলের সাথে হাসি ঠাট্টা করে বাড়ী মাতিয়ে রাখা এসব দেখে ঠাম্মিকে ভালোবাসেনা এমন কেউ ভূ-ভারতে থুড়ি গোটা বিশ্বে আছে বলে রিভুর মনে করেনা। রিভু একটু চিন্তা করার ভান করে বলল, 


__"তুমি চিন্তা করনা ঠাম্মি, আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে যাবো, মায়ের গয়না দেখাশুনার ভার তুমি এখন থেকে আমায় দিয়ে দাও।"


ঠাম্মি হেসে আদরের সুরে বললেন....."তোমার বন্ধু দাদুভাই? তোমার মত পালোয়ান হলে তো আমার আর চিন্তাই নেই!! তবে সে তো তোমার মতো ছোট্ট, সে নিজের মাকে ফেলে পুজোর সময় এখানে আসতে চাইবে?"


__"আসবে ঠাম্মি, তুমি কোন চিন্তা করনা, তবে এবার আমাদের উপরের ঘরে নয় আমি আর আমার বন্ধু থাকবে বৈঠকখানা ঘরের পাশের ঘরে, কেমন?"


আশা দেবী রিভুর কথা যদিও কিছুতেই তেমন বিশ্বাস করতে পারলেন না, তবে সঞ্জয়ও যখন একই কথা বললেন, তখন অনিশ্চিত ভাবেই সামনের ঘরটা লোক ডেকে পরিষ্কার করিয়ে রাখলেন।


 আজ মহাষষ্ঠী, শরতের রাঙা অরুণ তাঁর সোনালী ছটায় আলতো রাঙিয়ে তুলেছে পুবের আকাশটাকে। এক আরাম মাখা মৃদুশীতল স্নিগ্ধ সমীরণ হঠাৎ কেমন যেন কাশের বনে, ধানের ক্ষেতে, সবুজ পাতায় হাল্কা শিহরণ জাগিয়ে দোলা দিয়ে চলল, শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ গন্ধে ভরে উঠলো চতুর্দিক। আজ দেবির বোধন। একে একে পরিবারের প্রায় সকলেই কাল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে হাজির হয়েছেন। আর একটু সময়ের মধ্যেই কলকাতা থেকে এসে পৌঁছবেন সঞ্জয়, রিভু আর স্মিতা। আশা দেবী সকাল থেকে পুজোর তোড়জোড় নিয়ে বেশ ব্যস্ত। বাড়িতে ছোট বড় অনেক সদস্যের আগমনে হঠাৎ বাড়ির পরিবেশটা আনন্দে মেতে উঠেছে । বাড়ির মূল সিংহ দরজার পাশে এসে এক বিরাট চার চাকার যান সশব্দে থেমে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো। আশা দেবী একগাল হেসে বললেন 

__"ওই ওরা এলো বলে.....আমার দাদুভাই।"


কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের কানের পর্দায় সজোরে আঘাত করে রিভু চিৎকার করে ডেকে উঠলো ..... "ঠামমমমিইইইইই..."

রিভু বাড়ির সবার ছোট, তাছাড়াও এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে ওর মধ্যে। সকলেই তাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই স্নেহ করেন। সেও সেটা ভালোই বোঝে। ঘরে ঢুকেই তিনি প্রথমে ঠাম্মি তারপর ছোট দাদান তারপর একে একে সকলকে ছুটে ছুটে প্রণাম সেরে ফেললেন। সঞ্জয় আর স্মিতাও পেছন পেছন এসেছে। আশালতা হেসে বললেন


__"এতোক্ষণে বাড়িটা সম্পূর্ণ হল। কত দেরি করলি তোরা?"

তারপর টুকটাক আর কিছু কথা সেরে বললেন


__"কই দাদুভাই তোমার বন্ধু এলোনা? আমি তো তোমার বন্ধুর কথা ভেবে নিশ্চিন্তে বসেছিলাম। ভাবছিলুম যাক্ বাবা এবার আর আমার কোন চিন্তাই নেই....তা কই তুমি তো দেখি..."


আশা দেবীর কথা শেষ হবার আগেই রিভু একটু চোখটা কুঁচকে বলল...."এসেছে তো, তুমি ভয় পাবে নাতো?"


আশালতা সজোরে ঘাড় নেড়ে বললেন...."একদম না, কক্ষনো না।"


রিভু জোওরে ডেকে উঠলো....." ডিঙ্কুউউউউউ"


বাইরের সদর দরজা ঠেলে বিশালাকার দুর্দান্ত এক চারপেয়ে জার্মান শেফার্ড তার লোমশ কালো লেজ দুলিয়ে একছুটে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো, তারপর হুঙ্কার করে সকলকে উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল ....."ঘেউউউউউ"!!


