জ্বলে তারা দুই দুধ খোকা তুই
গাল ভর্তি হাসির ছররা তুলে রসিয়েই যুবক স্বামীর সাথে প্রেম করার গপ্পো বলতেন আমার ঠাকুমা রাধারানী | আমি যখন রাধারাণীর মুখে এ গল্প শুনি , তখন তাঁর থুবড়ি বুড়িবেলা | নিভু নিভু আঁচে ক্রমাগত জ্বাল…
জ্বলে তারা দুই
দুধ খোকা তুই
গাল ভর্তি হাসির ছররা তুলে রসিয়েই যুবক স্বামীর সাথে প্রেম করার গপ্পো বলতেন আমার ঠাকুমা রাধারানী | আমি যখন রাধারাণীর মুখে এ গল্প শুনি , তখন তাঁর থুবড়ি বুড়িবেলা | নিভু নিভু আঁচে ক্রমাগত জ্বাল খেতে খেতে দুধের আঠা আঠা ভাব যেমন বেশি সোয়াদ আনে ঠিক তেমনই দুধেল হত রাধারাণীর ফি রোজের গল্পের তার | গল্পে ঘটনার ঘনঘটা বা কাটাকুটিটা হত রাধারাণীর মন মর্জি মতো | ধরুন , যেদিন ঠাকুমার সাথে ঠাকুরদার ভাবসাব সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অব্দি টিকে যেত ( বড়োই দুর্লভ সেদিন ) সেদিন বরের গল্প বলায় রাধার সেকী পিরিত ! আর যেদিন সকাল থেকে ধুন্ধুমার বাঁধত ঠাকুরদার সাথে সেদিন গল্প বলার মোহ হারাতেন |
বারো তেরো বয়সের রাধা থাকতেন একটি পাহাড়ি শহরে | সঙ্গে আরো তিন বোন | সন্ধেতে ধপধবে পাহাড়ি মেয়েরা পিঠের ঝাঁকায় কমলা নিয়ে ফিরত | এই সময় থেকেই রাধারানীর বর পছন্দের শুরু | বোনদের সাথে বাজি লড়লেন ---বর হবে তাঁর পাহাড়ি ফর্সা | একদম পাহাড়ের কমলকলিদের মত ধপধপে ফর্সা শরীর চাই বরের | ঠাকুরদার সাথে বিয়েও এই সময় |
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র বিয়ে করলেন স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করা রাধারানীকে | নৌকাপথে রাধা যাচ্ছেন শ্বশুরবাড়ি ---- ঠাকুরদা সারাটাপথ ফাজলামি করে চললেন পাহাড়িবাসী বউয়ের সাথে | নৌকাতেই সহজ সম্পর্ক তৈরি হল খুলনার বর আর লামডিঙের মেয়ের |
বরণ শেষ | রাধা এবার প্রণাম করতে গেলেন শ্বশুরকে | পাশে এক আরো প্রবীণ মুসলিম মানুষ | সবার সামনে ধমকে উঠলেন ঠাকুর্দা ---" উনি আমার মাস্টারমশাই | আগে ওঁকে প্রণাম কর |" মাস্টারমশাই ছাত্রের বউকে দিলেন বেগুনি বেনারসি | ঘরে ঢুকে পাহাড়ি বউ জিভ কেটেছিলেন ---" এতটা পথ ইয়ার্কি করতে করতে এলে ! বলে রাখবে তো মাস্টারমশায়ের কথা ! " -----ছি ছি শ্বশুরের চেয়েও বয়সে বড় মাস্টারমশায়কে আগে প্রণাম না করার এ মহাভুলটা করলেন কী করে এ নিয়ে ব্যাকুল তখন রাধা !
দুতরফ তখন কেউই কাউকে হিন্দু মুসলিম বলে ভাবেননি | না মাস্টার না তাঁর প্রিয় ছাত্র | ঠাকুরদা বা ঠাকুমা সারাজীবন এ ঘটনা মোটেই জানাননি।আসলে ঘটনা যে জানাবার মত এই বাড়তি অনুভব ছিল না তাঁদের কারোরই | ভেদ যাঁর হৃদয়ে নেই সম্প্রীতি তার কাছে পৃথক বক্তব্য হবেই বা কেন ! বলুন ! কবে বললেন -----? তখন সবে নির্বাচনের মাঠের পাশে পদ্মের ছোটখাটো শিবির বসতে | চিরকালের কংগ্রেসপ্রেমী ঠাকুরদা ঘাড় উল্টোদিকে শক্ত করে গোবর ডিঙি মেরে চলে যাবার মত করে টপকালেন সে শিবির | তুমুল গালাগাল দিলেন পদ্মের ছেলেগুলোকে | ভোট দিয়ে ঘরে ঢুকলাম |একী ! ত্রাসে থরথর করে কাঁপছেন আমার চিরসাহসী ঠাকুরদা ? বললাম -/কীসের ভয় এত তোমার ? এইত রাস্তার ওপর বাঘের গর্জন করে ছিঁড়ে দাও প্রায় পদ্মের কলি | এখন কীসের ভয় ? ফিসফিস করে বললেন ----" দ্বেষের পর আরো একটা প্রবাহ আসবে | একটা উল্টো তাণ্ডব | দুইয়ে মিলে শেষ হবে নজরুলের ভারত |"-------আজ মনে হয় কেন আরো একটু পরিষ্কার করে জেনে নিলাম না কোন নিরুচ্চার প্রবাহ নিয়ে এত ভয় পেয়েছিলেন আমার ঋষিতূল্য ঠাকুরদা !
