#বিভাগ--গল্প#গল্প---আমার ঠাকুমার সিনেমা দেখা#কলমে--দিয়ান রীনা
সালটা ১৯৮৭ আমি তখন ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী।আমার আগে আমার দাদা সে তখন সিক্সে পড়ে আর দাদার কোলে দিদি সে তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে।সেই সময় হঠাৎ করে শোনা গেল মল্লিকা সিনেমা হলে &quo…
#বিভাগ--গল্প
#গল্প---আমার ঠাকুমার সিনেমা দেখা
#কলমে--দিয়ান রীনা
সালটা ১৯৮৭ আমি তখন ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী।আমার আগে আমার দাদা সে তখন সিক্সে পড়ে আর দাদার কোলে দিদি সে তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে।সেই সময় হঠাৎ করে শোনা গেল মল্লিকা সিনেমা হলে "বেদের মেয়ে জোৎস্না"সিনেমা এসেছে।সিনেমা এত হিট সব শো হাউস ফুল হয়ে যাচ্ছে।তখন হাউসফুল শব্দের মানেও জানতাম না।
একদিন সময়টা তখন বৈশাখ মাস ।সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার দেখে ঠাকুমা আমাদের তিন ভাইবোন কে নিয়ে চলল মল্লিকা সিনেমা হল।বাড়িতে আর একজন মেম্বার ছিল গৌতমদা,আমার বড় পিসির মেজছেলে।সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে।তার পড়ার দোহাই দিয়ে ঠাকুমা তাকে নিয়ে গেল না।ঠাকুমা গিয়েছিল তিনটে ছটার শো দেখতে।গিয়ে যথারীতি দেখি হাউসফুল।
হায় হায় প্রায় আটকিমি হেঁটে এসে যদি শুনতে হয় হাউস ফুল তাহলে কার মাথার ঠিক থাকে।অবশ্য ঠাকুমা ও জানতোনা হাউসফুল মানে।দাদা উচুঁ ক্লাসে পড়ে সে ঠাকুমা তার সাথে আমাদের দুই বোন কে বুঝিয়ে দিল।শুনে তো দুই বোন বাড়ি থেকে এতদুর আসার কষ্টে ই হোক বা টিকিট না পাওয়ার দুঃখে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলাম।কারন এরপর আছে ছটা নটা শো।নটা মানে অনেক রাত হয়ে যাবে।আর। বাবা যদি নটার সময় আমাদের তিনভাইবোনকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাহলে একটা লাঠির মার ও মাটিতে পড়বে না।
এমন সময় ঠাকুমার চোখে পড়ল আমাদের গ্রামের উপেন বোস হলে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে ঠাকুমা তার কাছে ব্যাপার টা পুরো জানালো।সে তো প্রথমে না না করছিল,পরে ঠাকুমা র হাতে চারটা টিকিট ধরিয়ে দিয়ে সরে গেল।আমরা দুইবোন তখন হাসতে হাসতে হলের ভিতরে ঢুকলাম।জীবনে প্রথম বার হলের ভিতরে ঢুকে দুমকরে আমি আছাড় খেলাম।কারন হলের ভিতরে ভীষণ অন্ধকার।কোনো রকমে লাইট ম্যান আমাদের নিয়ে গিয়ে আমাদের সিটে বসিয়ে দিল।
ওও বাবা এতো সিনেমার খুব কাছে।মানে একেবারে সামনের সিটে আমাদের সিট।যখন নায়িকা কোমর দুলিয়ে কলসি নিয়ে চলেছে মনে হচ্ছে নায়িকার মাজা আমার মুখে এসে ঢুকে যাচ্ছে।নায়ক যখন বর্শা ছুঁড়ছে মনে হচ্ছে বর্শা আমার ছাতির ভিতরে এসে ঢুকে যাচ্ছে।তার সাথে আওয়াজ এত জোরে বাজছে কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।শুধু মনে হচ্ছে, কখন বাইরে বেরাবো।কিন্তু লক্ষ্য করলাম ঠাকুমা চুপচাপ।ও বাবা ভালো করে চোখ কচালে দেখি ঠাকুমা তখন শয়নে পদ্মলাভ করেছে।এত শব্দ ও তাকে কোনোরকম বিচলিত করতে পারিনি, বরং ঠাকুমার পাশে বসে ঠাকুমার নাক ডাকা শুনে বেচারা ভদ্রলোক এতটুকু সিনেমা দেখতে পারেনি।