বাড়ির মধ্যে হঠাৎ এক দৌড়াদৌড়ি বেঁধে গেল। যে যেখানে ছিলো কেউ একছুটে ঘরের ঢুকলো, কেউ উঁচু বারান্দার থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো, দীনু কাকা..... "বাবাগো!! বাবাগো!! নেকড়ে!!" শব্দে পুজোর উঁচু চাতালে বেয়ে উপরে ওঠার জন্য বাইতে লাগলো। ঠাম্মি তাড়াতাড়ি দুইপা পিছিয়ে গিয়ে চোখ দুটো বড়োওওওও করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 খিলখিল করে হেসে উঠলো রিভু, বলল......."ঠাম্মি, ও কিচ্ছু করবে না। ও আমার বন্ধু। ওর নাম ডিঙ্কু। ডিঙ্কুউ যাও ছোট্ ঠাম্মিকে নমো কর। "

ডিঙ্কু এগিয়ে এসে সামনের পাদুটো জড়ো করে এগিয়ে দিয়ে পেছনটাকে উঁচু করে বসার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো, তারপর সামনের পায়ের উপরে মাথাটা নিচু করে ঠেকিয়ে রেখে ঠাম্মিকে প্রণাম সারলো। ঠাম্মি " থাক্, থাক্" বলে আবার একটু পিছিয়ে গেলেন। ডিঙ্কু উঠলো না, করুণ চোখে ঠাম্মির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিভু বলল...

__" তুমি ওকে উঠতে না বললে ও উঠবে না ঠাম্মি।"


ডিঙ্কুর প্রণামের ঘটা, চোখ পিটপিটানি, আর নিজেদের বোকামির বহরের কথা চিন্তা করে এবারে ঠাম্মির ভারি হাসি পেল। খিলখিল করে হেসে ফেলে বললেন...." দূর হ মুখ পোড়া, এসে থেকে বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে দিলে। ওরে!! তোরা ওকে ওঠা এবার, ওই দিকের ঘরখানা পরিষ্কার করে রেখেছি, ওকে ঘরে রেখে আয়।"

 

__"দাঁড়াও ঠাম্মি, সবার সাথে একটু আলাপ করুক।"

প্রথমটায় সবাই একটু ঘাবড়ে গেল বটে তারপর নতুন অতিথির আগমনে পুজোটা একটু অন্যরকমই মেজাজ নিলো। রিভু একে একে ছোট দাদান, পারুল পিসি, বড়দা জ্যোঠু, জেম্মা, বড় কাকান,কাকিমনি, মামনি, ছোট পিসি সবার কাছে গিয়ে ডিঙ্কুকে প্রণাম করাতে লাগলো। বাড়ির কচিকাঁচাদের মধ্যে আবার প্রণামের চল তত নেই। সামনের ডান পা এগিয়ে ছোটদের সাথে হ্যান্ডসেকও করে এলো বেশ খানি। বাড়ির ছোটরা তো আনন্দে আত্মহারা। এমন মজার পুজো তারা এর আগে কখনো দেখেনি। এবার দীনু কাকার পালা। ডিঙ্কুকে নিয়ে তার সামনে হাজির হতেই সে প্রায় কেঁদে উঠে বলল...." হেই সেরেচে, ওও দা'বাবু....ওকে সরাও। আমার কাছে কি চাই?"


__"ওহঃ, কুল কাকা কুল।"


__"দেখ দিনি একন এই অসময়ে কুল কোথায় পাই?"


রিভু নিজের কপালে করাঘাত করে ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বললে....."সসসসস্, ও কিচ্ছু করবে না কাকা। ও আমার পোষা। ওর নাম ডিঙ্কু।"


কাকা ভয়ে ভয়ে বলল __"ঝিঙ্কু!!"