ফিরি রাধার গল্পে | রাধারানী জানিয়েছেন, ফুলসাজে সাজা নতুন বধূকে তাঁর কলেজপাশ স্বামীর প্রথম নির্দেশ ছিল -- বউয়ের কপালে যেন কখনো না থাকে ঘোমটার আবছায়া | সত্যিই তো ! ঘোমটা টেনে বউ তাঁর আকাশ বাতাস পাখপাখালী দেখবে কেমন করে ? ঠাকুমার ঘোমটা টানার শেষ | আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে যখনি ঘোমটা টানার চেষ্টা করেছেন , খসে যেত সরসরিয়ে | অনভ্যেসে রাধারাণীর কপাল করে চড়চড় |
বিয়ের পর রাধারাণীর কালোকেষ্ট শরীর থেকে জন্ম নিতে লাগল একের পর এক সন্তান | তড়িঘড়ি সেগুলো মরেও গেল | একেবারে কুচো চিংড়ি দশাতেই পটাপট মরল | রাধার তখম ঠাকুর্দাকে দেখলেই নাকি হাত নিশপিশ করত ঠেঙাতে | স্বামীর ফর্সা শরীর আর টানতে পারছিল না রানিরাধাকে | ঠিক উল্টোটা ঠাকুরদার | তখনো প্রকাণ্ড পিরিত রাধাতে | মাঝরাতের কামদীপ্ত স্বামী স্ত্রীর ফুটিফাটা মাঠের মতো শরীরে হাত রেখে অদ্ভুত এক আবদার ধরলেন | ভাবতে পারেন কী ছিল সেই বায়না ? ---" গাঁ ভর্তি যত বাচ্চার মা মরেছে সবাইকে বুকের দুধ খাওয়াও | তোমার শরীর ঠান্ডা হবে | শিশুরও পেট ভরবে | দুধহারা শিশুর দল আবার তোমায় ফিরিয়ে দেবে আমার শয্যায় | তৃপ্ত অনাথ তোমার ইচ্ছেটাকে ফের জাগিয়ে তুলবে ! একটু একটু করে |"
নারে ভাই ! স্বামীর পণ্ডিত্যের ধারপাশ ঘেঁষতে পারেননি আমার ঠাকুমা | তবে ঔদার্য আর মায়ায় ছেয়ে দিতে পারতেন সমাজ সংসার | স্বামীর দেয়া ফাইন মসলিন , মকরবালা বিলোতেন গাঁয়ের দুখী মেয়েকে | দুবার ভাবতেন না | পাড়ার বিচ্ছু একটি মুসলমান ছেলেকে দিয়ে শনি ঠাকুরের পুজো পাঠাতেন --- বড়ো বিশ্বাস ঐ ছেলেটির হাতেই তাঁর দেবতা তুষ্ট হবেন | বাজিয়ে দেখার জন্য ধোয়া কাপড়ে পুজো দিতে যেতে চেয়েছি কত্তবার | এক গোঁ ---" তোরা না -- আমার সফিকুলই যাবে পুজো দিতে | " ফেরার পথে আদ্দেক প্রসাদ খেয়ে ফেলত সফি | বাকি আদ্দেক ঠাকুমা |
তখন আমার ইললুতে যৌবন | কেবলই শুনতে চাইতাম ঠাকুরদা ঠাকুমার কিসসা | চাকরি সেরে ছ ছ ঘন্টা সাইকেল চালিয়ে ফিরতেন বত্রিশ বছরের ঠাকুরদা | রাত তখন ভোর প্রায় | ঢুলু ঢুলু চোখে স্বামীকেও নাকি ঠাহর করতে পারতেন না রাধা | অত রাতে দীপ জ্বালাতে ইচ্ছে হত না | আঁধার ঘরে স্বামীর নধর শরীর হাতড়ে বুঝতে চাইতেন ঘরে তাঁর অন্য পুরুষ কিনা !
আরে ! রাধের দেখি রাখঢাক নেই ক মোটে | মাখন গলায় মাথা নেই মুন্ডু নেই , বলেই চলতেন রাধারানী ! আমার মহামতি ঠাকুরদা | তাঁর মহারানী বউ | কান্না পায় ! আমার কান্না পায় !
★★ লেখাটি উৎসর্গ করলাম রাধারাণীর সেই দুধসন্তানদের ★★