সিনেমা শেষ হতে কোনো রকমে ঠাকুমা কে জাগিয়ে নিয়ে বাইরে এসে পুরো থ মেরে গেছি।প্রবল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।মানে কালবৈশাখী।হলের বাইরে পা রাখার জায়গা নেই।লোক গিজগিজ করছে।যারা পরের শো দেখবে তারা যেমন আছে,তেমনি আমরা যারা ভিতরে ছিলাম তারা ও আছি।আমাকে ঠাকুমা ভালো করে ধরে আছে,আর দাদা কে দমে বকছে।কারণ দাদাই হুজুগ তুলে ছিল সিনেমার।এদিকে বাড়িতে মা একা,ঘরে গোরু,বাছুর আছে।সকালে ধান সিদ্ধ করে মেলা আছে।মায়ের পক্ষে একা হাতে সব করা সম্ভব নয়।এইসব কথা চিন্তা করে ঠাকুমা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল।একটু পরে বৃষ্টি ধরতে ঠাকুমা আমাদের নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।ঠাকুমার সাথে জোরে জোরে হাঁটতে পারছিনা, শুধু পেছিয়ে পড়ছি।অনেক বার ঠাকুমা কে আস্তে আস্তে হাঁটার কথা বলছি,ঠাকুমা রেগে গিয়ে আমাকে বলেই দিল তুই রাস্তায় রয়ে যা।কাল সকালে যাবি।
ভয়ে তো আমার হাতপা ভিতরে সেঁধিয়ে গেল।আবার কিছুটা এগিয়ে এসে ঠাকুমা কে বললাম পায়ের যন্ত্রণা হচ্ছে ঠাকুমা, একটু কোলে নিবে।আমার কথা শুনে ঠাকুমা চলতে চলতে পিঠে দুমদুম করে চারটা তাল বসিয়ে দিল।এই ভাবে বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি এমন সময় আবার জোরে বৃষ্টি নামলো,তার সাথে বাজ পড়তে লাগলো।ঠাকুমা আমাদের নিয়ে গেঁড়িবুড়ি র আটচালায় দাঁড়ালো।আটচালা থেকে ঘর দেখা যাচ্ছিল,কিন্তু তবুও যেতে পারছিলাম না।হঠাৎ দেখি আমাদের গোটা বাড়িটা আগুনের গোলার মতো জ্বলছে।তখন আমাদের পাকা বাড়ি ছিল না।মাটির বাড়ি ছিল।আর ওই সময় আমাদের বাড়ির উপরে যেন খুব জোরে বাজ পড়ল।ঠাকুমা সব দেখে শুনে আটচালায় কাঁদতে কাঁদতে মাথা কুটতে লাগলো।আর গেঁড়িবুড়ি র কাছে মানত করে বিলাপ করতে লাগলো।ঠাকুমা ভেবেছিল বাড়িতে বাবা মা আর পিসির ছেলে আছে।আর বাজ পড়ে সবার মৃত্যু হয়ে গেল বুঝি।
আধঘণ্টা পর বৃষ্টি একটু ধরতে বাড়িতে এসে দেখি পিসি র ছেলে গৌতম দা ভয়ে কাঁপছে।আর মা তাকে গরম দুধ খাওয়াচ্ছে।যেটুকু মায়ের মুখে শুনলাম গৌতম দা চেয়ারে বসেছিল হঠাৎ একটা আগুনের গোলা ঘরে ঢুকে গৌতম দার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।যেহেতু গৌতম দা কাঠের চেয়ারে বসেছিল,তাই চেয়ার সহ উল্টে পড়ে যায়।মা সেই সময় উনুনে কি রান্না করছিল ।ছুটে এসে দেখে দাদা পড়ে আছে,আর ঘরের যত আলো ফটফট করে ফেটে যাচ্ছে।আর ঘরের তুলসী তলায় আগুনের ছাই যেন ছড়িয়ে আছে।মা পুকুরের দিকের দরজা টা খুলে রেখেছিল আগুনের গোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।
পরে জানা যায় আমাদের যে আরতিং ছিল সেটা কিভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।যার ফলে ঘরে এই বিপত্তি হয়েছিল।পাখা, লাইট সব পুড়ে গিয়েছিল।দাদা র পিঠে তো কিছু পড়লো না,আমরা দুই বোন বাবার হাতে বেধড়ক পিটুনি খেলাম।নাক কান মুলে দিব্যি খেয়েছিলাম, কোনো দিন আর সিনেমা দেখতে যাবনা বলে।আর গৌতম দা এখনো ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে তাকে কেউ ঘরের বাইরে বের করতে পারবে না।চাহে দুনিয়া ইধার উধার হয়ে যাক।আর একটা কথা বলা হয়নি, বাজ পড়ে আমাদের পুকুর পাড়ে একটা খুব ভালো কাঁঠাল গাছ ছিল, ওই গাছের কাঁঠাল যারা খেয়েছে তার া জানে ওর স্বাদ।বাজ পড়ার দু তিনদিন পর গাছটা আপনা আপ শুকিয়ে কাঁঠাল সহ মারা গেল।