__"আরে ধেৎ, ডিঙ্কু"

__"ঝিইইন্টু,"

__"উঁহু কাকা, বল ডিইইইঙকুউউউ"

__"সে যাই হোক, তুমি ওই নেকড়েটা ক্যানে পোষলে দা'বাবু?"

রিভু বোঝে দীনু কাকাকে জার্মান শেফার্ডের সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান বিতরণ করলেও কাকা ডিঙ্কুকে নেকড়ে ছাড়া অন্য কিছুই ভাবে উঠতে পারবে না এই মুহূর্তে। তাই বোঝানোর চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে এক কথায় উত্তর দিলো..."চোর ধরার জন্য।"


ডিঙ্কুকে হঠাৎ একনজরে দেখে যে কারো পক্ষেই ভয় পাওয়াটাই স্বভাবিক। তার রাজকীয় চালচলন, তার দৈহিক সুঠাম আর বলশালী গঠন দেখলে কোন নেকড়ে বাঘের থেকে তাকে কম কিছু মনে হয়না। দীনুকাকাকে দোষ দেওয়া চলেনা। সে বেচারা যদি জানতো জার্মান শেফার্ড আসলে নেকড়ে প্রজাতির সঙ্গেই ব্রীড করানো কুকুর, তাহলে তার কি অবস্থা হত বলা মুশকিল। দিব্যি সকলকে ঘুরে ঘুরে গরম চা পরিবেশন করছিলো, পেছন থেকে ডিঙ্কুর একটা মাত্র "ঘেউউউ" চিৎকার শুনেই চা সমেত পপাৎ ধরনীতল। ঝনঝন শব্দে চতুর্দিক কেঁপে উঠলো, সকলে হৈহৈ করে দীনুকাকাকে টেনে তুলে খানিক হাসাহাসিও শুরু করে দিলো। কেউ বলল......কাকা, এখন যদি স্বয়ং মা দুগ্গা তাঁর সাথের বাহনটিকে এনে ছেড়ে দিতো, তখন তুমি কি করতে?

 বাড়ির সকলের হাসি পেলেও দীনুকাকা কোন ভাবেই ডিঙ্কুকে সহজ করে নিতে পারছে না। তার মনে নেকড়ে কথাটা এমন করে বিঁধে আছে, কোন কারণ ছাড়াই সে ভয় পাচ্ছে , অল্প আওয়াজেই সে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দাঁড়াচ্ছে। দীনদয়াল (দীনু) কাকা এবাড়ির অনেক দিনের বিশ্বস্ত মানুষ এবং অবশ্যই তাকে সবাই এবাড়ির সদস্যই মানেন। আশালতা রিভুকে আদর করে ডেকে বললেন,


__"রাগ করিসনা দাদুভাই, দীনু কাকা এতোটা ভয় পেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। বয়স হয়েছে তো! তাছাড়া আমরা সকলে আনন্দময়ী মায়ের পুজোর আয়োজনে একসাথে হয়েছি, কাল বাড়ির মেয়েরা সবাই কলা বৌকে স্নান করিয়ে আনবেন, কত ধুমধাম হবে,কত কাজ বাড়িতে, সবাই আনন্দ করবে। দীনু কাকা যদি ঘর থেকে না বের হন তোমার ভালো লাগবে দাদুভাই? তাছাড়া বাইরের মানুষও তো কত এসে হাজির হবে তখন?সবাই ভয় পাচ্ছে। ওকে তুমি নাহয় ওই বারান্দায় আটকে রাখো, রাতের বেলায় যখন সবাই শুতে যাবে তখন নাহয় ওকে একটুক্ষণ বাইরে ছেড়ো, কেমন?"


 বাড়িতে ডিঙ্কু ছাড়াই থাকে বেশির ভাগ, পুজোর দিনে শিকল পড়িয়ে রাখতে তার মন চাইলো না। কিন্তু ঠাম্মির কথা সে অমান্য করেনি কক্ষনো। মাথা নিচু করে ডিঙ্কুকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বসলো রিভু। ডিঙ্কু খুব বোঝে রিভুর মনের ভাব। কিছুক্ষণ রিভুর হাতটাকে নিজের পা দিয়ে টেনে নিয়ে খেলতে শুরু করলো, তারপর মুখ দিয়ে রিভুর জামা টেনে ধরে ওকে অস্থির করার চেষ্টা করলো। কোন কিছুতেই রিভু যখন মাথা তুললো না, তখন রিভুর কোলের কাছে ঘেঁষে বসে কোলের উপর মাথা রেখে চোখ বুজলো ডিঙ্কু। রিভু একটু মুখে ভেঙচি কেটে বলল...." উঁউহঃ, খুব তো গলা ছাড়া হচ্ছিলো, বাড়ি শুদ্ধু সবাইকে নিজের বিক্রম না দেখালে চলছিলো না? এখন ভালোমানুষির হচ্ছে? তখন তো একটু চুপ থাকতে পারতি। থাক এখন ঘর বন্দী হয়ে।"

বকা খেয়ে ডিঙ্কু রিভুর আরো খানিক কোল ঘেঁষে শুলো। রিভুর মুখে আঁধার নেমে এলো। চুপ করে ডিঙ্কুর মাথায় সস্নেহে আঙুল বোলাতে থাকলো।


 গল্পগাছা, হৈ হট্টগোলের মধ্যে একটা দিন পাড় হয়ে গেছে। দিনের শেষটা রিভুর জন্য মোটেই ভালো হলনা। মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না রিভু। অনেক আশা নিয়ে সে ডিঙ্কুকে নিয়ে এসেছিলো। আনন্দময়ী মা কি কেবল মানুষের জন্যই হয়? তিনি বুঝি ডিঙ্কুর মা নন? বেশ কিছুক্ষণ চোখের পাতা একই করতে পারলো না রিভু, তারপর কখন যে চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো সে টের পায়নি।গ্রামের দিকে রাতটা যেন একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়ে। আশেপাশের পরিবেশ বেশ নিঝুম, থমথমে। রাত্রি তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর, আশেপাশে এলাকার কুকুরগুলো উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে। বাকের তীব্রতা বেশ একটু বেশিই কানে এলো, হঠাৎ তাদের বাড়ির খানিক দূরে বাজারের কাছ থেকে একটা আওয়াজ ক্রমশ তীব্র হতে থাকলো...."চোওর!! চোওর!! চোওর!!" 

 

দেখতে দেখতে বাড়িশুদ্ধ সকলে উঠানের উপর এসে জড়ো হল, সকলের মনে এক চাপা আশঙ্কা। চোর কোথা থেকে কোন দিকে গেল, তাদের বাড়ির মধ্যে ইতিমধ্যে কেউ ঢুকে পড়লো কিনা। এই লাঠি আনো, সড়কি আনো। সকলে একে অপরকে ডাকাডাকি করে, সাবধান করে ব্যস্ত করে তুললো। রিভু ঘুম চোখে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাড়ির বাইরে বিভিন্ন লোক কথা বলাবলি করতে লাগলো, চোর নাকি এই মুহূর্তে এদিকে আসতে দেখা গেছে, তারপর সে কোথায় লুকিয়ে পড়লো খুঁজে পাওয়া ভার। রিভু খানিকক্ষণ ভেবে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। একছুটে বারান্দার দরজা খুলে, দিয়ে ডিঙ্কুর গলায় চেনটা খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো......"ডিঙ্কু ছু্ঃ....চোর ধরতে হবে। পারবি তো?"

কারো কোন কথা বলে ওঠার আগে ডিঙ্কু এক ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সকলে এগিয়ে গেল ডিঙ্কুর পেছনে। রিভু দেখলো ওই বড় রাস্তার উপর দিয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে ডিঙ্কু।

প্রথমে বাজারের কাছে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গন্ধ শুঁকতে থাকলো, তারপর রাস্তা থেকে নেমে সোজা ধানক্ষেতের আল ধরে এগিয়ে চলল ডিঙ্কু। রিভু ভয় পেয়ে ডেকে উঠলো.... "ডিঙ্কুউউ!!"

ডিঙ্কু থামলো না। হঠাৎ মুখ থেকে গর্ গর্ আওয়াজ করে লাফিয়ে পড়লো কিছুর উপর। চোর সেথায় ঘাপটি মেরে ছিলো, ভেবেছিলো মানুষ সরে গেলেই সে পালাবে, কিন্তু ডিঙ্কু বীর বিক্রমে তার ঘাড়ের উপর দুই পা তুলে দাঁড়িয়ে ঘরর্ ঘরর্ করতে থাকলো। পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে চোরকে ধরে থানার দিকে রওনা হল। গর্বে চক্রবর্তী বাড়ির বুক ফুলে উঠলো। আনন্দে আজ রিভুর চোখ জল ভরে উঠলো। ছুট্টে গিয়ে ডিঙ্কুর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকলো রিভু। দীনুকাকা আজ খুব খুশি। একগাল হেসে বলল..


__"মা ঠাকুরান, নেকড়েটার মাতায় খুব বুদ্দি হুঁ। বড্ড ভালো জাতের কুকুর গো!!"

 আশালতা সকলকে ডেকে বললো, তোমরা এখন শুয়ে পড়, একটু পরেই আবার উঠতে হবে মনে আছে তো!! আর হ্যাঁ, কাল আমাদের সবার আগে ডিঙ্কু থাকবে কেমন? এবছর থেকে একটু অন্য নিয়মেই আমাদের পুজো শুরু হোক, কি বলিস ডিঙ্কু?"


ডিঙ্কু চিৎকার করে ডেকে উঠলো...."ঘেউউউউউউউউউ!!"